আমেনা বেগম হারিকেন হাতে ঘরে ঢুকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর তাকালেন রফিকের দিকে। শান্ত গলায় বললেন, রফিক তোমার খুঁজে কে জানি আসছে। বাংলাঘরে বসছে।
রফিক সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। আমেনা বেগম বললেন, তোমার চাচা মাগরেবের ওয়াক্তে তোমার খুঁজ করেছিলেন। তোমাকে নিয়ে নামাজে যাবার ইচ্ছা ছিল। তিনি সামান্য রাগ করেছেন।
রফিক বিড়বিড় করে বলল, শরীরটা ভাল না। শুয়েছিলাম, কখন ঘুমায়ে পড়েহি বুঝতে পারি নাই।
আমেনা বেগম বললেন, যাও দেখে আস কে আসছে।
রফিক ঘর থেকে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমেনা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন-তুই আমার ঘরে আয়।
শেফা বলল, তোমার ঘরে যাব কেন?
কথা আছে।
কথা এইখানে বল। আমি পড়তে বসেছি। পড়া ছেড়ে উঠতে পারব না।
তুই কাঁদছিলি কেন?
ইচ্ছা হয়েছে এই জন্যে কাঁদতেছি।
বাঘবন্দি খেলা আমার সাথে খেলবি না। তুই এমন কোন বড় খেলোয়াড় না। কি হয়েছে বল। এমন কি ঘটনা ঘটেছে যে চোখে পানি।
কিছুই ঘটে নাই।
এমন কিছু কি ঘটেছে যে আমাকে বলা যাবে না? অন্ধকারে এই ছেলে কি গায়ে হাত-টাত দিয়েছে?
না।
বল কোথায় হাত দিয়েছে?
বললাম তো–না।
না-টা এমন চাপা গালায় বলতেছিস কেন?
আমি স্বাভাবিকভাবেই বলেছি। তোমার কাছে মনে হচ্ছে চাপা গলা।
এই মাস্টারের কাছে তুই আর পড়বি না।
আচ্ছা।
তোর বাবাকে বলব তার এই বাড়িতে থাকারও দরকার নাই।
আচ্ছা।
তুই আর কখনো এই ছেলের সামনে পড়বি না।
আচ্ছা।
এখন উঠে আয়। এই মাস্টারের কাছে যখন আর পড়তে হবে না, তখন আর ঘরে থাকার দরকার কি?
শেফা বই-খাতা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। মার সঙ্গে ঘর থেকে বের হতে হতে বলল, মা তোমার প্রতিটি কথাই আমি শুনেছি। এখন আমি তোমাকে একটা কথা বলব। এই কথাটা তোমাকে শুনতে হবে।
আমেনা বেগম ভীত গলায় বললেন, কথাটা কি?
শেফা সহজ ভঙ্গিতে বলল, মা আমি উনাকে বিয়ে করব। তুমি ব্যবস্থা করে দাও। বাবাকে বলে ব্যবস্থা কর।
আমেনা বেগম অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি একটু আগে মেয়েকে বলেছেন—সে কোন বড় খেলোয়াড় না। এখন মনে হচ্ছে এই মেয়ে অনেক বড় খেলোয়াড়। এই মেয়ের সঙ্গে বাঘবন্দি খেলা যাবে না।
শেফা হঠাৎ অতি নাটকীয় এক কাণ্ড করে বসল, হাত থেকে বই-খাতা ফেলে ধপ করে বসে পড়ে মার পা জড়িয়ে ধরল। পায়ের পাতায় মুখ ঘষতে ঘষতে বলল, মা তুমি আমাকে বাঁচাও। উনাকে বিয়ে না করতে পারলে আমি মরে যাব।
রফিকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন জালাল সাহেবের জামাই ফরহাদ খান। ফরহাদ খান একা আসেন নি। তাঁর সঙ্গে তিনজন আছে। একজনের হাতে হারিকেন। অন্য দুজন খালি হাতে থাকলেও তাদের গায়ের চাদরের নিচে কিছু একটা আছে। তারা প্রায়ই চাদরের নিচে হাত দিচ্ছে এবং হাত বের করে আনছে। জালাল খাঁন নিজে কখননা বাডিগার্ড ছাড়া চলাফেরা করেন না। জামাই-এর ক্ষেত্রেও সেই ব্যবস্থা রেখেছেন। অস্ত্রধারী দুইজন বাংলাঘরের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। তারা দুজনই অত্যন্ত ভীত। কারণ তারা শুধু যে ইয়াসিন সাহেবের এলাকায় আছে তা না, তারা ইয়াসিন সাহেবের বাংলাঘরে আছে। বলতে গেলে বাঘের ঘরে বাস।
বাংলাঘরে চেয়ার-টেবিল আছে, একপাশে পাটি পাতা খাটও আছে। রফিক বসে আছে খাটে। ফরহাদ খান একটা চেয়ার টেনে তার মুখোমুখি বসেছেন। ফরহাদ খানের হাতে কিছু কাগজপত্র এবং কলম। ফরহাদ খানের সঙ্গে আসা হারিকেনধারীও ঘরে আছে। সে তার হারিকেন হাতছাড়া করে নি। হারিকেন উঁচু করে ধরেছে যাতে হারিকেনের আলো রফিকের মুখে পড়ে। এই হারিকেন ছাড়াও ঘরে আরো একটা হারিকেন আছে। বাংলাঘরের টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। ফরহাদ খান উঁচু গলায় কথা বলছেন। রফিক নিচু স্বরে জবাব দিচ্ছে বলে ফরহাদ সাহেবকে উত্তর শোনার জন্যে প্রতিবারই ঝুঁকে কাছে আসতে হচ্ছে।
রফিক সাহেব কেমন আছেন? জ্বি ভাল।
আজ আপনার অংক করা দেখলাম। বিস্মিত হয়েছি বললে কম বলা হবে। বিস্মিত হয়েছি আবার নিজের মধ্যে কিছু কনফিউশনও আছে। আমি সেই কনফিউশনগুলি দূর করতে এসেছি। আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব। আপনি কি জবাব দেবেন?
রফিক হ্যাঁ-সূচক ঘাড় কাত করল। ফরহাদ খান বললেন, আমি এই কাগজে এগারোটা সংখ্যা লিখছি, একটু তাকান সংখ্যাটির দিকে।
রফিক তাকাল। কাগজে লেখা—৮৭৯০০৪২১৬৭৩।
ফরহাদ খান কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে বলল, সংখ্যাগুলি কি আপনার মুখস্থ হয়ে গেছে?
রফিক বলল, জ্বি হয়েছে।
এক থেকে নয়ের ভেতরে একটা ডিজিট এখানে নেই। সংখ্যাটা কি?
পাঁচ।
সংখ্যাগুলি উল্টালে কত হবে?
৩৭৬১২৪০০৯৭৮।
এর বর্গমূল কত হবে? মূল সংখ্যাটার। উল্টানোটার না।
এর বর্গমূল ১৯৩৯৩৯ দশমিক ১৬৮২।
ঘনমূল বলতে পারবেন? ঘনমূল জানেন তো?
জ্বি জানি। এর ঘনমূল হল ৩৩৫০ দশমিক ৫০৫৬।
রফিক সাহেব আপনি যে একজন বিস্ময়কর মানুষ তা কি আপনি জানেন?
জ্বি জানি।
আপনার পড়াশোনা কি?
আমি বি.এসসি পাস করেছি।
রেজাল্ট কি ছিল?
ভাল ছিল না। সেকেন্ড ডিভিশান।
এখন করছেন কি?
আমি মূলারদি গার্লস হাইস্কুলে পার্ট টাইম অংক করাই।
আপনার কি কোন ছবি আছে?
পাসপোর্ট সাইজ দুটা ছবি আছে।
আপনি একটা ছবি আমাকে দেবেন, আমি আপনাকে নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখে ভোরের কাগজে দেব।
জ্বি আচ্ছা।
শুরুতে আপনাকে যে সংখ্যাগুলি দিয়েছিলাম সেগুলি কি আপনার মনে আছে?