রেফের দুঃস্বপ্নগুলি এখন আমি দেখতে শুরু করব?
রেলা বলল, শুধু যে দুঃস্বপ্নগুলি দেখবেন তা না, সুখস্বপ্নগুলিও দেখবেন।
সেটা শুরু হবে কখন থেকে?
শেফ বলল, আমার ধারণা শুরু হয়ে গেছে।
এমন ধারণা হল কেন?
রেফ্ আজ যতক্ষণ ঘুমিয়েছে আপনিও ঠিক ততক্ষণ ঘুমিয়েছেন।
ও!
আমার ধারণা আপনি ঘুমের মধ্যে বিচিত্র কিছু স্বপ্ন দেখেছেন। কি স্বপ্ন দেখেছেন একটু মনে করার চেষ্টা করুন।
আমি তার প্রয়োজন দেখছি না।
রেফের দুঃস্বপ্ন কখন দেখতে শুরু করবেন জানতে চেয়েছিলেন, এই জন্যেই জিজ্ঞাস করা। আপনি যদি বিচিত্র স্বপ্ন দেখে থাকেন তাহলেই ধরে নিতে হবে লকার কাজ করা শুরু করেছে।
এমরান টি ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেললেন। হ্যাঁ বিচিত্ৰ অর্থহীন স্বপ্ন তিনি দেখেছেন। স্বপ্নটা খুব স্পষ্ট না, আবার অস্পষ্টও না। স্বপ্নে খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। তিনি লম্বাটে ধরনের বিচিত্র জলযানে শুয়েছিলেন। জলযানটি খুব দুলছিল। খুবই ক্ষুধার্ত বোধ করছিলেন। তাঁর জন্যে খাবার নিয়ে একটা মেয়ে ঢুকল। মেয়েটা প্রচুর কথা বলে। নানার ধরনের কথা। সে হাতে বিচিত্র গোলাকার কিছু অলংকার পরেছিল। হাত নেড়ে নেড়ে মেয়েটা যখনই কথা বলেছে তখনি হাতের অলংকার থেকে বাজনার মতো শব্দ হচ্ছিল। বিনরিন, টিনটিন ধরনের শব্দ। মেয়েটির গায়ের পোশকও খুব অদ্ভুত। লম্বা একপ্রস্ত কাপড় দিয়ে শরীর ঢাকা।
এমরান টি বললেন, স্বপ্নে আমি অদ্ভুত একপ্রস্থ পোশাকে একটা মেয়েকে দেখলাম। মেয়েটা কে?
শেফ নরম গলায় বলল, স্যার মেয়েটা আপনার প্রেমিকা। তার নাম শেফা। আমার নামের সঙ্গে তার নামের মিল আছে।
মেয়েটা আমার প্রেমিকা মানে?
মেয়েটা রেফ্কে অসম্ভব ভালবাসে। এখন রেফকে ভালবাসা মানেই আপনাকে ভালবাসা। এই অর্থে বলেছি সে আপনার প্রেমিকা। সমান্য মজা করলাম। আশা করি অপরাধ নেবেন না।
এমরান টি উঠে দাঁড়ালেন। তিনি লাইব্রেরি-ঘরের দিকে যাচ্ছেন। হঠাৎ করেই তাঁর কাগজ-কলম নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছা করছে। তার মানে কি এই যে, রেফ্ নামের ছেলেটিরও কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে? তার নিজের চিন্তা ভাবনা কি এখন আর আলাদা করে কিছু নেই। তিনি কি ক্ৰমে ক্ৰমে রোবটে পরিণত হচ্ছেন। যে রোবট তিনি সারা জীবন ঘৃণা করে এসেছেন সেই রোবট?
রেলা। রেলা।
রেলা এসে তাঁর সামনে দাঁড়াল। এমরান টি বললেন, লেখালেখি করব। কাগজ-কলম দাও।
স্যার আপনার লেখার টেবিলে কাগজ-কলম সবই দেয়া আছে।
থ্যাংক য়্যু।
রেফ্ নামের ছেলেটা কি করছে বলতে পার?
অবশ্যই পারি স্যার। উনি দ্রুত কি যেন লিখছেন।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আজ বিকেল তিনটায় সায়েন্স কাউন্সিলের অধিবেশন আছে। অধিবেশনের বিষয় হয়…।
বিষয় জানতে চাচ্ছি না। কারণ অধিবেশনে আমি যাচ্ছি না।
আপনার যাওয়া খুব প্রয়োজন। কারণ এই অধিবেশনে রেফ্ সম্পর্কে কথাবার্তা হবে।
হোক কথাবার্তা আমি যাব না।
এমরান টি লেখার টেবিলে বসে প্রথম বাক্যটি লিখলেন—আমার নাম…বাক্যটা তিনি শেষ করলেন না। কারণ তাঁর লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে আমার নাম রে। তিনি জানেন তাঁর নাম রেফ্ না। তাঁর অন্য একজনের নাম লিখতে ইচ্ছা করছে। কি ভয়ংকর কথা।
রেফ লাইব্রেরি-ঘরের মেঝেতে বসে আছে। তার সামনে টেবিল। সে দ্রুত লিখে যাচ্ছে।
আমার নাম রেফ্।
কিংবা আমার নাম রফিক।
কিংবা আমিই রেফ্ এবং আমিই রফিক।
আমাকে ঘিরে কি হচ্ছে আমি নিজে তা জানি না। নিজেকে জানতে হলে নিজের অতীত জানতে হয়। আমার কাছে মনে হচ্ছে আমার কোন অতীত নেই। আমার সবটাই বর্তমান। রেফ হিসেবে আমার স্মৃতি হচ্ছে সেনোটারিয়ামের স্মৃতি। এর আগে আমি কোথায় থাকতাম কি করতাম কিছুই জানি না। শুধু আমাকে বলা হয়েছে—আমি একজন প্রবলেম সলভার। আমি কোন্ ধরনের প্রবলেম সলভ করতাম, তা জানি না। সেই স্মৃতি ইচ্ছা করে নষ্ট করা হয়েছে। আমি শুধু গত চার বছরের কথা জানি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে রফিক হিসেবেও আমার স্মৃতি এই চার বছরের। চার বছর আগে কি করতাম আমি জানি না। ভাসা-ভাসা ভাবে জানি আমি মানুষ হয়েছি এতিমখানায়।
কেউ আমাকে দিয়ে কিছু করাচ্ছে। সেই কেউটা কে আমি জানি না। আমাকে দিয়ে কি করতে চাচ্ছে তাও জানি না। দুরকমের জীবনযাপন করতে করতে আমি কিছুটা ক্লান্ত বোধ করছি। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। কোন একটা ব্যাখ্যা, সেই ব্যাখ্যা যত হাস্যকরই হোক আমার জন্যে দরকার। আমি অসুস্থ এই ব্যাখ্যা আমি একসময় মেনে নিয়েছিলাম। তখন জীবনযাত্রা সহজ ছিল। এখন মনে হচ্ছে ঐ ব্যাখ্যায় কিন্তু আছে। তারপরেও আমি সেই ব্যাখ্যা মেনে নেবার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত আমি। এই অনিশ্চয়তা আমার কাছে অসহনীয় মনে হচ্ছে।
সবচে জটিল সমস্যার সমাধান সাধারণত সবচে সহজ হয়ে থাকে। ম্যাজিকে যে ম্যাজিকটা যত কঠিন তার কৌশলটা তত সহজ। পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলিও এ রকম। পদার্থের জটিল সব ধর্মের ব্যাখ্যা খুবই সহজ।
থার্মোডেনমিক্সের দ্বিতীয় সূত্রটির ধরা যাক মহাবিশ্বের বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। মাত্র একটি বাক্যে কত জটিল বিষয়ই-না ব্যাখ্যা করা হল।
আমার ধারণা আমার নিজের ব্যাপারটাও এ রকম। এক লাইনে সব ব্যাখ্যা করা হয়ে যাবে। সেই লাইনটি কেউ কি আমাকে বলে দেবে?
শেফা মেয়েটিকে দেখতে ইচ্ছা করছে। শেফা বলে কি কেউ আছে? হয়ত কেউ নেই। সবই মায়া। অবশ্যি পদার্থবিদ্যার সূত্রে সবই মায়া। পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ পরমাণু। পরামাণু ভাঙলে পাওয়া যাচ্ছে ইলেকট্রন, ট্ৰেন, নিউট্রন। আরো ভাঙা হল এখন পাচ্ছি ল্যাপটনস। আরো ভাঙলাম এখন পাওয়া গেল কোয়ার্ক, আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক। চার্ম…এদের ওজন নেই। অস্তিত্ব আছে আর কিছু নেই।