ইয়াসিন সাহেব বললেন—করেছি। বিশ্বাস করব না কেন? আপনি এত বড় মাওলানা, আপনে তো আর মিথ্যা কথা বলবেন না। আজানের শব্দ শুনে ঘুম ভেঙেছে, এটা শুনে অবাক হয়েছি। কারণ আজান তো দেন আপনি।
আজানের শব্দটাও খোয়াবে শুনেছি।
ও।
যাকে স্বপ্ন দেখেছি তার পরিচয় দিলে আপনে চমকে উঠবেন।
তাহলে পরিচয় না দেওয়াই ভাল। এই বয়সে ঘনঘন চমকানো ভাল না। স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়।
ইয়াসিন সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেল। টাকাপয়সা খরচ করে মসজিদের জন্যে ইমাম রাখা হল। সে চোখের পাতি না ফেলে মিথ্যা কথা বলে। তিনি ধর্মকর্মের জন্যে মসজিদ দেন নাই। মসজিদ দিয়েছেন আগামী ইলেকশনের কথা চিন্তা করে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি দুই পার্টিতে দেন। দরবার শুরু করেছেন। একজন কেউ নমিনেশন দিলেই হল। না দিলে স্বতন্ত্র পাড়াবেন। তার মত ফালতু যে মানুষ তার বিষয়ে স্বপ্নে কথা বলল সফেদ পোশাকের লোক? স্বপ্নে আবার আরও মাখিয়ে দিল? আতরের গন্ধ স্বপ্ন শেষ হবার পরেও যায় নাই। এখনো বুড়ো আঙুলে লেগে আছে। মিথ্যা কথারও তো সীমা থাকা দরকার। একে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় করতে হবে। যার পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া হয় তার প্রতি যদি শ্ৰদ্ধা না থাকে তাহলে নামাজ হবার কথা না।
ইয়াসিন সাহেব মাগরেবের নামাজে দাঁড়া হয়েছেন। তিন রাকাত নামাজ দেখতে দেখতে শেষ হবার কথা। অবস্থা যা দেখা যাচ্ছে—এই মাওলানা কতক্ষণ লাগাবে কে জানে? ইয়াসিন সাহেবের মন এখন বিক্ষিপ্ত। নামাজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন সব কথাবার্তা মনে আসতে শুরু করেছে। যেমনরফিক ময়মনসিংহ গিয়েছে, সে ময়মনসিংহ যাবে জানলে তিনি দুটা ইলিশ মাছ আনার টাকা দিয়ে দিতেন। গ্রাম-গঞ্জের বাজারে ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না। ময়মনসিংহ ছাড়া গতি নেই। এই বছর ইলিশ মাছ খাওয়াই হয় নাই। নতুন সরিষা দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোলের কাছে জগতের কোন খাদ্যই খাদ্য না। বেহেশতের খানা-খাদ্যের মধ্যে পক্ষীর মাংসের কথা উল্লেখ আছে, ইলিশ মাছের ঝোলের কথার উল্লেখ আছে কিনা মাওলানা সাহেবকে জিজ্ঞেস করতে হবে। মাওলানা যে রকম মিথ্যাবাদী লোক না থাকলেও হয়ত বলবে আছে। তাকে খুশি করার জন্যে বলবে।
ইয়াসিন সাহেবের মনে হল নামাজে দাঁড়িয়ে তিনি সোয়াবের পরিবর্তে পাপ করে যাচ্ছেন। যতই সময় যাচ্ছে ততই পাপ বাড়ছে। তিনি আল্লাহপাক বা বেহেশত-দোজখের কথা চিন্তা না করে চিন্তা করছেন অতি তুচ্ছ ইলিশ মাছের কথা। ইয়াসিন সাহেব মাথা থেকে দুষ্ট চিন্তা দূর করার চেষ্টা করলেন–চিন্তাটা আরো খারাপ দিকে চলে গেল। মাথায় ঘুরতে লাগল যাত্রাপার্টির কথা। গ্রামের মানুষজন যাত্রা দেখলে খুশি হয়। এই শীতে যাত্রার আয়োজন করলে দল বেঁধে সবাই যাত্ৰা দেখতে আসবে। তিনিও সবার সঙ্গে যাত্রা দেখবেন। অনেকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হবে। মাঝরাতে চায়ের ব্যবস্থা থাকল। সবাই এককাপ করে চা খেল। কত আর খরচ হবে। লাভ হবে তিন ডাবল। হিন্দু-ভোট হয়ত কিছু পাওয়া যাবে। গতবার ইলেকশনে হেরেছেন হিন্দু-ভোট না পাওয়ার কারণে। মসজিদ দেবার কারণে হিন্দু-ভোট আরো কমে যাবে কিনা কে জানে।
রাতে খেতে বসে ইয়াসিন সাহেব চমৎকৃত হলেন। ইলিশ মাছের ভাজা এবং ঝোল। সাধারণ কোন ঝোল না, সরিষার ঝোল। বাটি থেকেই সরিষার ঝাঁঝ নাকে এসে লাগছে। ইয়াসিন সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন—শেফার মা, ইলিশ মাছ, ব্যাপার কি?
রফিক এনেছে।
নিজ থেকে এনেছে নাকি তুমি আনতে বলেছিলে?
নিজ থেকে এনেছে। একজোড়া মাছ নিয়ে এসেছে।
মাছের দাম দিয়া দিবা।
জ্বি আচ্ছা।
তারে ডাক দাও। কথা বলব। আচ্ছা থাক, এখন না। মাছটা ভাল হয়েছে। ঝাল কিঞ্চিৎ বেশি হয়েছে তার জন্যে স্বাদের কোন কমতি হয় নাই।
আরেক টুকরা মাছ নেন।
ইয়াসিন সাহেব আরেকটা মাছ নিলেন। আলাদা করে পিরিচে ইলিশ মাছের দুটা মাথা রাখা হয়েছে। ইয়াসিন সাহেবের হিসাবে এই জগতে যত সুখাদ্য আছে ইলিশ মাছের মাথা তার মধ্যে একটি। বেশিরভাগ মানুষ এই তথ্য জানে না।
শেফা খেয়েছে?
না।
একটা মাথা শেফার জন্যে রেখে দাও।
আপনে খান। শেফা মাছের মাথা খেতে পারে না।
খাওয়া শিখতে হবে না। সব কিছু শিখতে হয়। খাওয়া শিখতে হয়। না খেলে খাওয়া শিখবে কিভাবে?
আমেনা বেগম বললেন, মেয়েমানুষের অত খাওয়া শিখার দরকার নাই। মেয়েমানুষ যত কম খাওয়া শিখে তত ভাল। কার না কার ঘরে যেতে হয়।
ইয়াসিন সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন-বা-মায়ের সঙ্গে যতদিন আছে ততদিন খাওয়া-খাদ্য যেন ঠিক মত খায় এটা দেখা বাবা-মায়ের কর্তব্য। মেয়েকে ডাক, ইলিশ মাছের মাথাটা আমার সামনে খেতে বল।
সে খাবে না। খাবে না আবার কি? অবশ্যই খাবে। ডাক দাও দেখি।
আমেনা বেগম মেয়েকে রক্ষা করার জন্যে বললেন-পড়তে বসেছে। পড়া থেকে উঠানো ঠিক না। এমিতেই পড়তে চায় না। আর আপনে আমার একটা কথা রাখেন, এই মাথাটাও খান। আমি শেফারে ইলিশ মাছের মাথা এনে খাওয়াব।
ইয়াসিন সাহেব দ্বিতীয় মাথাটাও পাতে উঠিয়ে নিলেন।
খাওয়াদাওয়ার পর পান খাওয়া এবং পান খেতে খেতে হুক্কায় টান দেয়া ইয়াসিন সাহেবের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। এই সময় তার পায়ের কাছে ফজলু বসে থাকে। সে পায়ে ইলিবিলি কেটে দেয়। ইয়াসিন সাহেবের তখন তন্দ্ৰা-তন্দ্রা ভাব হয়। তিনি এই ঘোর ঘোর অবস্থায় তাঁর কাছে দেন-দরবার নিয়ে আসা লোকজনের কথাবার্তা শোনেন। এর একটা ভাল দিক হচ্ছে কারো কোন কথাই মন দিয়ে শুনতে হয় না। মন দিয়ে মানুষের কথা শুনার মত কষ্টকর কিছু এই দুনিয়াতে নেই।