রফিক মাথা নিচু করে খাচ্ছিল; আমেনা বেগমকে দেখে মাখা আরো নিচু করে ফেলল। আমেনা বেগম ছেলেটাকে দেখে মুগ্ধ হলেন—সুন্দর চেহারা। বড় বড় চোখ। চোখ দেখেই মনে হয় খুব বুদ্ধি। আমেনা বেগম বললেন, নিজের বাড়ি মনে করে থাকবা। কোন কিছুর প্রয়োজন হলে খবর পাঠাবা।
রফিক মাথা আরো নিচু করে বলল, জ্বি আচ্ছা।
জুম্মাবারে অবশ্যই নামাজে যেতে হবে। এই বাড়িতে যারা থাকে তারা যদি জুম্মাবারে নামাজে না যায় তাহলে শেফার বাবা খুব রাগ করে।
রফিক আবারো বলল, জ্বি আচ্ছা।
আমেনা বেগম বললেন, তোমার দেশের বাড়ি কোথায়?
রফিক বলল, আমি ঠিক জানি না।
আমেনা বেগম বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি জান না মানে কি? তোমার পিতা-মাতা কোথায় থাকেন?
এটাও আমি জানি না। ছোটবেলার কোন স্মৃতি আমার নাই। আমি বড় হয়েছি এতিমখানায়।
আমেনা বেগম খুবই লজ্জা পেলেন। শেফার বাবা যদি ছেলে প্রসঙ্গে এই কথাগুলি আগে বলে রাখতেন তাহলে তিনি রফিককে এ ধরনের কথা বলে লজ্জা পেতেন না।
ছেলেটার জন্যে সেদিন তিনি খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। মনে মনে ভেবেছিলেন তোমার কষ্টের দিন শেষ হয়েছে। এই বাড়িতে তুমি আশ্রয় পেয়েছ এখন তোমার আর চিন্তা নাই। শেফার বাবা অতি বদমেজাজি মানুষ, তবে অতি ভাল মানুষ। সে তোমার একটা না একটা গতি করে দিবে।
আমেনা বেগম প্রথমদিন ছেলেটির প্রতি যে মমতা বোধ করেছিলেন আজও সেই মমতা বোধ করছেন, তবে একই সঙ্গে তাঁর বুক কঁপছে। তার মন বলছে ভয়ংকর এক সময় তাঁর সামনে। তিনি তাঁর মেয়েকে নিয়ে মহাবিপদে পড়তে যাচ্ছেন। আল্লাহপাক সাহায্য না করলে তিনি এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবেন না।
শেফা আরাম করে ঘুমুচ্ছে। মায়ের মানসিক যন্ত্রণার কথা মেয়ে কিছুই জানে না। আমেনা বেগম শেফার গায়ে হাত রাখলেন।
শেফা বলল, ছটফট করছ কেন মা। তোমার কি হয়েছে।
ছটফট করতেছি তোরে কে বলেছে?
কেউ বলে নাই। বুঝতে পারি। মা, রফিক স্যার কি এখনো উঠানে বসা?
হুঁ।
চোখে দুরবিন?
না দুরবিন নাই।
কাঠের মূর্তির মত চুপচাপ বসে আছে, ঠিক-না মা?
হুঁ।
স্যারের একটা ব্যাপার কি জান মা? স্যার ঘন্টার পর ঘণ্টা চুপচাপ বসে কি যেন চিন্তা করে।
কি চিন্তা করে?
জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না, হাসে। একবার শুধু বলেছিল—হিসাব করে। হিসাব নাকি মিলে না।
কি হিসাব করে?
জিজ্ঞেস করেছিলাম মা। কিছু বলে না। স্যারের একটা মস্ত বড় গুণ কি জান মা? স্যার যে কোন অংক মুখে মুখে করতে পারে। কাগজ-কলম লাগে না।
ও।
যে-কোন অংক স্যারকে দিয়ে শুধু বলবে, উত্তর কত? স্যার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর বলবে।
অংক ভাল জানে বলেই তো তোর বাবা তাকে রেখেছে তোকে পড়াবার জন্যে।
অংক ভাল জানা এক কথা আর মুখে মুখে অংক করা আরেক কথা।
ঘুমাতো, স্যারকে নিয়ে এত কথা বলার দরকার নাই।
সান্দিকোনা স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব আগামী বুধবার রফিক স্যারকে নিয়ে একটা অংক খেলার আয়োজন করেছেন। খুবই মজার খেলা। খেলাটা কি রকম বলব?
বল।
ব্ল্যাকববার্ডে দশটা অংক লেখা থাকবে। রফিক স্যার অংকগুলি করবেন মুখে মুখে আর বাকি যারা আছে তারা করবে ক্যালকুলেটর দিয়ে।
আচ্ছা ঠিক আছে শুনলাম।
মা, তুমি একটা কাজ করতে পারবে?
কি কাজ?
পাকঘরে গিয়ে এককাপ চা বানায়ে দিবে। স্যার সারারাত জেগে আছে তো, সকালবেলা এককাপ চা পেলে খুব খুশি হবে। চা-টা আমি হাতে করে নিয়ে যাব মা।
আমেনা বেগম আবারো চমকালেন। কি ভয়ংকর কথা। কি মহাবিপদ তাঁর সামনে। তিনি এই বিপদ কি করে সামলাবেন। এত বুদ্ধি কি তাঁর আছে? বুদ্ধি আছে শেফার বাবার। যে-কোন বিপদ, যে-কোন সমস্যা এই মানুষটা সামাল দিতে পারে। কিন্তু এই বিপদের কথা তাঁকে কিছুতেই বলা যাবে না।
কই মা, শুয়ে আছ কেনচা বানাতে যাও। আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে চা বানাতে হবে না। আমি নিজেই বানাব।
শেফা খাট থেকে নামছে। আমেনা বেগমের হাত-পা জমে যাচ্ছে। কি হতে যাচ্ছে।
মসজিদে আজান হচ্ছে। শেফার বাবা এখনি ঘুম থেকে উঠবেন। তিনি যদি দেখেন তার মেয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে…না তিনি আর ভাবতে পারছেন না। তার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
খুব ঠাণ্ডা লাগছে
খুব ঠাণ্ডা লাগছে। ভয়াবহ ঠাণ্ডা। হাত-পা-শরীর সব যেন জমে যাচ্ছে। এরকম কেন হচ্ছে? রফিকের গায়ে গরম কাপড়, মাথায় কানঢাকা টুপি। চোখে কালো চশমা। এই চশমা মুখের উপর চেপে বসে আছে। নিশ্বাস নেবার জন্যে নাকে কিছু একটা লাগানো আছে। তার পায়ে জুতা, সেই জুতা হাঁটু পর্যন্ত এসেছে। কোমরে বেল্ট বাধা। বেল্ট থেকে অনেক কিছু ঝুলছে। মাথায় হেলমেট আছে। সেই হেলমেট বেশ ভারি। মাথা সোজা করে রাখতে তার কষ্ট হচ্ছে। সবচে কষ্ট হচ্ছে নিশ্বাস নিতে। খুব বড় করে নিশ্বাস টানার পরেও তার বুক ভরছে না। বাতাসে মনে হচ্ছে অক্সিজেন নেই। ফুসফুসে বাতাস ঢুকছে আর মনে হচ্ছে ফুসফুস ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে।
সে মন্তবড় একটা হলঘরে আছে। সে শুয়ে আছে, না বসে আছে নাকি দাঁড়িয়ে আছে কিছুই বুঝতে পারছে না। এটা কি কোন স্বপ্নদৃশ্য? স্বপ্ন দৃশ্য তো মনে হচ্ছে না। স্বপ্ন দৃশ্যে ঠাণ্ডা-গরমের অনুভূতি থাকে না। রফিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে চেষ্টা করল। ঘরের দেয়াল, মেঝে, ছাদ সবই একরকম। সবকিছুই মনে হচ্ছে নীল কাচে তৈরি। নীল কাছ থেকে অস্পষ্ট আলো আসছে। আলো অস্পষ্ট হলেও চোখে লাগছে। ঘরের ছাদ, দেয়াল বা মেঝে কোনদিকেই বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না। একদিক থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালে যে চোখের আরাম হচ্ছে তাও না। রফিককে ঘনঘন চোখ বন্ধ করতে হচ্ছে।