য়ুহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বেগ যেটুকু বাড়ানোর কথা ততটুকু বাড়ানো হয়ে গেছে? আর বাড়ানো হবে না?
ক্যাপ্টেন ত্রুব একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, কবি য়ুহা–এই যে তুমি মহাকাশযানের ভেতরে ভেসে বেড়াচ্ছ না, শক্ত মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছ তার অর্থ আমাদের বেগ এখনো বাড়ছে। তবে সেটা আমাদের সহ্যসীমার ভেতরে। তাই তুমি টের পাচ্ছ না।
য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, সব মিলিয়ে আমার একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা হলো।
মিটিয়া নামের ডাক্তার মেয়েটি হেসে বলল, অভিজ্ঞতা হলো বলো না, বল অভিজ্ঞতা হওয়া শুরু হলো।
য়ুহা ভয়ে ভয়ে বলল, কেন? আরও কিছু হবে নাকি?
গতিবেগটা যেভাবে বাড়ানো হয়েছে আবার সেভাবে কমানো হবে? একই ব্যাপার হবে তখন।
য়ুহা শুকনো মুখে বলল, সেটা কখন হবে?
মিটিয়া মাথা নাড়ল, বলল, যখন সময় হবে তখন জানানো হবে।
ক্যাপ্টেন ক্ৰব মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তার দেরি আছে য়ুহা। তুমি নিশ্চিন্ত মনে তোমার মহাকাশ ভ্রমণ উপভোগ কর। তোমার আনন্দের জন্য এখানে সব রকম ব্যবস্থা করে দেয়া আছে।
ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন ক্ৰব। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
আমাকে ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই। আমাদের উপরে নির্দেশ দেয়। হয়েছে আমরা যেন তোমার আনন্দের ব্যবস্থা রাখি। তোমার সম্মানে আজকে আমরা বিশেষ ধরনের খাবারের ব্যবস্থা করেছি। নাও খেতে শুরু কর।
বিশেষ ধরনের খাবার খেতে গিয়ে য়ুহা আবিষ্কার করে সেটি আসলে মোটামুটি সাধারণ খাবার। মহাকাশযানের দীর্ঘ সময়ের জন্যে নিশ্চয়ই খাবারে বৈচিত্র্য আনা কঠিন। য়ুহা এক টুকরো শুকনো রুটি গরম স্যুপে ভিজিয়ে মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, আমার ধারণা ছিল তোমাদের কোনো একজন একটা ককপিটে বসে থেকে মহাকাশযানটাকে চালিয়ে নিয়ে যাবে!
য়ুহার কথা শুনে খাবার টেবিলের কয়েকজন শব্দ করে হেসে উঠল। ক্যাপ্টেন ক্রুব মাথা নেড়ে বলল, না, আমাদের এই মহাকাশযানটা আমাদের চালিয়ে নিতে হয় না। যাত্রার শুরুতে আমাদের গন্ত স্থানের কোঅর্ডিনেট ঢুকিয়ে দিতে হয়। বাকি কাজটুকু কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক করে।
তোমাদের কিছুই করতে হয় না? না, আমাদের কিছুই করতে হয় না।
য়ুহা একটু ইতস্তত করে বলল, একটা যন্ত্রের ওপর এত বিশ্বাস রাখা। কি ঠিক?
উত্তেজক পানীয় খাবার কারণে প্রায় সবাই একটু তরল মেজাজে ছিল, এবারে অনেকেই শব্দ করে হেসে উঠল। হিসান নামের সুদর্শন মানুষটি তার পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ককে যন্ত্র বলা ঠিক নয়। তার ভেতর যে জটিল নেটওয়ার্ক আছে সেটা মানুষের মস্তিষ্কের নেটওয়ার্ক থেকেও বেশি জটিল, বেশি বিস্তৃত। এই মহাকাশযানের প্রত্যেকটা বিন্দুর ওপর সেটি দৃষ্টি রাখছে, সেটি নিয়ন্ত্রণ রাখছে।
ক্যাপ্টেন ত্রুব গলা উঁচিয়ে বলল, য়ুহাকে আমাদের কোয়ার্টজ গোলকের পরীক্ষাটি দেখিয়ে দিই।
মিটিয়া মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটা দেখিয়ে দাও!
ক্যাপ্টেন ক্রব হিসানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি একটা কোয়ার্টজ গোলক নিয়ে এসো তো!
হিসান প্রায় সাথে সাথেই একটা ছোট কোয়ার্টজের স্বচ্ছ গোলক এনে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের হাতে ধরিয়ে দেয়। ক্যাপ্টেন ক্র অনেকটা বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলল, এই যে আমার হাতে গোলকটা দেখছ এটা একটা নিখুঁত গোলক। এটাকে ভরশূন্য পরিবেশে তৈরি করা হয়েছে। এই কোয়ার্টজের গোলকটাকে আমি সাবধানে এই টেবিলটার ওপর রাখছি।
ক্যাপ্টেন ত্রুব সাবধানে গোলকটাকে টেবিলের ওপর রাখল, তারপর হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, তুমি দেখছ এটা স্থির হয়ে আছে, কোনোদিকে গড়িয়ে যাচ্ছে না?
য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ দেখছি।
তার মানে কী বলতে পারবে?
য়ুহা মাথা চুলকে বলল, তার মানে, তার মানে—এই টেবিলটা একেবারে সোজা, এটা কোনোদিকে ঢালু হয়ে নেই?
হ্যাঁ। একজন কবি হিসেবে তোমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা খারাপ নয়। আমাদের এই মহাকাশযানের প্রযুক্তি প্রায় নিখুঁত, এই টেবিলগুলো সব সময়েই সোজা কোথাও কোনোদিকে ঢালু হয়ে নেই। কিন্তু এখানে আরেকটা ব্যাপার আছে।
কী ব্যাপার?
মহাকাশযানটা এক জি ত্বরণে সোজা, সামনের দিকে যাচ্ছে। এত বড় একটা মহাকাশযানের গতিতে এতটুকু বিচ্যুতি না ঘটিয়ে নিখুঁতভাবে নেয়া কিন্তু সহজ নয়। যদি এতটুকু বিচ্যুতি হয় আমরা এই গোলকটাতে দেখব। যদি মহাকাশযানটা একটু বামদিকে ঘুরে যায় এই গোলকটা ডানদিকে গড়িয়ে আসবে, যদি মহাকাশযানটা ডান দিকে ঘুরে যায় এটা বাম দিকে গড়িয়ে যাবে।
য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, মজার ব্যাপার।
ক্যাপ্টেন ক্ৰব কোয়ার্টজের স্বচ্ছ গোলকটা য়ুহার হাতে দিয়ে বলল, নাও। এটা তুমি রাখ, তোমার ঘরের টেবিলের ঠিক মাঝখানে এটা রেখে দাও। তুমি দেখবে আগামী এক মাসেও এটা এক চুল ডানে বা বামে সরবে না। আমাদের কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের কাজ এত নিখুঁত!
য়ুহা গোলকটা হাতে নিয়ে বলল, তোমাকে ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন ক্ৰব।
খাওয়ার পর সবাই মহাকাশযানের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। য়ুহা হিসানকে খুঁজে বের করে বলল, হিসান, তুমি কি আমাকে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কটা একটু দেখাতে পারবে?
হিসান একটু অবাক হয়ে বলল, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক দেখবে?
হ্যাঁ।
আসলে এটা তো দেখার মতো কিছু নয়। মহাকাশযানের ঠিক মাঝখানে একটা ঘরের ভেতরে আছে।
সেই ঘরে আমরা যেতে পারি না?
না। ভেতরে যাবার কোনো উপায় নেই।
উঁকি দিয়ে দেখতে পারি না?