শেফ শান্তগলায় বলল, চমকে উঠলে কেন?
চিনতে পারছিলাম না।
চিনতে পারবে না কেন? আমি তো আগের মতোই আছি। শুধু চুলটা অন্যরকম করে আঁচড়েছি। চুল অন্যরকম করে আঁচড়ানোয় আমাকে ভাল দেখাচ্ছে না?
রেফ্ জবাব দিল না। কোন মানবী এই ধরনের কথা বললে জবাব দেবার ব্যাপারটা আসত। রোবটের এই প্রশ্নের জবাব দেয়া অর্থহীন। তাছাড়া চুল অন্য রকম করে আঁচড়ানোয় শেফকে মোটেই ভাল লাগছে না। বরং আগের চেয়ে খারাপ লাগছে।
ঘুম কেমন হয়েছে?
ভাল।
তুমি যতক্ষণ ঘুমিয়েছিলে আমি তোমার পাশেই ছিলাম। তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
ভাল।
ঘুমের মধ্যে তুমি শেফাকে ডাকছিলে।
রেফ্ বিরক্ত গলায় বলল, এটা তো নতুন কিছু না। এটা আমার পুরনো রোগ। তুমি এই রোগের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু এ রকম ভাব করছ যেন তুমি প্রথম ব্যাপারটা দেখলে।
শেফ বলল, আজ প্রথম লক্ষ করলাম তুমি খুব আবেগ নিয়ে শেফাকে ডাকলে। ব্যাপারটা আমার খুব ভাল লেগেছে। কেন ভাল লেগেছে সেটাও বলি। আমার ধারণা শেফার সঙ্গে আমার কোন যোগসূত্র আছে। শেফাকে যদি তোমার ভাল লাগে তাহলে আমাকেও ভাল লাগবে।
কিছু মনে কোরো না। তোমাকে ভাল লাগছে না। এমরান টি যেমন রোবট পছন্দ করেন না। আমিও করি না।
শেফ বলল, আমার খুবই মন খারাপ লাগছে। তোমাকে কাটা কাটা কিছু কথা বলতে পারলে ভাল লাগত। তা বলব না, কারণ তোমার সঙ্গে আর হয়ত আমার দেখা হবে না।
রেফ্ হাই তুলল, তার ঘুম এখনো পুরোপুরি কাটে নি। দয়া করে আমার সামনে থেকে যাও। আমি আরো কিছুক্ষণ ঘুমুব।
শেফ বলল, তোমার সঙ্গে কেন দেখা হবে না, এটা জিজ্ঞেস কর?
রেফ্ বলল, কেন দেখা হবে না, আমি আন্দাজ করতে পারছি। তোমাকে এমরান টি জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তুমি বড় ধরনের অপরাধ করেছ। তার বিচার হবে। তোমার কপোট্রন নষ্ট করা হবে।
এটা জেনেও তোমার খারাপ লাগছে না? মৃত্যুর মতো ভয়াবহ একটা ব্যাপার ঘটছে তাতেও তোমার কোন কিছুই যাচ্ছে-আসছে না?
রেফ্ বিরক্ত গলায় বলল, তোমার ক্ষেত্রে যা ঘটছে তাকে মৃত্যু বলা যায় না। মৃত্যু পুরোপুরি জৈবিক ব্যাপার। মেশিনের যেমন জন্ম বলে আলাদা কিছু নেই, তেমনই মৃত্যু বলেও কিছু নেই।
শেফ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। আমাদের জন্ম-মৃত্যু না থাকলে কি আর করা যাবে। মাঝে মাঝে মনে হয় জন্ম-মৃত্যু থাকাটা খারাপ না। কেন এ ধরনের কথা মনে হয় বলব?
রে বলল, না। তুমি এখন দয়া করে চলে যাবে। যন্ত্রের সঙ্গে কথা চালাচালি করতে ভাল লাগছে না। আমি ঘুমুব।
এমরান টি আমার সঙ্গে যে-সব কথাবার্তা বলবেন তা কি তুমি শুনতে চাও? শুনতে চাইলে গোপনে ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
শুনতে চাই না। আঁড়ি পেতে কথা শোনা আমার স্বভাবের মধ্যে নেই।
তাহলে বিদায়?
আচ্ছা বিদায়।
শুভ রাত্রি।
হ্যাঁ শুভ রাত্রি।
চলে যাচ্ছি কিন্তু।
যাও।
তুমি চাইলে তোমার মাথায় ইলিবিলি কেটে তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি।
আমি চাচ্ছি না।
রেফ্ লক্ষ করল শেফ চলে যাচ্ছে কিন্তু বারবারই পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। যেন চলে যেতে তার ভয়ংকর খারাপ লাগছে। তার চোখে পানিও দেখা গেল। নতুন ধারার এইসব রোবট মানুষের এত কাছাকাছি যে মাঝেমধ্যেই বুকে ধাক্কার মতো লাগে। মনে হয় এরা বোধহয় রোবট না, মানুষ।
এমরান টির সামনে শেফ বসে আছে। শেফের বাঁদিকে রেলা। এমরান টিকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি এক্ষুণি প্রশ্নপর্ব শুরু করবেন। তাঁর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ভুরু কুঁচকে আছে। রেলা বলল, স্যার আমি কি চলে যাব?
এমরান টি বললেন, না তুমি থাকবে। আমি শেফকে কিছু প্রশ্ন করব, তুমি আমাকে সাহায্য করবে। তুমি নবম ধারার রোবট, তোমার বুদ্ধি নিশ্চয়ই শেফ এর চেয়ে বেশি।
রেলা ক্ষীণ স্বরে বলল, বুদ্ধির ব্যাপারটাই স্যার বিতর্কিত। বুদ্ধির নানান ধারা আছে। এখন পর্যন্ত একশ উনিশটি মূলধারা বের করা হয়েছে…
চুপ। আমাকে জ্ঞান দেবে না। আমি কোন কম্পিউটারের কাছ থেকে জ্ঞান ধার করব না।
শেফ বলল, বই পড়ে যদি আপনি জ্ঞান নিতে পারেন, কম্পিউটারের কাছ থেকে নিতে সমস্যা কোথায়?
এমরান টি বিরক্ত গলায় বললেন, তোমরা তো মনে হচ্ছে মহাজ্ঞানী। তোমরাই বল সমস্যা কোথায়?
রেলা বলল, স্যার কোন বিচিত্র কারণে আপনি একধরনের হীনমন্যতায় ভুগছেন। আপনার ভয় বুদ্ধির খেলায় আপনি কম্পিউটারের কাছে হেরে যাবেন। হয়ত এই কারণেই আপনি কম্পিউটার পছন্দ করেন না।
এমরান টি বললেন, যান্ত্রিক বুদ্ধি এবং মানসিক বুদ্ধির তফাতটার পরীক্ষা হয়ে যাক। আমি একটি বাক্য বলব। তোমরা দুজনই বাক্যটি নিয়ে চিন্তা করে বাক্যটি সম্পর্কে আমার মতামত দেবে। বাক্যটা হচ্ছে–
আমি এখন যা বললাম মিথ্যা বললাম।
শেফের ঠোঁটের কোনায় সামান্য হাসি দেখা গেল। সে হাসি মুছে ফেলে গম্ভীর হয়ে গেল। রেলার মুখের ভাবের কোন পরিবর্তন দেখা গেল না।
এমরান টি বললেন, শেফ এই বাক্যটি সম্পর্কে তোমার মতামত বল।
শেফ বলল, স্যার আপনি কিছু মনে করবেন না। এই হাস্যকর বাক্যটি দিয়ে প্রথম যুগের রোবটদের বিভ্রান্ত করা হত। প্রথম যুগের রোবট সাধারণ মানের কপোট্রন ব্রেইন ব্যবহার করত। সেই ব্রেইন ধরতে পারত না যে এই বাক্যটি নিম্নস্তরের বুদ্ধির মানুষদের একটা সাধারণ খেলা।
খেলাটা কি শুনি?
শেফ বলল, বাক্যটা হল আমি এখন যা বললাম, মিথ্যা বলছিলাম। অর্থাৎ আপনি এখন যা বললেন তা সত্য। কিন্তু তা তো হতে পারে না। কারণ আপনি এখন যা বলছেন তা মিথ্যা। সাধারণ মানের কপোট্রন বেইনে এই লজিকে একটা চক্রের মতো তৈরি হয়। সত্য বলা হচ্ছে, না মিথ্যা বলা হচ্ছে—এই চক্র থেকে তারা বের হতে পারে না।