পুরস্কারের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয় নাই।
আমার তরফ থেকে পুরস্কার। সিলভার মেডেল। একজন কাউকে আমার বাড়িতে পাঠায়ে দেন। অনেক সিলভার মেডেল তৈরি করেই রেখেছি। একটা যেন নিয়ে আসে।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
একটা খেলার আয়োজন করেছেন, কিন্তু ব্যবস্থা অতি দুর্বল। আমি আবার জামাইকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। জামাই-এর সামনে বেইজুতির ব্যবস্থা করবেন। না। সভাপতিকে ফুলের মালা দিতে হয়। সাধারণ নিয়ম। ফুলের মালা কোথায়?
স্যার ব্যবস্থা করছি।
কাগজের মালা যেন না হয়। কাগজের মালা দেয়া হয় কোরবানির গরুর। গলায়। খেলার বিচারক কারা? আমার জামাইকে বিচারকমণ্ডলীর প্রধান করে দিন। সে ফিজিক্সের শিক্ষক। অংকের বিচারক হবার মতো যোগ্যতা আর কারোর নাই। ঠিক বললাম না?
অবশ্যই স্যার।
ইয়াসিন সাহেবকেও দেখি খবর দিয়েছেন। তাকে আবার যেন মঞ্চে ডাকবেন না। ইয়াসিন সাহেবের সঙ্গে আমি এক মঞ্চে বসি না।
উনাকে ডাকব না।
জালাল সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, যেখানে আমাকে বলেছেন সেখানে আপনি কি করে ইয়াসিন সাহেবকে দাওয়াত দেন এটাই তো বুঝলাম না। সাধারণ কমনসেন্সও থাকবে না?
স্যার আমি উনাকে দাওয়াত দেই নাই। উনি নিজ থেকে চলে এসেছেন। রফিক উনার বাড়িতেই থাকে।
আপনার কর্মকাণ্ডে আমি খুবই বিরক্ত হয়েছি। যাই হোক অনুষ্ঠান শুরু করুন।
মাইক আসুক তারপর শুরু করি।
অনুষ্ঠান শুরু করে দিন, মাইক আর মেডেল পরে আসুক। সভাপতির ভাষণের সময় মাইক থাকলেই হবে। অনুষ্ঠানের শেষে দেশাত্ববোধক গানের আসর থাকলে ভাল হত।
পরিমল বাবু মন খারাপ করে অনুষ্ঠান শুরু করলেন। এতসব ঝামেলা হবে। তিনি ভাবেন নি। এদিকে আবার ইয়াসিন সাহেব হাত-ইশারায় তাকে ডাকছেন। তিনি ইশারা না-শোনার ভান করে অনুষ্ঠান শুরু করে দিলেন। পরিমল বাবু নিতান্ত আনিচ্ছার সঙ্গে একটি ছোট্ট বক্তৃতাও দিলেন–
সুধীবৃন্দ আমাদের অংক খেলা শুরু হচ্ছে। কোমলমতি শিশু-কিশোরদের অন্তরে অংক ভীতি দূর করা এবং অংকের প্রতি তাদের আগ্রহ তৈরি করার উদ্দেশ্যেই এই অংক খেলার প্রতিযোগিতা। অত্র অঞ্চলে বিশিষ্ট সমাজসেবী, জনদরদি রাজনীতিবিদ জনাব জালাল উদ্দিন আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতির আসনে বসতে রাজি হয়ে আমাদেরকে ধন্য করেছেন। আপনারা শুনে আনন্দিত হবেন যে অংক প্রতিযোগিতায় বিজয়ীর জন্যে তিনি একটি রৌপ্য-পদক ঘোষণা করেছেন।
আজকের এই প্রতিযোগিতায় তিনজন বিচারক আছেন। বিচারকমণ্ডলীর প্রধান ফরহাদ খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার লেকচারার। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে তিনি সম্পর্কে আমাদের জামাই। তাঁর শ্বশুর হলেন জনাব জালাল উদ্দিন। জনাব ফরহাদ খান যে শত ব্যস্ততার মধ্যে বিচারকের অপ্রিয় দায়িত্ব পালনে রাজি হয়েছেন এতে আমাদের আনন্দের সীমা নাই। আমরা আমাদের অন্তরের অন্তস্তল থেকে তাঁকে জানাচ্ছি মোবারকবাদ।
খেলা শুরুর ঘোষণা দেয়া হলেও অংক খেলা শুরু হতে হতে পাঁচটা বেজে গেল। ফুলের মালার জন্যেই দেরি। গ্রামাঞ্চলে চট করে মালা বানাবার মতো ফুল জোগাড় করা বেশ কঠিন। ঠিক পাঁচটায় দপ্তরি ঘণ্টা বাজাল। ব্ল্যাকবোর্ডর উপর থেকে পর্দা সরানো হল। সব মিলিয়ে দশটি বিরাট অংক। অংকগুলির উত্তর খামবন্ধ অবস্থায় বিচারকদের কাছে দেয়া হল।
হেডমাস্টার পরিমল বাবু বললেন, সাইলেন্স! কেউ কোন শব্দ করবেন। না। এই বলে তিনি চেয়ারে বসতে যাবেন তখন রফিক উঠে দাঁড়াল।
পরিমল বাবু বললেন, কিছু বলবেন?
রফিক বলল, অংকগুলি হয়ে গেছে স্যার। উত্তর কাগজে লেখে দিয়েছি।
পরিমল বাবু হতভম্ব হয়ে বিচারকদের দিকে তাকলেন। দুই মিনিটই পার হয় নি। এর মধ্যেই অংক হয়ে গেছে বলছে এর মানে কি? কোন ফাজলামি না তো?
বিচারকদের কাছে কাগজ দেয়া হল। ফরহাদ খান কাগজ দেখলেন। খামে বন্ধ উত্তর দেখলেন। অবিশ্বাসের চোখে পরিমল বাবুর দিকে তাকালেন। ফিসফিস করে বললেন, ব্যাপারটা কি? কোন ট্রিস কি আছে? উত্তরগুলি কি তিনি আগেই জানেন?
জ্বি না, জানেন না।
কোন ব্রিকস নিশ্চয়ই আছে। আপনি কি নিশ্চত অংকের উত্তরগুলি কেউ তাকে পাস করে নি?
পরিমল বাবু আমতা-আমতা করতে লাগলেন। তিনিও খুবই হকচকিয়ে গিয়েছেন। এখন তাঁর কাছেও মনে হচ্ছে কোন ট্রিকস থাকলে থাকতেও পারে।
ফরহাদ খান বললেন, অংক খেলাটা আরেক বার হোক। এবার একটাই অংক থাকবে। আমি সেই অংক বোর্ডে লিখব। ঘড়ি ধরে থাকব দেখি তিনি মুখে-মুখে সমাধান করতে পারেন কি না। আর যদি পারেন তাহলে কতক্ষণে পারেন।
পুরো বোর্ড জুড়ে বিশাল একটা সরল অংক লেখা হল। সেখানে গুণ, ভাগ, যোগ, বিয়োগ সবই আছে। বোর্ডের উপর থেকে পর্দা সরানো হল। ফরহাদ খান ঘড়ি ধরে থাকলেন। রফিক উত্তর দেবার জন্যে সময় নিল ২১ সেকেন্ড।
বাবু পরিমলচন্দ্ৰ দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। অনুষ্ঠান শুরু হতে-না-হতে শেষ। এখনো মাইক এসে পৌঁছায় নি। দপ্তরি নিমাই মিষ্টি-নিমকি নিয়ে আসে নি। স্কুল মাঠে জড়ো হওয়া লোকজন বুঝতেই পারে নি অংক খেলা শেষ হয়ে গেছে। সভাপতি জালাল আহমেদ খুবই বিরক্ত দুই-তিন মিনিটের একটা অনুষ্ঠানের মানে কি? তাঁকে বক্তৃতা দিতে উঠতে হবে অথচ মাইক এসে পৌছায় নি। তিনি ভেবেছিলেন অংক খেলা চলার সময়ে ভাষণটা মনেমনে ঠিক করে ফেলবেন। শুরু করবেন বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে। ভাষা আন্দোলনের পর মহান মুক্তিযুদ্ধ…সবই এলোমেলো হয়ে গেল, এবং তাঁর পানির পিপাসা পেয়ে গেল। আয়োজকরা এমন গাধা যে টেবিলে একগ্লাস পানি পর্যন্ত রাখেনি। সব রামছাগলের দল। গলায় যে ফুলের মালা দিয়েছে সেখানে কালো পিঁপড়া ছিল। তার একটা তাঁর ঘাড়ে কামড় দিয়েছে। পিপড়াশুদ্ধ ফুলের মালা গলায় দিয়ে দিবে এটা কেমন কথা?