- বইয়ের নামঃ ওমেগা পয়েন্ট
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
ইয়াসিন সাহেব বারান্দায় অজু করতে এসে দেখেন
ইয়াসিন সাহেব বারান্দায় অজু করতে এসে দেখেন শশা-মাচার নিচে লাল শাড়ি পরা বউ মত কে যেন ঘুরঘুর করছে। শশা-মাচা তো বেড়ানোর জায়গা না। কে ওখানে? শশা তুলছে নাকি? তাই তো, শশাই তো তুলছে। কোঁচড়ভর্তি শশা। সূর্য ডোবার পর ফলবতী গাছের ফল হেঁড়া যায় না—এই সত্যটা কি লাল শাড়ি পরা মেয়েটা জানে না। ইয়াসিন সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। একবার ভাবলেন অজু বন্ধ রেখে এগিয়ে গিয়ে দেখে আসেন ব্যাপারটা কী? কিন্তু এটা ঠিক না। গুরুতর কোন ঘটনা না ঘটলে নামাজ ছেড়ে যেমন ওঠা যায় না, তেমনি অজু ছেড়েও ওঠা যায় না। লাল শাড়ি পরা মেয়ের শশা তোলা কোন গুরুতর ঘটনা না।
তিনি অজু শেষ করে তাঁর ঘরে ঢুকলেন। তাঁর ঘরে পালংকের মাথায় ভাঁজ করা জায়নামাজ থাকে, সেই জায়নামাজ নিয়ে মসজিদে যাবেন। যদিও আজ আলসি লাগছে। মসজিদে না গিয়ে ঘরে নামাজ পড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। সমস্যা হয়েছে মসজিদটা তিনি নিজে দিয়েছেন। পাকা মসজিদ। মুসুল্লিদের অজুর জন্যে চাপকল, একটা সেনিটারি লেট্রিন সবই করা হয়েছে। আজানের মিনার ছাড়া মসজিদের যাবতীয় কাজ শেষ। এই মাসের আট তারিখ থেকে উলা পাস একজন মাওলানাও রাখা হয়েছে। রোজা আসছে খতমে তারাবি পড়ানোর মানুষ দরকার। মাওলানার থাকা-খাওয়া এবং মাসিক পাঁচশ সত্তুর টাকা বেতনও তিনিই দিচ্ছেন। সেই মানুষ যদি নিজের মসজিদে নামাজ না পড়ে তাহলে অন্যরা কেন নামাজ পড়বে?
ইয়াসিন সাহেব জায়নামাজ হাতে নিলেন। বিরক্ত গলায় ডাকলেন, শেফার মা কই? এদিকে শুনে যাও।
আমেনা বেগম স্বামীর গলা শুনে ছুটে এলেন। এ বাড়ির সবাই ইয়াসিন সাহেবকে যমের মত ভয় করে। আমেনা বেগম তার ব্যতিক্ৰম না।
ইয়াসিন সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন শশা-মাচার নিচে কাকে যেন দেখলাম, লাল শাড়ি পরা। মেয়েটা কে?
আমেনা বেগম ফিক করে হেসে ফেলে বললেন, নিজের মেয়েরে চিনেন না? শেফা।
লাল শাড়ি পরেছে কেন? শখ করে পরেছে। এই শাড়ি তো ঢাকা থেকে আপনিই এনে দিয়েছেন।
সন্ধ্যাবেলা শশা তুলতেছে। এটা কেমন কথা? সন্ধ্যাকালে নামাজ আদায় করবে তারপর বই নিয়ে বসবে। মেট্রিক পরীক্ষার দুইমাসও বাকি নাই। আমি মসজিদ থেকে এসে যেন দেখি সে বই নিয়ে বসেছে।
জ্বি আচ্ছা।
তার মাস্টার কই, রফিক? তাকে তো দেখি না। জুম্মাবার ছাড়া কোনদিন তাকে মসজিদেও দেখলাম না। তাকে বলে দিবে আমার বাড়িতে যারা যারা জায়গির থাকে তাদের প্রত্যেকের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে হবে। এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হবে না। তুমি দেখ রফিক ঘরে আছে কিনা। আমি নিজেই আজ তারে সাথে করে মসজিদে নিয়ে যাব।
আমেনা বেগম বললেন, রফিক ঘরে নাই।
গেছে কোথায়?
ময়মনসিংহ গিয়েছে। সন্ধ্যার ট্রেনে চলে আসবে।
ময়মনসিংহ গেল কখন?
আজ সকালে গিয়েছে।
আমি কিছু জানলাম না কেন? শেফার মা শোন আমার এই বাড়িতে যারা থাকে তাদের সবার সব বিষয় আমাকে জানাবে। কোন কিছু গোপন রাখবে না।
নামাজের সময় পার হইয়া যাইতেছে। আপনে মসজিদে যান।
ইয়াসিন সাহেব বিরক্ত মুখে মসজিদের দিকে রওনা হলেন। মসজিদের জন্যে যে মাওলানা রাখা হয়েছে তাকে তার একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না। পছন্দ না হওয়ার প্রধান কারণ মাওলানা নামাজের সময় বেছে বেছে সবচে লম্বা সুরাগুলি বের করে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে খিল ধরে যায় তারপরেও সুরা শেষ হয় না। দোয়ার সময় হাত যে তোলে সেই হাত আর নামায় না দোয়া কিছুক্ষণ চলে উর্দুতে, কিছুক্ষণ আরবিতে তারপর শুরু হয় বাংলায়। বাংলা দোয়ার একপর্যায়ে আমরা বড়ই গুনাহগার আমরা বড়ই গুনাহগার বলতে বলতে হাউমাউ করে কান্নাকাটিও শুরু হয়।
ইয়াসিন সাহেবের ধারণা মাওলানা মিথ্যা কথাও বলেন। চাকরি পাওয়ার চার দিনের দিন মাওলানা তাঁকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কাদো কাদো গলায় বললেন, আজ শেষরাতে ফজরের নামাজের আজানের ঠিক আগে আপনাকে নিয়ে একটা খোয়াব দেখেছি। খোয়াবে দেখলাম আরব দেশের লেবাস পরা একজনকে সফেদ দাড়ি, একটা শাদা চাদর এক পঁাচ দিয়ে পরা। চোখে সুৰ্মা। আমি উনাকে চিনতাম না। উনি আমাকে বললেন—তুমি অতি ভাগ্যবান। তুমি যার আশ্রয়ে আছ সে নেকবান, তাঁর অন্তরে আছে আসল নুরানি। এই নুরানির কারণে সে নিজ খরচায় মসজিদ দিয়েছে। এখন তোমার দায়িত্ব এই মানুষটার পাশে পাশে থাকা। তার দেখভাল করা। মসজিদের দায়িত্ব পালনের চেয়ে এই মানুষটার দেখভাল তোমার জন্যে অতি জরুরি। এই বলে তিনি আমার ডান হাতের বুড়া আঙুলে আতর লাগায়ে দিলেন। তারপরেই আজানের শৰে ঘুম ভেঙে গেল।
ইয়াসিন সাহেব শুকনো গলায় বললেন, ও।
মাওলানা উৎসাহের সঙ্গে বললেন, আল্লাহপাকের কি কুদরতি সেই আতরের গন্ধ এখনো আঙুলে আছে। একটু শুঁকে দেখেন।
ইয়াসিন সাহেব বললেন, এঁকে লাভ নেই। আমার সর্দি গন্ধ পাই না।
খোয়াবটা দেখার পরে বড়ই অবাক হয়েছি।
ইয়াসিন সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন অবাক হওয়ারই কথা। আরব দেশের মানুষকে স্বপ্নে দেখলেন—সে কথা বলতেছে বাংলায়। যাই হোক স্বপ্ন বেশি না দেখা ভাল। স্বপ্ন কম দেখবেন।
আপনে বোধহয় আমার খোয়াবের ব্যাপারটা বিশ্বাস করলেন না।