হিসান হেসে ফেলল, বলল, উঁকি দিয়ে দেখারও কিছু নেই। মূল নেটওয়ার্কটা হচ্ছে প্রায় এক মিটার বর্গাকৃতির একটা নিখুঁত ক্রিস্টাল, এর মাঝে একটা পরমাণুও তার সঠিক জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়নি। এটাকে রাখা হয় চরম শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রায়। আলোর সকল তরঙ্গে এর সাথে যোগাযোগ হয়। বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করার জন্যে এটাকে ঘিরে রয়েছে একটার পর আরেকটা তারপর আরেকট। ওর! হিস। এ মুহূর্ত থেমে বলল, তোমার ঘরের যোগাযোগ মডিউলে তুমি এ সম্পর্কে সব তথ্য পেয়ে যাবে। হলোগ্রাফিক ছবিতে দেখানো আছে।
য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, আমি হলোগ্রাফিক ছবি দেখতে চাই না। আসল জিনিসটা দেখতে চাই।
ঠিক আছে, তুমি তাহলে আস আমার সাথে, তোমাকে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের ঘরটির কাছাকাছি নিয়ে যাই।
হ্যাঁ। চল। আমার দেখার খুব শখ।
হিসান য়ুহাকে মহাকাশযানের নানা গলি ঘুচি দিয়ে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের ঘরটিতে নিয়ে গেল। চারপাশে নানা ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা, তার মাঝখানে বর্গাকৃতির সাদামাটা ঘর। বলে না দিলে বোঝার উপায় নেই এর ভেতরে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কটা রয়েছে।
য়ুহা ঘরটার ধাতব দেয়াল স্পর্শ করে বলল, কেউ যদি এই দেয়াল ভেঙে ঢুকে যায়?
হিসান শব্দ করে হেসে বলল, নিউক্লিয়ার বোমা দিয়েও এই দেয়াল ভাঙা যাবে না। মহাকাশযানের সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকাটি হচ্ছে এই কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের ঘর।
য়ুহা বাইরে থেকে ঘুরে ঘুরে ঘরটিকে দেখে, ধাতব দেয়ালটি হাত দিয়ে স্পর্শ করে তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, চল, যাই।
চল। তুমি যেটা দেখতে চেয়েছিলে সেটা দেখেছ?
হ্যাঁ দেখেছি।
সত্যি কথা বলতে কী তুমি এই ঘরের ধাতব দেয়াল ছাড়া আর কিছুই দেখনি।
য়ুহা হিসানের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি একজন কবি। আমার কাজই হচ্ছে কল্পনা করা। আমি যেটা দেখতে পাই না সেটা কল্পনা করতে পারি, আমি যেটুকু দেখিনি সেটুকু কল্পনা করে নিয়েছি।
হিসান মাথা ঘুরিয়ে একবার য়ুহার মুখের দিকে তাকালো, কোনো কথা বলল না।
মহাকাশযানের গলি খুঁচি দিয়ে হেঁটে হেঁটে মূল নিয়ন্ত্রণকক্ষের দিকে ফিরে আসতে আসতে য়ুহা বলল, আমি এই মহাকাশযানে যে জন্যে এসেছি
সেটা কিন্তু এখনো করিনি।
কী করতে এসেছ?
আমি মহাকাশযানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মহাকাশকে দেখব। আমি শুনেছি এটা নিকষ কালো-তার মাঝে শুধু নক্ষত্রগুলো জ্বলজ্বল করে, দূরে কোনো একটা গ্যালাক্সিকে স্পষ্ট দেখা যায়।
হিসান মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। মহাকাশযানে মহাকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা একটা অভূতপূর্ব দৃশ্য। যারা প্রথমবার দেখে তারা হতবাক হয়ে যায়।
য়ুহা বলল, আমার মনে হয় আমি যত দিন এই মহাকাশযানে থাকব তত দিন এই জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে থাকব। ব্যাপারটা চিন্তা করেই আমার এক ধরনের শিহরণ হচ্ছে। আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে!
হিসান বলল, তুমি যখন নিজের চোখে দেখবে তখন গায়ের লোম শুধু দাঁড়িয়ে যাবে না–দাঁড়িয়ে নাচানাচি করতে থাকবে!
নিয়ন্ত্রণকক্ষে ঢুকে সত্যি সত্যি য়ুহার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। সামনে বিশাল একটা স্বচ্ছ জানালায় মহাকাশকে দেখা যাচ্ছে–নিকষ কাল অন্ধকার মহাকাশে অসংখ্য নক্ষত্র জ্বলছে। দুরে একটি গ্যালাক্সি আরো দূরে আরো কয়েকটি গ্যালাক্সি। মাঝামাঝি একটা অংশে ধোয়াটে কিছু অংশ, তার মাঝামাঝি একটা অংশ গাঢ় অন্ধকারে ড়ুবে আছে। দেখে মনে হয় পুরো মহাকাশ বুঝি জীবন্ত কোনো প্রাণী তার সহস্র চোখ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
য়ুহা বুকের ভেতর আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, কী অসাধারণ! কী অপূর্ব!
হিসান য়ুহার উচ্ছ্বাসে যোগ দিল না। সে অসংখ্যবার মহাকাশ অভিযানে যোগ দিয়েছে, এই দৃশ্য তার কাছে খুব পরিচিত একটা দৃশ্য।
য়ুহা বলল, আমার ধারণা ছিল নক্ষত্রগুলো বুঝি মিটিমিটি করবে–
হিসান মাথা নাড়ল, বলল, ভুল ধারণ! মিটিমিটি করে না। স্থির হয়ে জ্বলে। যদি বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে দেখতে হয় তাহলে এ রকম মনে হতে পারে।
এত বিচিত্র রং আছে সেটাও আমি জানতাম!
হ্যাঁ। নক্ষত্রের তাপমাত্রার ওপর তার রংটা নির্ভর করে।
কোনো কোনোটা উজ্জ্বল কোনো কোনোটা এত নিষ্প্রভ যে দেখাই যায় না।
হিসান বলল, সেগুলো এত লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরে যে তুমি সেটা কল্পনাও করতে পারবে না।
আমি একজন কবি। য়ুহা নিজের বুকে হাত দিয়ে বলল, আমি সব কল্পনা করতে পারি।
ঠিক এ রকম সময়ে ক্যাপ্টেন ক্ৰব ঘরটিতে এসে ঢুকল, য়ুহার কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল, তুমি সব কল্পনা করতে পার?
হ্যাঁ। পারি।
দেখা যাক তোমার কথা সত্যি কি না। ক্যাপ্টেন ক্ৰব জানালার মাঝামাঝি একটা অংশের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, তুমি এই দিকে তাকিয়ে থাক।
তাকিয়ে থাকলে কী হবে?
আমি এর ঔজ্জ্বল্যতাটুকু বাড়িয়ে দিই–তুমি তখন একটা অংশ দেখবে যার কাছাকাছি একটা ব্ল্যাক হোল আছে। ব্ল্যাক হোলের আকর্ষণে যে গ্যাস–
দাঁড়াও-দাঁড়াও-তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না। তুমি এর ঔজ্জ্বল্যতাটুকু কেমন করে বাড়াবে? আমরা জানালা দিয়ে বাইরে মহাকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। মহাকাশের ঔজ্জ্বল্যতা তুমি কেমন কয়ে বাড়াবে?
এই যে। ক্যাপ্টেন ক্রব হলোগ্রাফিক একটা প্যানেল বের করে তার একটা জায়গায় স্পর্শ করে বলল, এর পুরো নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে। এই স্ক্রিনে যা আছে তার সবকিছু আমি ইচ্ছে করলে আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে পারি।