আমাকে কিছু বলবে না?
না।
ঠিক আছে তুমি চলে যাও। আমি কিছুক্ষণ একা একা বারান্দায় হাঁটব। যন্ত্রের সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে না।
আমি যন্ত্র না। আমি অষ্টম ধারার রোবট। অষ্টম ধারার রোবটরা মানুষের খুবই কাছাকাছি। মানুষ এখনো জানে না সে তার কত কাছে। তুমি কি জান যে অষ্টম ধারার রোবট মানুষের প্রেমে পড়তে পারে।
তুমি কি পড়েছ?
প্রেমে পড়ার মত গুণাবলির কাউকে এখনো দেখি নি বলে পড়ি নি। দেখলে হয়ত ঝপ কর প্রেমে পড়ে যাব। তবে তোমার প্রতি আমার খুবই করুণা হচ্ছে। মায়া হচ্ছে। করুণা এবং মায়া থেকেও প্রেম হয়।
ঠিক আছে এখন যাও।
শেফ্ চলে যেতে গিয়েও ফিরে এসে বলল, তোমাকে এতক্ষণ মিথ্যা কথা বললাম। আমার ধারণা আমি তোমার প্রেমে পড়েছি। তুমি যখন অস্থির বোধ কর, আমিও অস্থির বোধ করি। এবং আমার সারাক্ষণই তোমার আশেপাশে থাকতে ইচ্ছা করে। তুমি আমাকে চলে যেতে বলায় আমার খুবই খারাপ লাগছে।
রেফ্ প্রায় চেঁচিয়ে বলল, বিদেয় হও। প্লিজ বিদেয় হও।
সান্দিকোনা স্কুলের হেডমাস্টার
সান্দিকোনা স্কুলের হেডমাস্টার বাবু পরিমল চন্দ্রের মুখে হাসি। তাঁর অংক খেলা যে এত জমে যাবে তিনি ভাবেন নি। প্রথমে ভেবেছিলেন অংক খেলার আয়োজন করা হবে স্কুলের কমনরুমে। সকাল থেকেই মানুষের সমাগম দেখে খেলাটা তিনি স্কুলের মাঠে নিয়ে এসেছেন। তিনটা ব্ল্যাকবোর্ড আনা হয়েছে। প্রতিটি বোর্ডভর্তি অংক। সবই বড় বড় সংখ্যার গুণ, ভাগ। ব্ল্যাকবোর্ডগুলি পর্দা দিয়ে ঢাকা। স্কুলের ঘণ্টা বাজানো হবে তখনই পর্দা সরানো হবে। শুরু হবে অংক খেলা। রফিক অংক করবে মুখে-মুখে, বাকি পাঁচজন করবে ক্যালকুলেটার দিয়ে, দুজন করবে লগ-টেবিল দিয়ে।
অঞ্চলের গণ্যমান্যদের দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। তারা সবাই এসেছেন। সান্দিকোনা থানার ওসি সাহেবও সিভিল ড্রেসে এসেছেন। পোস্ট মাস্টার সাহেব এসেছেন। ব্র্যাক নামের এনজিওর লোকজনও আছেন। তাঁরা অবশ্যি যেখানেই জনসমাগম হয় সেখানেই থাকেন। সান্দিকোনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাহেব এসেছেন। চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে তাঁর বড়মেয়ের জামাই এসেছেন। এই দ্রলোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক। গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছেন। তিনি শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। শ্বশুর সাহেব জামাইকে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখাতে এনেছেন। এই সঙ্গে কিছু মজা যদি পায় তাতেই-বা ক্ষতি কি?
বাবু পরিমল চন্দ্রের মুখ হাসি-হাসি হলেও একটু শংকিত বোধ করছেন। তাঁর শংকার কারণ খেলা ঠিকমত জমবে তো? তিনি শুধু লোকমুখে শুনেছেন রফিক বড় বড় অংক মুখে-মুখে করতে পারে। বাস্তবে এই পরীক্ষা কখনো করা হয় নি। যদি দেখা যায় আজ সে কিছুই পারছে না তাহলে বিরাট অপমান হবে।
বাবু পরিমল চন্দ্রের শংকার আরেকটা কারণ হল অঞ্চলের বিশিষ্টজনরা এসেছেন। তাদের সম্মানে চা-নাশতার ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল। চায়ের ব্যবস্থা হয়েছে, নাশতার আয়োজন এখনো কিছু হয় নি। স্কুলের ইমার্জেন্সি ফান্ড থেকে দুশ টাকা নিয়ে স্কুলের দপ্তরিকে বাজারে পাঠানো হয়েছে নিমকি মিষ্টি আনার জন্যে। এটা নিয়েও পরে নিশ্চয়ই ঝামেলা হবে। স্কুলবোর্ডের সভায় তাঁকে প্রশ্ন করা হবে ইমার্জেন্সি ফান্ডের টাকা অংক খেলার মত ফালতু বিষয়ে তিনি কেন খরচ করলেন? এমনিতেই স্কুল ফান্ডে কোন টাকাপয়সা নেই। যেখানে সামান্য চক কেনার টাকাও নেই সেখানে খেলাধুলার জন্যে দুশ টাকা। মনে হচ্ছে আজ তার খবর আছে।
বিকাল চারটায় খেলা শুরু হবার কথা। চারটার আগেই মাঠ ভর্তি হয়ে গেল। সান্দিকোনা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জালাল সাহেবকে সভাপতির আসনে বসানো হয়েছে। তাঁর ভাবভঙ্গি থেকে বোঝা যাচ্ছে তিনি দীর্ঘ বক্তৃতা দেবেন। দীর্ঘ বক্তৃতা দেবার আগে তাঁর চোখ ঘোলাটে হয়ে যায়। এখনো তাই হয়েছে। তিনি আগে বিএনপি করতেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবার পর আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। বক্তৃতা দেবার সময় পুরনো অভ্যাসে বেফাসে জিয়াউর রহমান সাহেবের কথা হঠাৎ হঠাৎ বলে খুবই বেকায়দায় পড়ে যান। তখন তাঁর বক্তৃতা আরো দীর্ঘ হয়।
হিন্দু মুসলমান হলে যেমন যে-কোন গরু দেখলেই, গরুর পিঠে থাবা দিয়ে জিজ্ঞেস করে—এর গোশত খেতে কেমন হবে? ওনারও সেই অবস্থা হয়েছে। তিনি যে-কোন উপলক্ষেই জ্বালাময়ী আওয়ামী বক্তৃতা দেন। অংক খেলাতেও তিনি এই কাণ্ড করবেন।
জালাল সাহেব হাতের ইশারায় পরিমল বাবুকে ডেকে নিচু গলায় বললেন–শুরু করছেন না কেন?
পরিমল বাবু বললেন, এক্ষুণি শুরু হবে স্যার।
আমার ভাষণটা শুরুতে দিয়ে দেই?
আপনি সভাপতি, আপনি বলবেন সবার শেষে।
শেষে তো লোক থাকবে না। ফাঁকা মাঠে ভাষণ দিয়ে লাভ কি? ভাষণ তো মাঠের জন্যে না, মানুষের জন্যে।
লোক থাকবে। কেউ যাবে না।
মাইকের ব্যবস্থা রাখেন নাই কেন? খালি গলায় ভাষণ ভাল হয় না। সব কিছুরই দস্তর আছে। আগরবাত্তি ছাড়া যেমন মিলাদ হয় না। মাইক ছাড়া ভাষণ হয় না। যান চট করে মাইক আনার ব্যবস্থা করেন।
পরিমল বাবু মাথা চুলকাতে লাগলেন। জালাল মাস্টার বিরক্ত মুখে বললেন নিউ স্টার থেকে মাইক নিয়ে আসেন। খরচ আমি দিব। খেলার শেষে পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে?
জ্বি না।
এটা কেমন কথা? আমার ভাষণের শেষে পুরস্কার বিতরণ।