আজ রাতে তিনি শুনছেন রফিকের কথা। তবে রফিক নিজ থেকে কথা বলতে আসে নি। তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন। দুদিন পর পর সে হুট করে ময়মনসিংহ যায়, ঢাকা যায়, এটা ঠিক না। শেফার মেট্রিক পরীক্ষার বেশি বাকি নাই। এই সময় তার সার্বক্ষণিক থাকা দরকার। মেয়ে যদি মনোযোগী ছাত্রী হত তাহলে কোন কথা ছিল না। মেয়ের পড়াশোনার প্রতি কোন মনোযোগই নাই।
রফিক শুনলাম ময়মনসিংহ গিয়েছিলে ব্যাপার কি?
চশমার দোকানে গিয়েছিলাম।
চোখ খারাপ হয়েছে?
জ্বি না। দুটা লেন্স কিনলাম, আগে একবার গিয়ে অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম, এরা ঢাকা থেকে আনায়ে দিয়েছে।
জিনিসটা কি বললে?
লেন্স। চশমার কাচ।
করবা কি?
একটা টেলিস্কোপ বানাব। দুরবিন। দূরের জিনিস কাছে দেখার যন্ত্র।
দূরের জিনিস কি দেখবা?
তারা দেখা যাবে, চাঁদ দেখা যাবে। খুব কাছে দেখা যাবে।
কাছে দেখা যাবার প্রয়োজনটা কি?
রফিক চুপ করে গেল। ইয়াসিন সাহেব ঘুম-ঘুম গলায় বললেন, বাজে কাজে সময় নষ্ট করবা না। আমি লক্ষ করেছি তুমি বাজে কাজে বেশি সময় নষ্ট কর। সময়ের দাম আছে বুঝলে?
জ্বি চাচা।
টেলিস্কোপ জিনিসটা কিভাবে বানায়?
বুঝয়ে বলব?
যে ভাবেই বল, আমি বুঝব না। তারপরেও বলতে চাইলে বল শুনি।
দুটা লেন্স দিয়ে টেলিস্কোপ বানাতে হয়। একটা হল অবজেকটিভ। চাঁদের আলো এই লেন্সের উপর পড়বে। তার ইমেজ তৈরি হবে লেন্সের ফোকাল লেংথে। সেই ইমেজটা যে জায়গায় পড়বে সেটা হবে দ্বিতীয় লেন্সটার ফোকাল প্লেন। প্রথম লেন্সটার ফোকাল লেংথ হতে হবে বেশি। দ্বিতীয় লেন্সের ফোকাল লেংথ হতে হবে অনেক কম। ব্যাস তৈরি হয়ে গেল টেলিস্কোপ। অবজেকটিভের ফোকাল লেংথ কত বেশি তার উপর নির্ভর করবে জিনিসটা কত কাছে দেখা যাবে। আমি যে টেলিস্কোপটা তৈরি করব সেটা দিয়ে ইনশাল্লাহ। শনিগ্ৰহ দেখা যাবে।
কি দেখা যাবে?
শনিগ্ৰহ। শনির বলয়।
শনিগ্ৰহ দেখা ঠিক না। শনি থেকে যত দূরে থাকা যায় তত ভাল। বুঝলে তো?
জ্বি।
তোমার যন্ত্রটা তৈরি হবে কখন?
যন্ত্র প্রায় তৈরি। কাঠের চোঙের মধ্যে দুটা লেন্স শুধু ফিট করা। আর ঘণ্টা থানিক লাগবে। ধরেন আজ রাত দুটা নাগাদ চাঁদ দেখতে পারব।
আজ পূর্ণিমা না?
জ্বি পূর্ণিমা। টেলিস্কোপটা তৈরি হলে কি চাচা আপনাকে ডাক দিব?
আমাকে ডাকাডাকি করার কোন দরকার নাই। আমার সমস্যা আছে। রাতে একবার ঘুম ভাঙলে আর ঘুম হয় না। ঠিক আছে এখন যাও। আর শোন বাজে কাজে সময় নষ্ট করবা না। চশমার কাচ দুটা যে কিনলা কত দাম পড়ল?
এগারোশ টাকা নিয়েছে।
এগারোশ টাকা একেবারে যে পানির মধ্যে পড়েছে এটা বুঝতে পেরেছ? চাঁদ কাছে এনে দেখার কোন দরকার নাই। কাছে আনলেই যে জিনিস ভাল দেখা যায় তা না। আল্লাহপাক যে জিনিসরে যেখানে রেখেছেন সেখানেই তারে ভাল লাগে। আল্লাহপাক যদি ভাবতেন চাঁদকে কাছে আনলে ভাল দেখা যাবে তাহলে তিনি হাতের কাছে চাঁদ এনে দিতেন। হাত দিয়া চাদরে দেখার ব্যবস্থা করে দিতেন। তিনি কি সেটা দিয়েছেন?
জ্বি না।
আচ্চা যাও। টাকাপয়সা বাজে খরচ করবা না। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। এইটা মনে রাখবা।
জ্বি আচ্ছা।
তোমার ছাত্রী পড়াশোনা কেমন করতেছে?
জ্বি ভাল।
মোটই ভাল না। পড়াশোনার দিকে তার মন নাই। তার মন সাজনে। গতমাসে ঢাকায় যাব সে আমার হাতে কি কি আনতে হবে তার লিস্ট ধরায়ে দিয়েছে। লিস্টে আছে লিপস্টিক, পাউডার এইসব হাবিজাবি। তোমাকে বাড়িতে কি কারণে রেখেছি সেটা মনে রাখবা। মেয়েমানুষ একবার মেট্রিক ফেল করলে আর পাস করতে পারে না। সে যেন এক চাগে পাস করে এটা দেখতে হবে। শুধু চাঁদ দেখলে হবে না। আচ্ছা এখন যাও।
ফজলু পায়ে ইলিবিলি কাটছে। বাইরের আবহাওয়া মনোরম। কার্তিক মাসের শুরু। অতি আরামদায়ক বাতাস বইছে। চারদিকে প্রবল জোছনা। ইয়াসিন সাহেব হাতে হুক্কার নল নিয়ে গভীর তন্দ্ৰায় ডুবে গেলেন। মাঝে মাঝে ঘুম কাটলে তিনি দেখতে পান উঠানে রফিক কাঠের টুকরা, হাতুড়ি, করাত নিয়ে কি যেন করছে। সে পাটি পেতে বসেছে। তার পাশে কাঠের চেয়ার। চেয়ারে ছোট্ট বাক্স। ইয়াসিন সাহেব তার মধ্যে ভাবেন করছে কি? তারপরেই মনে হয় রফিক চাঁদ দেখার যন্ত্র বানাচ্ছে। তিনি খানিকটা বিরক্ত হন। বিরক্তি নিয়েই হুক্কার নলে দুতিনটা টান দেন। তারপর আবারো গভীর তন্দ্ৰায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর হাতুড়ির টুকটাক শব্দে তন্দ্ৰা কাটে, তিনি ভাবেন–চাঁদের আলোতে বসে রফিক করছেটা কি? হাতুড়ি, পেরেক, করাতের ঘষাঘষি। হচ্ছেটা কি?
আমেনা বেগম রাতে শেফার সঙ্গে ঘুমুতে যান। মেয়ে বড় হলে তাকে কখনো একা শুতে দিতে নেই। হয় সে ছোট ভাই-বোনের সঙ্গে ঘুমুবে নয়তো দাদি নানির সঙ্গে ঘুমুবে। এটাই সাধারণ নিয়ম। শেফার কোন ভাইবোেন নেই। দাদি মারা গেছেন। নানি এখানে থাকেন না। কাজেই বাধ্য হয়েই আমেনা বেগমকে মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে হয়। তিনি জানেন কাজটা ঠিক হচ্ছে না। স্ত্রীর কাছে স্বামী প্রথম, স্বামী দ্বিতীয় এবং স্বামী তৃতীয়…তারপর অন্যরা। সেই স্বামীকে একা ফেলে রেখে মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে আসা খুবই অন্যায়। মানুষটার রাতের বেলা কতকিছুর দরকার হতে পারে হয়ত একগ্লাস পানি খাবে, ঘুম আসছে না, মাথার যন্ত্রণা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া দরকার, মশারির ভেতর মশা ঢুকেছে। কানের কাছে পিনপিন করে বিরক্ত করছে। সেই মশা মারা দরকার। তিনি তার কিছুই করতে পারছে না। এটা ভেবে তার খুবই খারাপ লাগে। আবার ঘুমুতে যাবার আগে আগে মেয়ের সঙ্গে গুটুর-গুটুর করে যে অনেক কথা বলেন সেটা তার খুবই ভাল লাগে। তবে ইদানিং মেয়ের কথাবার্তা যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। সে ঘুরেফিরে তার স্যারের কথা বলছে। যে মেয়ে বড় হয়েছে তার মুখে ঘনঘন একজন মানুষের কথা আসা খুবই ভয়ের কথা। তিনি এখনো এই বিষয়ে মেয়েকে কিছু বলছেন না। তবে যে-কোন এক রাতে বলবেন। সেটা আজ রাতেও হতে পারে। না আজ রাতে কিছু বলবেন না। আজ মেয়েটার শরীর ভাল না। জ্বর এসেছে। গা গরম। এটা একটা দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে গেল। মেয়েটার অসুখবিসুখ লেগেই আছে। ঢাকায় নিয়ে গিয়ে কোন ভাল ডাক্তার দেখানো দরকার।