ঘুম থেকে ওঠার পর য়ুহার এক সেকেণ্ড সময় লাগে বোঝার জন্যে সে কোথায় আছে। মাথার কাছে বড় একটা টেবিল, সেই টেবিলের ঠিক মাঝখানে স্বাচ্ছ কোয়ার্টজের একটা গোলক, সেটা দেখে হঠাৎ করে য়ুহার মনে পড়ে সে একটা মহাকাশযানে করে যাচ্ছে। য়ুহা তখন তার আরামদায়ক বিছানায় উঠে বসে বেশ কিছুক্ষণ স্বচ্ছ কোয়ার্টজের গোলকটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর বিছানা থেকে নেমে আসে।
য়ুহা যখন খাবার টেবিলে গিয়েছে তখন সেখানে শুধু মিটিয়া নামের মেয়েটি বসে কোনো একটা পানীয়তে চুমুক দিচ্ছে। য়ুহাকে দেখে মুখে হাসি টেনে বলল, ঘুম ভাঙল?
হ্যাঁ। ভেঙেছে।
তোমাকে দেখে আমার রীতিমতো হিংসে হয়।
হিংসে হয়? আমাকে?
মিটিয়া মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।
কেন?
তুমি যখন ইচ্ছে ঘুমাতে যেতে পার, যখন ইচ্ছে ঘুম থেকে উঠতে পার।
য়ুহা টেবিলের নিচে সুইচটাতে চাপ দিতেই একটা অংশ খুলে ধূমায়িত একটা ট্রে বের হয়ে আসে। তার মাঝে কয়েক ধরনের কৃত্রিম শর্করা এবং প্রোটিন। য়ুহা পানীয়ের মগটা টেনে নিয়ে এক চুমুক খেয়ে বলল, এই মহাকাশযানের সবকিছুই তো নিয়ন্ত্রণ করছে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক। তোমাদের কমান্ডের কারো তো কোনো কাজ নেই–তোমরা সবাই আমার মতো যখন ইচ্ছে ঘুমাও না কেন? যখন ইচ্ছে জেগে ওঠো না কেন?
মিটিয়া শব্দ করে হেসে উঠে বলল, আমরা একটা কমান্ডের অধীনে কাজ করি। আমাদের সব সময় এমনভাবে প্রস্তুত থাকতে হয় যেন পরের মুহূর্তে একটা অঘটন ঘটবে!
কিন্তু কোনো অঘটন তো ঘটছে না।
না ঘটছে না। কিন্তু আমাদের প্রস্তুত থাকতে হয়, সে জন্যে আমরা আছি।
এই মুহূর্তে যদি কিছু একটা অঘটন ঘটে তাহলে তোমরা তার জন্যে প্রস্তুত?
হ্যাঁ। মিটিয়া হেসে বলল, আমার কথা বিশ্বাস না করলে বিপদ সংকেতের এলার্মটা বাজিয়ে দেখ। মুহূর্তের মাঝে পুরো কমান্ড তাদের দায়িত্ব নিয়ে চলে আসবে।
য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, যদি দেখি আমার মহাকাশ ভ্রমণ আস্তে আস্তে একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে তাহলে একদিন আমি বিপদ সংকেতের এলার্মটা বাজিয়ে দেব।
নিজের দায়িত্বে বাজিয়ে! যদি দেখা যায় শুধু মজা করার জন্যে বাজিয়েছ তাহলে বাকি সময়টা ক্যাপ্টেন ক্রব তোমাকে তোমার ঘরে তালা মেরে আটকে রাখতে পারে! আমাদের সামরিক নিয়মকানুন তা-ই বলে!
য়ুহা খাবারের ট্রে থেকে একটা কৃত্রিম ফল হাতে নিয়ে সেটাতে একটা কামড় দিয়ে বলল, তোমরা সবাই কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক খুব বিশ্বাস কর?
হ্যাঁ। করি। মিটিয়া তার পানীয়তে শেষ চুমুক দিয়ে মগটা টেবিলের নিচে ঢুকিয়ে বলল, তুমি কর না?
আমি কোনো যন্ত্রকে কখনো বিশ্বাস করি না।
মিটিয়া হাসি হাসি মুখ করে বলল, কিন্তু তুমি নিজে কি একটা বায়ো মেডিকেল যন্ত্র না?
য়ুহাকে একটু বিপন্ন দেখায়, সে ইতস্তত করে বলল, আমি, মানে আমি-
হ্যাঁ তুমিও একটা যন্ত্র। কোনো কোনো যন্ত্র জৈবিক উপায়ে তৈরি হয়, কোনো কোনোটা আমরা তৈরি করি। এই হচ্ছে পার্থক্য!
য়ুহা ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি বলতে চাইছ, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক জৈবিক যন্ত্রের মতো কিছু একটা?
হ্যাঁ। কোনো কোনো দিকে তার থেকে বেশি।
তার মানে আমি যদি একটা কবিতার লাইন বলি তোমাদের কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক তার পরের লাইনটা বলতে পারবে?
মিটিয়া খিলখিল করে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি নিজেই চেষ্টা করে দেখ! আমার মনে হয় পারবে।
পারবে?
হ্যাঁ।
আমি কেমন করে জিজ্ঞেস করব?
কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের একটা কণ্ঠ ইন্টারফেস আছে। সেটা ব্যবহার করা হয় না। ক্যাপ্টেন ক্রবকে বললে সে তোমার জন্যে এটা চালু করে দিতে পারবে। তুমি তখন তার সাথে খোশগল্প করতে পারবে!
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি!
বাহ। খুব মজা তো। আমি ক্যাপ্টেন ত্রুবকে এখনই ধরছি।
কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল য়ুহা একটা গোপন পাসওয়ার্ড ঢুকিয়ে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে। প্রথমে সে খানিকটা অনিশ্চিতের মতো বলল, আমি য়ুহা, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তুমি যদি আমার কথা বুঝে থাক তাহলে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
কাছাকাছি একটা ভয়েস সিনথেসাইজার শুষ্ক এবং যান্ত্রিক গলায় বলল, উত্তর হ্যাঁ-সূচক।
তুমি কি কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক কথা বলছ?
উত্তর পুনরায় হ্যাঁ-সূচক।
তুমি কি আমাকে চেনো? আমার নাম-
উত্তর হ্যাঁ-সূচক। তথ্যকেন্দ্রে তথ্য সংরক্ষিত।
মুহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে সবাই বলেছে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক অত্যন্ত বুদ্ধিমান। আমার ধারণা ছিল তুমি সত্যিকার মানুষের মতো কথা বলতে পারবে। কিন্তু তুমি একটা খেলনা যন্ত্রের মতো শব্দ করছ।
মানব প্রজাতির মতো কথা বলতে সক্ষম।
তাহলে বলছ না কেন?
আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা প্রয়োজন।
ঠিক আছে। ঠিক আছে। আমি আনুষ্ঠানিকভাবে তোমাকে বলছি—একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সাথে যেভাবে কথা বলে, তুমি সেভাবে আমার সাথে কথা বল।
বয়স?
আমার বয়সী?
পুরুষ অথবা রমণী?
য়ুহা এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, পুরুষ। কোয়ান্টাম কম্পিউটার তার যান্ত্রিক গলায় বলল, ঠিক আছে।
য়ুহা জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এখন সত্যিকার মানুষের মতো কথা বলবে?
ভয়েস সিনথেসাইজার থেকে সুন্দর পুরুষের মতো গলার কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক বলল, বলব। অন্তত বলার চেষ্টা করব!
চমৎকার! য়ুহা একটু এগিয়ে এসে বলল, কথা বলার সাথে সাথে যদি তোমাকে দেখতে পেতাম সেটা আরো মজা হতো!