যাকে আপনারা দেখছেন তার নাম রে। সে বিজ্ঞান কাউন্সিল নিয়ন্ত্রিত মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চার বছর ধরেই তার চিকিৎসা চলছে। তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তার চিকিৎসক নিউরো বিশেষজ্ঞ মতামত দেবেন। তিনি তাঁর বক্তব্য দেবেন হলোগ্ৰাম মনিটারের মাধ্যমে। তাকে কোন প্রশ্ন করা যাবে না।
রফিকের ছবি মুছে গেল সেখানে প্রফেসর বার্নকে দেখা গেল। হাসিখুশি একজন বৃদ্ধ। নিজের খাসকামরায় বসে আছেন। হাতে কফির মগ। সামনে প্রচুর অগোছালো ফাইলপত্র। প্রফেসর ব্লেয়ার হাতের মগ নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন
রেকে চার বছর আগে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে বিজ্ঞান কাউন্সিল নিয়ন্ত্রিত স্যানিটোরিয়ামে ভর্তি করা হয়। কাউন্সিলের নির্দেশে আমাকে এই রোগীর প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হয়। রোগী এক বিচিত্র স্নায়ু-বৈকল্যে ভুগছে। এই স্নায়ুবৈকল্যের লক্ষণ হল স্থান-কাল সম্পর্কিত ভ্ৰম। রোগী কখনো ভাবছে সে এখানে আছে আবার কখনো ভাবছে এখানে নয় অন্য কোথাও বাস করছে। সাইকাডেলিক ড্রাগ যেমন LSD গোত্রীয় ড্রাগে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়, তবে সেই অবস্থা স্থায়ী হয় না। রক্তে ড্রাগের মাত্রা কমে গেলে রোগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এই ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। রোগীর অবস্থা অপরিবর্তিত আছে। চিকিৎসায় এই রোগ আরোগ্যের কোন আশা নেই। রোগীর বিষয়ে এরচে বেশি বলার কিছু নেই। এই স্নায়ু-বৈকল্য চিকিৎসায় যে-সব ড্রাগস এবং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে তার পূর্ণ বিবরণ ফাইল নাম্বার MS001-525-PS005 QLPতে দেয়া আছে। যারা আগ্রহী তারা ফাইল দেখতে পারেন।
হলোগ্রামের ছবি মুছে গেল। সিডিসি উঠে দাঁড়াল। সে আবারো শাদা কোটের পকেট থেকে টকটকে লাল রুমাল বের করে ঠোট মুছতে মুছতে বলল, রেফের মানসিক সমস্যার ধরনটা আমি সামান্য ব্যাখ্যা করি। যদিও আমি জানি। ব্যাখ্যার তেমন প্রয়োজন নেই। রেফ নিজে নিশ্চিত নয় তার কোন জগৎটা সত্যি জগৎ। কখনো সে ভাবছে তার এই জগৎটা সত্যি, সে রেফ। যে রোবট তার দেখাশোনা করছে তার নাম শেফ। আবার কখনো ভাবছে সে আসলে রফিক। যে মেয়েটির সঙ্গে তার পরিচয় তার নাম শেফা। আমার যা বলার আমি বললাম। যেহেতু আপনারা কেন প্রশ্ন করছেন না? আমি ধরে নিচ্ছি আপনাদের আর কিছু জানার নেই। কাজেই এখন সিদ্ধান্ত নেবার সময়। আপনারা সিদ্ধান্ত নেবেন এই রোগীর বিষয়ে কি করা হবে। আমরা কি তার চিকিৎসা আরো চালিয়ে যাব? নাকি ধ্বংস করে দেয়া হবে? সিদ্ধান্ত নেবার জন্যে আপনাদের পাঁচ মিনিট সময় দেয়া হল।
পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে হল না, তার আগেই একশজন বিজ্ঞানীদের সবাই বললেন—ধ্বংস করে দেয়া হোক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট দুজন বিপক্ষে রায় দিল। তাদের ভোটাধিকার নেই। তারা হ্যাঁ বা না বলতে পারে তবে ভোটাভুটির মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তাদের হ্যাঁ-না বাতিল হয়ে যায়।
হলঘরের সবুজ আলো নিভে গিয়ে নীল আলো জ্বলে উঠল। অধিবেশন শেষ হয়েছে। বিজ্ঞানীরা উঠতে শুরু করবেন এমন সময় এমরান টি উঠে দাঁড়ালেন। অধিবেশন শেষ হবার পর কিছু ধন্যবাদ-সূচক কথা বলতে হয়। এমরান টি প্রায় যন্ত্রের মতো বললেন–
আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিতে আপনারা সহায়তা করেছেন। কাউন্সিলের নিয়মানুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে।
কাউন্সিল সদস্যদের প্রতিনিধি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমরা কি ধরে নিতে পারি বিশেষ অধিবেশন শেষ হয়েছে?
এমরান টি বললেন, হ্যাঁ ধরে নিতে পারেন। অধিবেশন সমাপ্তির ঘোষণা অবশ্যি আমার কাছ থেকে আসবে না। এই ঘোষণা কাউন্সিলের নিয়মানুযায়ী সিডিসি দেবে। আমি সিডিসিকে অধিবেশন শেষ করার ঘোষণা দেবার জন্যে অনুরোধ করছি।
সিডিসি উঠে দাঁড়াল। পকেট থেকে লাল রুমাল বের করে ঠোট মুছল। সে শান্ত গলায় বলল,
অধিবেশন সমাপ্তি ঘোষণার আগে আমি একটি আপাতত তুচ্ছ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। মহান বিজ্ঞানীদের বুঝিয়ে বলার কোন প্রয়োজন নেই। যে তুচ্ছ বিষয়ও মাঝেমধ্যে অনেক বড় হয়ে দেখা দেয়। উদাহরণ দিয়ে বলি এই পৃথিবীতে এডলফ হিটলার নামের এক ব্যক্তি বহুকাল আগে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু করেছিলেন। মানবজাতির বিরাট একটা অংশ এই যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। অতি তুচ্ছ একটি কারণ ঘটিয়ে এই ভয়ংকর যুদ্ধ বন্ধ করা যেত।
কাউন্সিলের একজন প্রতিনিধি বললেন—তুচ্ছ কারণটা ব্যাখ্যা করুন।
অসংখ্য তুচ্ছ কারণ উল্লেখ করতে পারি। যেমন ধরা যাক যে রাতে হিটলারের বাবা এবং মার সামান্য ঝগড়া হল। হিটলারের পিতা কফি চেয়েছিলেন। সেই কফি ঠাণ্ডা হওয়ায় হিটলার-জনক সামান্য রাগলেন। এবং রাগ নিয়ে ঘুমুতে গেলেন। ধরে নিন এটি হচ্ছে সেই বিশেষ রাত যে রাতে মাতৃগর্ভে হিটলার নামক মানুষটির সৃষ্টিপ্রক্রিয়া শুরু হবে। কফি গঠিত জটিলতায় প্রক্রিয়াটি শুরু হল না। তাহলে দাঁড়াল কি? এককাপ কফি সামান্য ঠাণ্ডা হবার কারণে পুরো মানবজাতি ধ্বংসের মুখোমুখি চলে গেল।
পদার্থবিদ ফেনটাং বিরক্ত গলায় বললেন, সিডিসি আপনি মূল বিষয়ে কথা বলুন।
সিডিসি ঠাণ্ডা গলায় বলল, মহান পদার্থবিদ ফেনটাং আমি মানব প্রজাতির কেউ না। আমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কম্পিউটার। মূল সমস্যা থেকে দূরে সরে যাবার প্রবণতা মানবজাতির ভেতরই দেখা যায়। আমার মধ্যে এই প্রবণতা থাকার কথা নয়। আমি মূল বিষয়েই আছি। আমি বলার চেষ্টা করছি যে আপাতত অতি তুচ্ছ বিষয়ও পরে ভয়ংকর বিষয় হিসেবে দেখা দিতে পারে।