রফিক বলল, শব্দ কিসের?
বৃষ্টির শব্দ। বৃষ্টি হইতেছে সঙ্গে বাতাস। বৃষ্টি-বাতাস একসঙ্গে হইলে কি হয় জানেন?
না।
শেফা গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, বৃষ্টি-বাতাস একসঙ্গে হইলে চখাচখির বিবাহ হয়–।
বৃষ্টি হয় বাতাস হয় চখাচখির বিবাহ হয়।
রফিক বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, এইসব শ্লোক কি সত্যি আছে, না তুমি বসে বসে বানাও?
শেফা জবাব দিল না। সে তার খাতায় বৃষ্টি-বাতাসের সঙ্গে চখাচখির বিবাহ-সংক্রান্ত শ্লোকটা লিখে ফেলছে। মিল দিয়ে আরেকটা লাইন লিখে ফেলতে হবে। এই লাইনে শ্লোক হয় না। শ্লোকের জন্যে খুব কম করে হলেও দুটা লাইন লাগে। মাঝেমধ্যে তার মাথায় চট করে সুন্দর সুন্দর মিল আসে। মাঝেমধ্যে কিছুই আসে না। আজ আসবে কি না কে জানে। শেফা লিখল—
বৃষ্টি হয় বাতাস হয় চখাচখির বিবাহ হয়,
বড় সুখের এই বিবাহ কোনদিন ভাঙার নয়।
বারান্দায় বালতি পেতে বৃষ্টির পানি ধরা হচ্ছে। সেই পানিতে মুখ ধুয়ে রফিক শেফার সামনের চেয়ারে বসল। শেফা খাতা থেকে মুখ না তুলে বলল, স্যার আপনে যে রূপার মেডেল পেয়েছেন, সেই মেডেলে কি লেখা জানেন?
না, কি লেখা?
খাদিজা খাতুন রৌপ্য-পদক। খাদিজা হলেন আমাদের জালাল সাহেবের মা।
ও।
উনি তাঁর মার নামে, বাবার নামে, তাঁর দাদার নামে অনেক রূপার মেডেল বানায়ে ঘরে রেখে দিয়েছেন। কেউ কিছু করলেই তারে একটা রূপার মেডেল দিয়ে দেন।
তাই নাকি?
একবার তার বাড়িতে ভিক্ষা করতে এক ফকির এসেছে। এই ফকির আবার কান নাড়াতে পারে। চোখ বন্ধ করে সে গরুর মতো নিজের দুই কান নাড়ায়। সেই কান নাড়ানো দেখে জালাল সাহেব তাঁকেও একটা মেডেল দিয়েছেন। খাদিজা খাতুন রৌপ্য-পদক।
রফিক হেসে ফেলল। শেফা গম্ভীর মুখে বলল, আপনাকে হাসানের জন্যে ঘটনাটা বলি নাই। আসলেই দিয়েছেন। এখন সেই ফকির গলায় মেডেল ঝুলায়ে ভিক্ষা করে। সে হয়েছে মেডেল পাওয়া ভিক্ষুক।
শেফার মুখ গম্ভীর। রফিক হাসছে। সে হাসতে হাসতেই বলল—তোমার অদ্ভুত গুণ কি জান শেফা? তোমার অদ্ভুত গুণটা হচ্ছে—তুমি খুবই হাসির কথা মাঝে মাঝে বল কিন্তু একটুও হাস না। তখন তোমাকে রোবট মনে হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট। অষ্টম ধারার রোবট। যার নিজের কোন ইমোশন নেই কিন্তু অন্যের ইমোশন সম্পর্কে সে জানে।
শেফা বলল—এইসব কি হাবিজাবি বলতেছেন?
তোমাকে মনে হয় তুমি শেফা না তুমি আসলে শেফ্। আমি আসলে কি?
শেফ্। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট। তোমার মাথায় ব্রেইনের বদলে আছে কপোট্রন।
শেফা খাতা বন্ধ করে বলল-মাঝে মাঝে আপনে পাগলের মতো কথা বলেন। মাঝে মাঝে আপনাকে পাগল মনে হয়। তোমার কাছে মনে হয় আমি পাগল?
সবসময় মনে হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয়। একদিন দুপুরবেলা আপনি ঘুমাচ্ছেন আমি কি কাজে যেন আপনার ঘরে ঢুকেছি। ও আচ্ছা মনে পড়েছে টেবিলের ওপর অংকের বইটা ফেলে গিয়েছিলাম, সেই বই নিতে গিয়েছি হঠাৎ তাকায়ে দেখি ঘুমের মধ্যে আপনি ছটফট করতেছেন। একবার এপাশ ফিরেন আরেকবার ঐপাশ ফিরেন। আপনার কপালে ঘাম। আপনি বিড়বিড় করে কথাও বলতেছেন।
কি কথা?
কি কথা তা বলতে পারব না। আমি তো আর কথা শুনার জন্যে আপনার কাছে যাই নাই। অংকের বই নেয়ার জন্যে গিয়েছিলাম। বই নিয়ে চলে গিয়েছি।
যে কথা শুনেছিলে তার একটা-দুটা শব্দও কি মনে নাই?
না।
আবার যদি কখনো এরকম দেখ—মন দিয়ে শুনবে। আমি ঘুমের মধ্যে কি বলছি মনে রাখার চেষ্টা করবে।
জি আচ্ছা।
কথাবার্তার এই পর্যায়ে দমকা বাতাস হল। হারিকেন নিভে গেল। শেফা মনে মনে বলল, বাতি নিভেছে বেশ হয়েছে। অন্ধকারই ভাল। এই অন্ধকারে হাত বাড়ালেই মানুষটাকে ছোঁয়া যাবে। মানুষটা ভাবতেও পারবে না এই কাজটা শেফা ইচ্ছা করে করেছে। শেফা এমন কোন খারাপ মেয়ে না যে ইচ্ছা করে পুরুষ মানুষ ছুঁয়ে দেবে। কিন্তু খারাপ মেয়ে হতে ইচ্ছা করছে। শেফার খানিকটা কান্না পেয়ে গেল। তার কি কোন অসুখ করেছে? খারাপ ধরনের কোন অসুখ। যে অসুখে মানুষকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। যে অসুখে কারণ ছাড়াই কান্না পায়। মানুষটা যখন সামনে থাকে তখন কান্না পায়, যখন সামনে থাকে না তখনও কান্না পায়।
শেফা খুবই আশ্চর্য বোধ করছে। ঘরে এতক্ষণ হল বাতি নেই অথচ তার মা ছুটে আসছেন না। জ্বলন্ত হারিকেন নিয়ে তার মার তো ইতিমধ্যেই ছুটে চলে আসার কথা। বিদ্যুৎ চমকাল। শেফা বিদ্যুতের আলোয় দেখল মানুষটা মাথা নিচু করে বসে আছে। মনে হচ্ছে কোন কিছু নিয়ে মানুষটা চিন্তিত। তার এত কিসের চিন্তা? এই পৃথিবীতে চিন্তা করে কিছু হয় না। যা হবার তা চিন্তা করলেও হবে চিন্তা না করলেও হবে। তার কথাই ধরা যাক-না কেন—সে জানে সে মেট্রিক পাস করতে পারবে না। খুব কম করে হলেও তিনটা বিষয়ে ফেল করবে। তার জন্যে সে তো গালে হাত দিয়ে চিন্তা করতে বসে নি। চিন্তা করলে যদি পাস হত তাহলে চিন্তা করত।
আলো হাতে কে যেন আসছে। শেফা ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। অনেকক্ষণ সে অন্ধকারে ছিল এর মধ্যে হাত বাড়িয়ে একটু খুঁয়ে ফেললেই হত। এ রকম কি আর কখনো হবে? আর কখনো কি হারিকেন নিভে যাবে? শেফার কান্না পাচ্ছে। সে দাঁত দিয়ে ঠোট কামড়ে কান্না চাপার চেষ্টা করছে। কান্না এমনই জিনিস যে চাপার চেষ্টা করলে কান্না বেড়ে যায়। শেফা কান্না আটকাতে পারল না। মা হারিকেন নিয়ে এসে যদি দেখেন শেফার চোখে পানি ওমি তিনি দুইএ দুই চার না বানিয়ে বাইশ বানিয়ে ফেলবেন। রাতে ঘুমুবার সময় হেনতেন শতেক প্ৰশ্ন। কাদছিলি কেন? ঘটনা কি?