বিশেষ অধিবেশনে কাউন্সিলের সকল সদস্য বিজ্ঞানীদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়। যারা অসুস্থতার কারণে উপস্থিত হতে পারেন না তাদের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে ইন্টারফেসের মাধ্যমে সরাসরি যুক্ত কম্পিউটার অংশগ্রহণ করে। মানুষ-বিজ্ঞানী ছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কম্পিউটারদের দুজন প্রতিনিধি থাকে। তাদের কোন ভোটাধিকার থাকে না। পৃথিবী নিয়ন্ত্রক মূল কম্পিউটার সিডিসি থাকে। সিডিসির ভোটাধিকার আছে। ক্ষমতার দিক দিয়ে এমরান টির পরের স্থানটিই সিডিসির। তবে বিজ্ঞান কাউন্সিলের নেয়া কোন সিদ্ধান্তে ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতা সিডিসির নেই।
অধিবেশন কক্ষে নীল আলো জ্বলছে। নীল আলো মুছে গিয়ে সবুজ আলো জ্বলে উঠলেই অধিবেশন শুরু হবে। নীল আলো হল প্রস্তুতিমূলক আলো। বিজ্ঞানীরা তাদের কাগজপত্র গুছিয়ে নেবেন। আজকের আলোচনার এজেন্ডাগুলি দেখবেন। আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি ভালমত জানার জন্যে সিডিসির সাহায্য চাইবেন।
আজকের আলোচ্য বিষয় একটাই রেফ নামক মানুষটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। বিশেষ অধিবেশন কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সিদ্ধান্ত গ্রহণ-বিষয়ক অধিবেশনে সময় খুব কম লাগে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব সিডিসির উপর দিয়ে দেয়া হয়। মানুষ অতি সাধারণ সিদ্ধান্তও চট করে নিতে পারে না। কম্পিউটার পারে।
এমরান টি তার মাথার সবুজ রুমাল নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি টুপিটা একবার এদিকে পরছেন আরেকবার অন্যদিকে পরছেন।
এমরান টির পাশের চেয়ারে সিডিসি বসে আছে। সিডিসিকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে সে মানব সম্প্রদায়ের কেউ না। গত একশ বছরে রোবট প্রযুক্তির সীমাহীন উন্নতি হয়েছে। সিডিসি দশম ধারার রোবটের মাধ্যমে আলোচনায় অংশ নিচ্ছে।
এল এফ সিরিজের সব রোবটই মানুষের মতো। ম্যাগনেটিক ফিল্ড ডিটেকটর ছাড়া এই সিরিজের রোবটদের মানুষের কাছ থেকে আলাদা করার কোন উপায় নেই। সিডিসি শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। এমরান টির রুমাল নিয়ে বাড়াবাড়ির দৃশ্যটি মাঝেমধ্যে দেখছে। তখনই তার ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে।
এমরান টি বললেন, সিডিসি আমার রুমালের রঙটা মনে হয় তোমার পছন্দ হচ্ছে না। তুমি যতবারই আমাকে দেখছ ততবারই ভুরু কুঁচকাচ্ছ।
সিডিসি বলল, আপনার রুমালের রং চমৎকার। যদিও এই রঙের রুমাল কিশোরীরা ব্যবহার করে, তাতে আমি আমার দিক থেকে কোন সমস্যা দেখি না।
তাহলে তুমি ভুরু কুঁচকাচ্ছ কেন?
অন্য বিজ্ঞানীদের প্রায় সবাই আপনার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকাচ্ছেন। আমি তাদের অনুকরণ করছি। এর বেশি কিছু না।
তুমি অনুকরণ করছ কেন?
বাহ্যিক আচার-আচরণে মানুষকে অনুসরণ করার জন্যে একটি সফটওয়ার আমাদের মধ্যে আছে। মানুষের কাছাকাছি যেতে হলে তাকে অনুকরণ করতেই হবে।
খুব ভাল।
আপনি কি সফটওয়ারটি বিষয়ে জানতে চান?
না—অর্থহীন সফটওয়ার নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। রুমালের রং কি সত্যি তোমার পছন্দ হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে।
অন্যদের পছন্দ হচ্ছে না কেন?
আপনি কি সত্যি জানতে চান? জানতে চাইলে কারণগুলি বলতে পারি তবে আমার মনে হচ্ছে না কারণ জানার ব্যাপারে আপনি আগ্রহী।
তমি ঠিকই বলেছ আমি আগ্রহী না।
সিডিসি গলার স্বর নিচু করে বলল, মহামতি এমরান। আপনি কি কোন অজানা কারণে খুবই দুঃশ্চিন্তাগ্ৰস্ত?
আমি হাসছি, মাথার রুমাল নিয়ে খেলছি। তারপরেও তোমার কেন মনে হল আমি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ?
আপনার হাসি-খুশির মধ্যে মেকি অংশ আছে বলেই বলছি। আপনি হা করে নিশ্বাস নিচ্ছেন। উপস্থিত বিজ্ঞানীদের দিকে একবারও তাকাচ্ছেন না। কারো চোখে চোখ পড়া মাত্রই চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আপনার চোখের পাতা যেভাবে পড়ে, তারচে ত্রিশ ভাগ দ্রুত পড়ছে। আপনার শরীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ড আমি যতটুকু জানি তা থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে আপনি খুবই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত।
টুন করে ঘন্টাধ্বনির মতো শব্দ হল। হলঘরের নীল আরো সবুজ হয়ে গেল। এমরান টি মাথার রুমাল ঠিক করতে করতে বললেন, বিজ্ঞান কাউন্সিলের বিশেষ অধিবেশন শুরু হচ্ছে। এ বছরের দ্বিতীয় বিশেষ অধিবেশন। কাউন্সিলের একশ সদস্যদের সবাই সশরীরে উপস্থিত। এটি আনন্দময় ঘটনা। আমি সিডিসিকে এখন বিশেষ অধিবেশনের কারণ ব্যাখ্যা করতে অনুরোধ করছি।
সিডিসি উঠে দাঁড়াল। সামান্য হাসল। অবিকল মানুষদের মতো নাভাস ভঙ্গিতে কয়েকবার কাশল। শাদা কোটের পকেট থেকে টকটকে লাল রুমাল বের করে ঠোট মুছে তার কথা শুরু করল।
সম্মানিত বিজ্ঞান কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দ। মহামান্য এমরান টি। আজকের বিশেষ অধিবেশনের উপর প্রতিবেদন আমি এক্ষুণি আপনাদের জানাচ্ছি। আপনাদের যে-কোন প্রশ্নের জবাব আমি প্রতিবেদন পেশ করার সময়ই দেব। বিশেষ অধিবেশনের নিয়ম-অনুযায়ী প্রতিবেদন শেষ হবার পাঁচ মিনিটের ভেতর আপনারা আপনাদের সিদ্ধান্ত জানাবেন। এখন আমি শুরু করছি। আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি—আমার ডানপাশে হলোগ্ৰাম মনিটারটির দিকে।
সিডিসির ডানপাশের হলোগ্ৰাম মনিটারে কাজ করা শুরু হল। মনিটারটি একটি ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করল। সেই ছবিতে দেখা গেল রেফকে। সে চাদর গায়ে বিছানায় শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে জানালায় সমুদ্র দেখার চেষ্টা করছে। হলোগ্রামের ছবি যেমন হয়ে থাকে রফিকের ছবিটি সেরকম। বোঝার কোন উপায় নেই যে যা দেখা যাচ্ছে তা ত্রিমাত্ৰিক ছবি। মনে হচ্ছে বাস্তবের মানুষটি এখানে সরাসরি উপস্থিত। তার নিশ্বাস ফেলার শব্দও কানে আসছে।