জ্বি না। আচ্ছা প্রফেসর বার্ন এই সেনিটোরিয়ামে আমার মত রোগী কি আরো আছে?
এই সেনিটোরিয়ামে অনেকেই আছে। তবে একেকজনের সমস্যা একেক রকম। কারো সমস্যার সঙ্গে অন্য কারোর সমস্যার কোন মিল নেই।
আমরা রোগীরা কি একই সমুদ্র দেখছি, নাকি একেকজন একেক রকম সমুদ্র দেখছি।
জানালা দিয়ে কে কি দেখবে তা রোগীর সাইকোলজিক্যাল প্রফাইল দেখে তৈরি করা হয়। সবাই তো আর সমুদ্র পছন্দ করে না। কাজেই কেউ দেখছে। অরণ্য, কেউ শহর দেখছে।
আমার যদি এখন সমুদ্র না দেখে অন্য কিছু দেখতে ইচ্ছা করে আমি কি তা পারব?
না পারবে না। তুমি কি দেখবে-না-দেখবে তা তোমার দায়িত্বে নিয়োজিত রোবট ঠিক করে দেবে। তার কাছে তোমার পুরো ডিএনএ ম্যাপিং আছে। তুমি নিজেকে যতটা চেন এই রোবট তোমাকে তারচে অনেক ভাল চেনে।
প্রফেসর বার্ন উঠে দাঁড়ালেন। রেফ্ সমুদ্রের দিক থেকে তার চোখ ফিরিয়ে নিল। শান্ত গলায় বলল, প্রফেসর আমার বিষয়ে আপনাদের সিদ্ধান্ত কি?
কোন্ সিদ্ধান্তের কথা বলছ?
আপনারা কি আমাকে ছেড়ে দেবেন? না আরো পরীক্ষা-নীরিক্ষা করবেন?
বুঝতে পারছি না।
আপনাদের পরীক্ষা কি শেষ হয়েছে, নাকি বাকি আছে?
পরীক্ষা শেষ হয়েছে।
পরীক্ষার ফলাফল কি? আমার অসুখটা কি?
আমরা তোমার অসুখের কোন নাম দিতে পারছি না। আপাতত কেইস স্ট্যাডি DA 001 এই নামে চলছে। তোমার স্বপ্ন-সংক্রান্ত জটিলতা হচ্ছে। তুমি দীর্ঘ স্বপ্ন দেখছ। স্বপ্নগুলি সত্য মনে হচ্ছে। তোমার মস্তিষ্কে ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল ঠিকমত প্রসেস করতে পারছে না। খানিকটা এলোমেলো করে দিচ্ছে। যে কারণে তোমার মস্তিষ্ক ধরতে পারছে না, কোন্ জগৎটি সত্যি। স্বপ্নের জগৎটি সত্যি না বাস্তবের জগৎটি সত্যি।
এমন কি হতে পারে যে দুটিই সত্যি?
না হতে পারে না।
হতে পারে না কেন?
একই সময়ে একটি বস্তু দুই জায়গায় থাকতে পারে না।
সাব-এটমিক পার্টিকেল কিন্তু এটা পারে।
তুমি কোন সাব-এটমিক পার্টিকেল নও। তুমি একজন মানুষ।
রেফ্ কফির কাফ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, এখন আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন।
প্রফেসর বার্ন শান্ত স্বরে বললেন-আমি প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করব।
এখন তো আমি জেগে আছি। আমার সামনে আপনি বসে আছেন, একটু আগে কফি খেলাম। জানালা দিয়ে তাকিয়ে সমুদ্র দেখলাম এটা কি স্বপ্ন না সত্যি।
প্রফেসর বাৰ্ন হেসে ফেললেন, হাসতে হাসতে বললেন, এটা স্বপ্ন না। এটা সত্যি। গায়ে চিমটি কেটে দেখ ব্যথা পাবে।
এত নিশ্চিত হয়ে বলছেন কিভাবে?
নিশ্চিত হয়ে বলাটাই কি স্বাভাবিক না। আমরা তোমার চিকিৎসা শুরু করেছি তোমার স্বপ্ন-সংক্রান্ত সমস্যার কথা জেনে।
সমস্যার কোন সমাধান আপনাদের কাছে নেই?
না। আমারা গত চার বছর ধরে আমার চিকিৎসা করছেন?
হ্যাঁ চার বছরের কিছু বেশি।
চিকিৎসায় যখন কোন লাভ হচ্ছে না তখন আমাকে ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন?
বিজ্ঞান কাউন্সিলের বিশেষ নির্দেশ আছে তোমাকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখার। তাছাড়া মানসিকভাবে অসুস্থ রোগীকে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে দেয়া হয় না। বিজ্ঞান কাউন্সিল এই বিষয়ে অত্যন্ত কঠিন।
আমার ধারণা আমাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। এই ধারণা কি সত্যি?
প্রফেসর বার্ন জবাব দিলেন না। মাথার চুল টানতে লাগলেন এবং হাসতে লাগলেন। রেফ্ বলল, বিজ্ঞান কাউন্সিলের কারো সঙ্গে কি আমি কথা বলতে পারি?
না পার না। সাধারণ একজন মানসিক রোগীর সঙ্গে বিজ্ঞান কাউন্সিলের কেউ কথা বলবেন না।
আমাকে সাধারণ একজন মানসিক রোগী ভাবা হচ্ছে? হ্যাঁ।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি কম্পিউটার আমার দেখাশোনা করছে। সে অষ্টম ধারার রোবট, বিজ্ঞান কাউন্সিল সাধারণ একজন মানসিক রোগীর পেছনে এমন একটি কম্পিউটার সার্বক্ষণিকভাবে ব্যবহার করবেন, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
না। বিশ্বাসযোগ্য না।
কাজেই আমি সাধারণ একজন মানসিক রোগী না। আমি বিশেষ কিছু। সেই বিশেষ কিছুটা কি আমি জানতে চাচ্ছি। আমার ধারণা বিজ্ঞান কাউন্সিল এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারে। আমিও বিজ্ঞান কাউন্সিলকে সাহায্য করতে পারি।
আমি তোমার প্রস্তাব বিজ্ঞান কাউন্সিলকে পৌঁছে দেব।
ধন্যবাদ। আমি কি আরেকটি অনুরোধ আপনাকে করতে পারি।
অবশ্যই পার তবে অনুরোধ রক্ষা করতে পারব কি না সেটা বলতে পারছি না। আমার ক্ষমতা সীমিত।
আমি কি স্বপ্ন দেখি তা তো আপনারা জানেন।
হ্যাঁ জানি।
শুরু থেকে এই পর্যন্ত কি কি স্বপ্ন দেখেছি তা আমি জানতে চাই। আমার ফাইলটা আমি নিজে পড়তে চাই।
মানসিক রোগীকে কখননা তার নিজের ফাইল দেখতে দেয়া হয় না।
নিয়মের ব্যতিক্রম কি করা যায় না।
না যায় না।
রে বিছানা থেকে নামার সঙ্গে ঘরটা লম্বাটে হয়ে গেল। জানালা অদৃশ্য। জানালার পাশে খাট, খাটের উপর রাখা কম্বল সবই অদৃশ্য। এখন এটা আর ঘর না, লম্বা টানা-বারান্দা। বারান্দাভৰ্তি ফুলের টব। বারান্দার বাইরে বাগান। গাছভর্তি ফুল দূরের সমুদ্রও বাগান থেকে দেখা যাচ্ছে। বারান্দা তৈরি হয়েছে তার হাঁটার জন্যে। যতক্ষণ সে হাঁটবে ততক্ষণ বারান্দা থাকবে। গাছভর্তি নকল ফুল থাকবে, নকল সমুদ্র থাকবে। সে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তার পাশে একটা চেয়ার তৈরি হয়ে যাবে। সে চেয়ারে বসে বিশ্রাম করতে পারবে।
সে বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটল। তার ইচ্ছা করছে বারান্দা থেকে নেমে বাগানের দিকে যেতে। সে-চেষ্টা করে লাভ নেই। বারান্দা থেকে নামা যাবে না। তার চারদিকে কঠিন দেয়াল। দেয়ালে বাগান বা সমুদ্রের ছবি ভেসে উঠছে। হাত বাড়ালেই দেয়াল ছোঁয়া যাবে। হাত বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। খোলা বারান্দার একটা বিভ্রম তৈরি হয়েছে। বিভ্রমটা থাকুক।