আমেনা বেগম ঘুমন্ত শেফার গায়ে চাদর দিয়ে দিলেন। শেফা সঙ্গে সঙ্গে সেই চাদর ফেলে দিল। আমেনা বেগম বললেন, তুই জেগে আছিস।
শেফা বলল, হ্যাঁ।
শরীর বেশি খারাপ লাগছে?
না শরীর অল্প খারাপ, মন বেশি খারাপ।
মন খারাপ কি জন্যে?
রফিক স্যারকে একটা জিনিস ময়মনসিংহ থেকে আনতে বলেছিলাম। আনে নাই।
কি জিনিস?
রবারের চুড়ি।
রবারের আবার চুড়ি হয় নাকি?
হয়, রবারের চুড়ি হয়। নতুন বের হয়েছে।
তারে তুই চুড়ি আনতে বলছিলি কি জন্যে? সে মাস্টার মানুষ।
মাস্টার মানুষ চুড়ি আনতে পারবে না? নাকি আনলে সেটা বিরাট দোষ। জেল-জরিমানা হবে।
আমেনা বেগম মেয়ের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন মাথার যন্ত্রণা আছে? টিপে দেই?
শেফা বিছানায় উঠে বসল। আমেনা বেগম বললেন, কি হয়েছে?
শেফা বলল, দেখে আসি।
কি দেখে আসবি?
দুরবিন কতদূর হয়েছে দেখে আসি।
আমেনা বেগমের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। মেয়েটা বলে কি। গভীর রাতে সে কার কাছে যেতে চায়।
শেফা বলল, স্যার বলেছেন দুরবিন তৈরি হয়ে গেলে সেই দুরবিনে প্রথম চাঁদ দেখব আমি।
তুই প্ৰথম কেন দেখবি? তোর প্রথম দেখার দরকার কি?
সেটা তো মা আমি জানি না। কে প্রথম দেখবে কে দুই নম্বরে দেখবে সেটা আমি ঠিক করি নাই। স্যার ঠিক করেছেন। তুমি উনাকে জিজ্ঞেস করে দেখ।
আমেনা বেগম অবাক হয়ে দেখলেন শেফা তড়তড় করে বিছানা থেকে নামহে। এই মেয়েকে এখন আটকানো যাবে না। কাজেই এখন যা করতে হবে তা হল—তাকে সঙ্গে যেতে হবে। মেয়ের সঙ্গে মা থাকলে আর কোন দোষ থাকে না। কোন কারণে যদি ইয়াসিন সাহেবের ঘুম ভেঙে যায় এবং তিনি জানালা দিয়ে দেখেন গভীর রাতে মা-মেয়ে রফিকের সঙ্গে কথা বলেছে তিনি কিছু মনে করবেন না। কিন্তু তিনি যদি দেখেন মেয়ে একা কথা বলছে—তাহলে বাড়িতে গজব হয়ে যাবে। বাড়ির পেছনের জঙ্গলে গর্ত করে মেয়েকে জীবন্ত পুঁতেও ফেলতে পারেন।
স্যার দুরবিন তৈরি হয়েছে?
প্রায়।
প্রায় কেন, বাকি আছে কি?
চোঙটা আরো বড় করতে হবে। বেশি না সামান্য করলেই হবে।
কতক্ষণ লাগবে?
ধর ঘণ্টা খানিক।
আমেনা বেগম বললেন, এখন রেখে দাও। ঘুমুতে যাও। যা করার সকালে করবে।
রফিক নিচু গলায় বলল, এখন ঘুমাতে গেলে ঘুম আসবে না। মনটা এখানে পড়ে আছে।
শেফা বলল, স্যার আপনার কিছু লাগবে? রফিক বলল, না কিছু লাগবে। না।
এবাপ চা বানায় এনে দিব?
না লাগবে না।
কোন সাহায্য লাগবে। করাত দিয়ে কাঠ কাটা, কিংবা শিরিষ কাগজ ঘষা। আমি করাত দিয়ে খুব ভাল কাঠ কাটতে পারি। কোন্ কাঠটা কাটতে হবে আপনি দেখায় দেন, আমি চোখের নিমিষে কেটে দেব।
কাঠ কাঠতে হবে না। কাটাকাটির কাজ শেষ। এখন শুধু জোড়া দেয়া।
আমেনা বেগমের বুক ধড়ফড় করছে। মেয়ে এভাবে কথা বলছে কেন? তার গলার স্বর কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়েও আছে। রফিকের দিকে। একবারও চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। তিনি মেয়ের হাত ধরে তাকে নিয়ে ঘরে চলে এলেন। ব্যবস্থা নিতে হবে। খুব সূক্ষ্ম ব্যবস্থা। কেউ যেন কিছু বুঝতে না পারে এমন ব্যবস্থা। রফিককে এ বাড়িতে রাখা যাবে না।
অসম্ভব।
শেফা বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। আমেনা বেগমের ঘুম আসতে অনেক দেরি হল। সেই ঘুমও ভাল হল না। একটু পর পর ঘুম ভেঙে যায়। যতবার ঘুম ভাঙে তিনি জানালার কাছে যান এবং দেখতে পান রফিক চোখ লাগিয়ে তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে। এই ছেলের কি ক্লান্তি বলে কিছু নাই?
শেষবার জানালা থেকে ফিরে বিছানায় উঠতে যাবেন, শেফা বলল, মা স্যার কি এখনো চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছেন?
আমেনা বেগম চাপা গলায় বললেন, তুই জানলি কিভাবে?
তুমি যেমন একটু পরপর দেখে আসছ আমিও দেখে আসছি। আমি যখন দেখতে যাই তুমি তখন গভীর ঘুমে থাক বলে কিছু বুঝতে পার না।
আমেনা বেগম লক্ষ করলেন মেয়ে কাঁদছে। কান্নার কোন শব্দ হচ্ছে না, তবে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। মেয়ের এই কান্নার ভঙ্গি তার চেনা।
তুই কাঁদতেছিস কি জন্যে?
স্যার বলেছিল আমি প্রথম দেখব। এখন সে নিজে দেখতেছে। আমার কথা তার মনেই নাই। মা স্যারকে তুমি বলবা সে যেন আমাদের বাড়িতে আর না থাকে, অন্য কোথাও চলে যায়। আমি এই স্যারের কাছে পড়ব না। এই স্যার কেন, আমি কোন স্যারের কাছেই পড়ব না।
শেফা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমেনা বেগম মনে মনে বলছেন কি সর্বনাশ! কি সৰ্বনাশ।
সর্বনাশ তো বটেই। নাম-পরিচয় নেই এক ছেলে। বড় হয়েছে এতিমখানায়। সেই ছেলের কথা ভেবে তার মেয়ে চোখের পানি ফেলছে। এমন ভয়ংকর কথা তো কাউকে বলা যাবে না। কেউ জানতে পারলেও সর্বনাশ হয়ে যাবে।
ছেলেকে এই বাড়িতে থাকতে দেয়াই ভুল হয়েছে। সাধারণ ভুল না, বড় ভুল। মানুষ যখন ছোটখাটো ভুল করে তখন বুঝতে পারে। বড় ভুল করার সময় কিছু বুঝতে পারে না। বুঝতে পারলে মানুষ বড় ভুল করতে পারত না।
শেফার বাবা যখন বললেন, শেফার জন্যে একটা ভাল ছেলের সন্ধান পেয়েছি। তখন আমেনা বেগম আনন্দিত গলায় বলেছিলেন, পাত্র কি করে? এতে শেফার বাবা খুবই রেগে গিয়ে বললেন-পাত্র কি করে মানে? পাত্রের কথা আসছে কেন? শেফাকে পড়াবে এমন একজনের কথা বলতেছি। শেফাকে তো মেট্রিক পাস করা লাগবে।
আমেনা বেগম খুবই লজ্জা পেয়েছিলেন। রফিক প্রথম যেদিন এ বাড়িতে থাকতে এল তখনও লজ্জা পেলেন। ভিন্ন কারণে লজ্জা পেলেন। রফিকের জন্যে দুপুরে ভাত পাঠিয়েছেন। প্রথমদিন সেই হিসেবে খোঁজ নিতে গিয়েছেন।