একটা মানুষ চোখের নিমিষে জটিল সব অংক করে ফেলেছে—এই ব্যাপারটা তাঁকে মোটেও অভিভূত করতে পারে নি। দেশে গাধা-ছাত্র আছে এরা দশ দিনে দশটা অংক করতে পারবে না। পারলেও ভুল করবে। তার বিপরীতে বুদ্ধিমান মানুষও থাকবে যারা অংক দ্রুত করে ফেলবে। তাতে অবাক হবার কি আছে। রফিক অংকগুলি করেছে চোখ খোলা রেখে। তিনি যুবক বয়সে ময়মনসিংহ টাউন হলে একবার ম্যাজিক দেখেছিলেন। সেখানে ম্যাজিশিয়ান চোখ বন্ধ অবস্থায় বোর্ডে লেখা বিরাট অংক করে ফেলল। সেই ম্যাজিশিয়ানের নামও তাঁর মনে আছে প্রফেসর আহাম্মদ আলী।
প্রফেসর আহাম্মদ আলীর কাছে রফিক কিছুই না। রফিককে রূপার মেডেল না দিলেও চলে। তারপরেও দিচ্ছেন কারণ রাজনৈতিক। এলাকার মানুষদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখতে হবে।
মাইক এবং মেডেল দুই-ই চলে এসেছে। জালাল সাহেব লক্ষ করলেন সভার লোকজন চলে যাচ্ছে। তিনি বক্তৃতা শুরু করলে লোকজন যদি আরো যাওয়া শুরু করে তাহলে খুবই খারাপ ব্যাপার হবে। তিনি পরিমল বাবুকে চোখের ইশারায় ডাকলেন। গলা নিচু করে বললেন, লোকজন তো চলে যাচ্ছে।
পরিমল বাবু কিছু বললেন না। জালাল সাহেব চাপা গলায় বললেন, মাইক ফিরত পাঠায়ে দিন। ভাষণ দিব না সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শুধু পুরস্কার বিতরণী হবে। একটা প্রাইজ দিলে হবে না, দুটা প্রাইজ দিতে হবে। ফার্স্ট আর সেকেন্ড। ফার্স্ট প্রাইজ রূপার মেডেল। আর সেকেন্ড প্রাইজ একশ টাকা। সেকেন্ড কে হয়েছে?
সেকেন্ড কেউ হয় নাই।
আপনি হেডমাস্টার। রামছাগলের মতো কথা আপনার মুখে মানায় না। ফাস্ট থাকলেই সেকেন্ড থাকে। বিচারকমণ্ডলীকে জিজ্ঞেস করে জেনে আসুন সেকেন্ড কে? আরেকটা কথা, ভবিষ্যতে এই জাতীয় অনুষ্ঠান করার আগে আমার সঙ্গে পরামর্শ করে নিবেন।
হেডমাস্টার সাহেব বিচারকমণ্ডলীর সঙ্গে কথা বলে ফিরে এসে শুকনো মুখে। জানালেন বিচারকমণ্ডলী বলেছে কেউ সেকেন্ড হয় নাই।
সন্ধ্যা থেকে আকাশ মেঘলা করে বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস দিচ্ছে। বাতাসের বেগ বেশ প্রবল। এই বাতাসের নাম মশা মারা বাতাস। এ রকম দমকা বাতাসে মশার পাখা ছিড়ে যায়। মশা-মারা পড়ে। ঝড়ের সময় দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখলেও মশা-মারা বাতাসে দরজা-জানালা খোলা রাখতে হয়।
রফিকের ঘরের দরজা-জানালা খোলা। সে একটা পাতলা চাদর গায়ে জড়িয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তার টেবিলের উপর হারিকেন। একেকবার বাতাসের ঝাপ্টা আসছে হারিকেনের শিখা দপ করে বেড়ে উঠছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি হারিকেন নিভে গেল। হারিকেনের পাশে বই-খাতা নিয়ে শেফা বসে আছে।
স্যার ঘুমিয়ে আছেন। তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে ইচ্ছা করছে না। বইখাতা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে তার ভাল লাগছে। চাদর দিয়ে স্যারের মুখ ঢাকা। মুখ ঢাকা না থাকলে ভাল হত। মাঝে মাঝে স্যারের মুখের দিকে তাকানো যেত। জাগ্রত মানুষের মুখ দেখতে এক রকম, আর ঘুমন্ত মানুষের মুখ দেখতে। আরেক রকম। মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন তাকে খুব অসহায় লাগে। খুব মায়া লাগে মানুষটার জন্যে। এ বাড়ির কেউ জানে না রফিক স্যার যখন ঘুমিয়ে থাকেন তখন সে মাঝেমধ্যে তাকে এসে দেখে যায়। বেশিরভাগ সময়ই জানালা দিয়ে দেখে। তবে কয়েকবার সে ঘরে ঢুকেও দেখে গেছে। সে জানে কাজটা ঠিক না। নিশিরাতে সে একজনের ঘর থেকে বের হচ্ছে। কি ভয়ংকর কথা!
তবে এ ধরনের কাজ এখন আর করা যাবে না। কারণ কিছুদিন থেকেই তার মা তাকে চোখে চোখে রাখছেন। এই যে সে স্যারের ঘরে বসে আছে, সে নিশ্চিত যে তার মা-ও আশেপাশেই আছেন। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে তার দিকে লক্ষ রাখছেন। সে নিজে যখন মা হবে তখন সেও নিশ্চয়ই এ রকম করবে। নিজের মেয়েকে চোখে চোখে রাখবে।
শেফা খাতা খুলল। সে খুব মন দিয়ে লেখাপড়া করছে এ রকম ভান করা দরকার। খাতায় কিছু লেখা দরকার। অংক করা যায়। কিন্তু অংক করতে ইচ্ছা করছে না। মেট্রিক পরীক্ষায় সে যে কয়টা বিষয়ে ফেল করবে অংক হচ্ছে তার একটা। তার ধারণা, সে খুব কম হলেও তিনটা বিষয়ে ফেল করবে। অংক, ইংরেজি এবং বিজ্ঞান। এই তিনটা বিষয়ের মধ্যে সবচে কম নাম্বার সে পাবে অংকে। যদিও বাড়িতে একজন অংকের জাহাজ আছে। অংকের জাহাজের অংক করতে কাগজ-কলম লাগে না। সে মুখে-মুখে অংক করে। অংকের জাহাজ এই মুহূর্তে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছে। কি আশ্চর্য ব্যাপার সন্ধ্যাবেলা কেউ ঘুমায়?
যথেষ্ট ঘুম হয়েছে। এখন তাকে জাগিয়ে দেয়া দরকার। টেবিলে খুটখাট শব্দ করতে হবে। চেয়ারের পায়া ধরে টানাটানি করতে হবে। ঘুম পাড়াবার জন্যে ঘুমপাড়ানি গান আছে। ঘুম থেকে তোলার জন্যে ঘুমভাঙানি গান থাকলে ভাল হত। দুই লাইন ঘুম ভাঙানি গান গাওয়া হবে, যে ঘুমিয়ে ছিল সে লাফ পিয়ে উঠবে। ফ্যালফ্যাল করে এদিকে-ওদিকে তাকাবে। মেয়েদের ঘুম ভাঙানি গাম আছে। একটা সে নিজেই জানে–
আর কত ঘুমাইবা কন্যা চউখ দুইটা মেল
কান্ধে নিয়া রঙিলা গামছা বন্ধু চইল্যা গেল।
শেফা কেউ শুনতে না পায় এমনভাবেই ফিসফিস করে দুলাইন গাইল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রফিক ধড়মড় করে উঠে বসল। সে ফ্যালফ্যাল করেই তাকাচ্ছে। শেফা থমত খেয়ে বলল, মাগরিবের নামাজ বাদ দিয়া সন্ধ্যাবেলা ঘুম? বাপজান শুনলে খুবই রাগ হবেন।