স্ক্রিন? য়ুহা চোখ বড় বড় করে বলল, এটা তাহলে একটা স্ক্রিন? এটা জানালা না?
হ্যাঁ এটা একটা স্ক্রিন। মহাকাশযানের বাইরে যে ক্যামেরা আছে সেগুলো থেকে মহাকাশযানের যে ছবি দেখা যাচ্ছে সেগুলো এই স্ক্রিনে দেখাচ্ছে।
তার মানে এটা আসল মহাকাশ না? এটা মহাকাশের ছবি?
ক্যাপ্টেন ত্রুব বলল, তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ আমি জানি না। আমাদের সামনে একটা খোলা জানালা থাকলে আমরা যা দেখতাম এখানে হুঁবহুঁ তা-ই দেখা যাচ্ছে।
হুবহুঁ একরকম। কিন্তু আসল দৃশ্য নয়?
ক্যাপ্টেন ত্রুব বলল, তুমি যদি সেভাবে বলতে চাও বলতে পার।
য়ুহার মুখে আশাভঙ্গের একটা ছাপ পড়ল। সে নিচু গলায় বলল, আমি আসলে নিজের চোখে সত্যিকার মহাকাশ দেখতে চেয়েছিলাম।
এটা সত্যিকার মহাকাশ, তুমি নিজের চোখে দেখছ।
এটা সত্যিকার মহাকাশ না। এটা সত্যিকার মহাকাশের ছবি!
ক্যাপ্টেন ত্রুব হিসানের দিকে তাকিয়ে হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালো। হিসান বলল, য়ুহা তুমি বিশ্বাস কর। সত্যিকার মহাকাশ ঠিক এ রকম। হুঁবহুঁ এ রকম।
য়ুহা বলল, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করছি। কিন্তু তবুও সত্যিকার মহাকাশ দেখতে চাইছিলাম।
সত্যিকার মহাকাশ দেখার উপায় থাকে না। তার প্রয়োজন নেই, তুমি যেহেতু অনেক ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছ কেন তার জন্যে কষ্ট করবে।
য়ুহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোমরা বুঝতে পারছ না। আমি ব্যাপারটা অনুভব করতে চাই। অনুভব। ভুল জিনিস দিয়ে কোনো কিছু অনুভব করা যায় না। সত্যি আর তার ছবি এক নয়।
ক্যাপ্টেন জব বাধা দিয়ে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি বুঝতে পারছি তোমার কৌতূহলটা যৌক্তিক কৌতূহল নয়, এটা হচ্ছে এক ধরনের আবেগতাড়িত কৌতূহল!
য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরতে পেরেছ। আমার ভেতরে যুক্তি খুব বেশি নেই। যা আছে তার পুরোটাই আবেগ! এবং—
এবং?
সে জন্যে আমার কোনো লজ্জা নেই। কোনো হীনম্মন্যতা নেই।
ক্যাপ্টেন ক্ৰব মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে, আমি বুঝিতে পারছি। আমি তোমাকে সত্যিকার জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তারপর হিসানের দিকে তাকিয়ে বলল, ট্রান্সপোর্ট ঘরের পাশে সিকিউরিটি চ্যানেলের যে কোয়ার্টও জানা আছে য়ুহাকে সেখানে নিয়ে যাও।
কিন্তু সেটা এত ছোট!
হ্যাঁ। অনেক ছোট। কিন্তু কিছু করার নেই।
য়ুহা আগ্রহ নিয়ে বলল, ছোট হোক আমার আপত্তি নেই! সত্যিকার জানালা হতেই হবে। আমি ছোট একটা জানালা দিয়েই বাইরে তাকাতে পারব।
হিসনি ইতস্তত করে বলল, জায়গাটাতে অক্সিজেন সরবরাহ আর তাপমাত্রার খানিকটা সমস্যা আছে।
য়ুহা ব্যস্ত হয়ে বলল, থাকুক! আমার আপত্তি নেই।
কোয়ার্টজের একটা জানালা, অতিবেগুনি রশ্মিা পুরোটুকু কাটা যায়। রেডিয়েশনের সমস্যাও আছে।
ক্যাপ্টেন ক্রব বলল, রেডিয়েশন মনিটর দেখে যেও। আমার মনে হয় সিকিউরিটি স্যুট পরে গেলে কোনো সমস্যা হবে না।
কাজেই কিছুক্ষণ পর দেখা গেল ট্রান্সপোর্ট ঘরের পাশে সিকিউরিটি চ্যানেলের কাছে একটা সিকিউরিটি স্যুট পরে য়ুহা কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে।
হিসান জিজ্ঞেস করল, তুমি যেটা দেখতে চেয়েছ সেটা দেখছ?
য়ুহা বুকের ভেতর আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, হ্যাঁ, দেখছি। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমি নিজের চোখে মহাকাশকে দেখছি।
কেমন দেখছ?
অপূর্ব! গ্যালাক্সিটা দেখেছ?
হ্যাঁ, এন্ড্রোমিডা। আমাদের সবচাইতে কাছের গ্যালাক্সি।
আমার চোখের পাতি ফেলতেও ভয় করছে। মনে হচ্ছে চোখের পাতি ফেললে যদি চলে যায়?
হিসান শব্দ করে হাসল, বলল, না যাবে না। এই গ্যালাক্সিটা ঠিক এখানেই থাকবে! আমাদের মহাকাশযানটা তার গতিপথ এতটুকু পরিবর্তন না করে এগিয়ে যাবে। তাই এন্ড্রোমিডাটাকে থেখানে দেখছ সেখানেই দেখবে, আগামী এক মাস এটা এখান থেকে এক চুলও নড়বে না।
য়ুহা আবার কোয়ার্টজের জানালায় মুখ লাগিয়ে বলল, আমি এটাকে আরো কিছুক্ষণ দেখি?
দেখ। তোমার যতক্ষণ ইচ্ছে দেখ।
য়ুহা কোয়ার্টজের জানালায় মুখ লাগিয়ে মহাকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তার এখনো নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না যে সত্যি সত্যি মহাকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
০৭. ঘুমানোর আগে য়ুহা
ঘুমানোর আগে য়ুহা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। বিছানায় তার মাথার কাছে টেবিলের ঠিক মাঝখানে স্বচ্ছ কোয়ার্টজের গোলকটা যেখানে রেখে গিয়েছিল সেটা ঠিক সেখানেই আছে–তার জায়গা থেকে সেটা এক চুল নড়েনি। ক্যাপ্টেন ক্রব ঠিকই বলেছিল, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক সত্যিই অসাধারণ। এত বড় একটা মহাকাশযানকে অচিন্ত্যনীয় বেগে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, শুধু যে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা-ই নয়, প্রতি মুহূর্তে তার গতিবেগ বাড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। মনে হয় তারা সবাই মিলে বুঝি মহাকাশযানে নিঃসঙ্গ পরিবেশে কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ঘুমানোর আগে য়ুহা যোগাযোগ মডিউলটা চালু করে শীতলঘরে ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায় শীতল করে রাখা এগারোজন মানুষকে একবার দেখে। রায়ীনার ছবিটা ভেসে আসার পর সে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে, মেয়েটার চেহারায় এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণবন্ত মানুষের চিহ্ন ছিল। এখন সেখানে কিছু নেই, শক্ত পাথরের মতো দেহটি নিশ্চল হয়ে আছে, দেখে মনে হয় না এটি আসলে কোনো মানুষের দেহ। মনে হয় এটা বুঝি পাথরের তৈরি একটা ভাস্কর্য। য়ুহা রায়ীনার দেহটির দিকে তাকিয়ে নিজের বুকের ভেতরে এক ধরনের বেদনা অনুভব করে, ঠিক কী কারণে জানা নেই তার ভেতরে এক ধরনের গভীর অপরাধবোধের জন্ম নেয়।