‘সুরজিৎ দাশগুপ্ত ‘ ‘
‘রাধারমণের প্রতিবেশীর নাম?
‘অবনী সেন।’
‘তার ছেলের নাম?’
‘সাধন সেন৷’
‘রাধারমণের শেষ কথা কী ছিল?
‘আমার নামে…চাবি…চাবি…’
‘গানে একটা সা থেকে তার পরের সা পর্যন্ত কটা সুর থাকে?’
এর মধ্যে ফেলুদা তার কেনা সংগীত প্রবেশিকার প্রথম চ্যাপ্টারটা আমাকে দিয়ে পড়িয়ে নিয়েছে। গান নিয়ে সে কেন এত মেতে উঠেছে জানি না। যাই হোক, আমি লিখলাম—
‘বারোটা।’
‘কী কী?’
‘সাতটা শুদ্ধ, চারটে কোমল, একটা কড়ি।’
‘শুদ্ধ সুর কী কী? কীভাবে লেখে?’
‘স র গম প ধ ন।’
‘কোন-কোনটা কোমল হয়?’
‘র গ ধ ন।’
‘কীভাবে লেখে?
‘ঝ জ্ঞ দ ণ।’
‘আর কড়ি?
’ম৷’
‘কীভাবে লেখে?
‘হ্ম।’
‘এবার দে কাগজটা৷’
দিলাম।
‘এবার বাইরে বৈঠকখানায় গিয়ে বোস। দরজাটা ভেজিয়ে দে। আমি কাজ করব।’
গেলাম বৈঠকখানায়। দরজা ভেজালাম। সোফায় বসলাম। চাঁদের পাহাড় বইটা তিনবার পড়েছি, আবার পড়তে শুরু করলাম।
প্রায় এক ঘণ্টা পরে ফেলুদার ঘরের এক্সটেনশন টেলিফোনে ডায়াল করার আওয়াজ পেলাম। কৌতুহল সামলাতে না পেরে দরজার কাছে গিয়ে কান লাগালাম। ফেলুদার গলা পেলাম, ‘ডাক্তার বোস আছেন, চিন্তামণি বোস?’
ফেলুদা সেই হার্ট স্পেশালিস্টকে ফোন করছে, যাকে মনিবাবু নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর কাকাকে দেখাতে।
ফোনটা কাকে করছে সেটাই জানতে চাইছিলাম, বাকি কথা শোনার দরকার নেই। আমি আবার জায়গায় এসে বসলাম।
দশ মিনিট পরে আবার কটর কটর শব্দ। ডায়ালিং-এর।
উঠে দরজায় গেলাম কান লাগালাম।
‘ইউরেকা প্রেস? কে কথা বলছেন?’
মণিমোহনবাবুর প্রেস। ব্যাস্ – এইটুকুই যথেষ্ট। আমি আবার চাঁদের পাহাড় নিয়ে বসলাম।
চারটের সময় যখন শ্রীনাথ চা আনল, তখনও ফেলুদা ঘর থেকে বেরোল না। শেষে যখন দেয়াল ঘড়িতে দেখি চারটে পঁয়ত্রিশ, আর আমি ভাবছি আমার ওই কটা লেখা নিয়ে ফেলুদা অত কী ভাবছে, ঠিক সেই সময়ে ও দরজা খুলে হাতে একটা আধপোড়া চারমিনার নিয়ে বেরিয়ে এসে চাপা গলায় বলল, ‘মাথা ভোঁ ভোঁ করছে রে তোপসে, একটা বিরাশি বছরের বুড়োর মরার মুখে বলা সামান্য তিনটে কথার মানে নিয়ে এত কেন ভাবতে হল সেটা ভেবে মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। এর জন্যে অবিশ্যি দায়ী আমাদের বাংলা ভাষা…’ .
আমি অবিশ্যি ফেলুদার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে না পেরে ওর দিকে চেয়ে কাঠ হয়ে বসে রইলাম। দেখতে পাচ্ছি ওর মুখের চেহারা বদলে গেছে, আর বুঝতে পারছি যে, যে আবছা আলোটার কথা ও বলছিল সেটা ওর কাছে আর আবছা নেই।
‘সা ধা নি সা নি…সব কটা শুদ্ধ সুর। শুনে কিছু মনে পড়ছে? কোনও মানে বুঝতে পারছিস?’
আমার মাথা আরও গুলিয়ে গেল। ফেলুদা বলল, ‘তোর বুঝতে পারার কথা নয়। পারলে তোতে আর ফেলু মিত্তিরে কোনও তফাত থাকত না।’
ভাগ্যিস তফাতটা আছে ! আমি ফেলুদার স্যাটিলাইটের বেশি আর কিছু হতে চাই না।
ফেলুদা এই প্রথম সিগারেটটা ছাইদানে না ফেলে ক্যারামের স্ট্রাইকার মারার মতো করে জানালা দিয়ে বাইরে রাস্তায় ফেলে দিয়ে বৈঠকখানার টেলিফোনে গিয়ে একটা নম্বর ডায়াল করল। দশ সেকেন্ড পরেই কথা।
‘কে – মিস্টার সমাদ্দার? চলে আসুন – এক্ষুনি – বামুনগাছি যেতে হবে – হ্যাঁ, হয়ে গেছে — সব পরিষ্কার…মেলোকর্ড…হ্যাঁ, মেলোকর্ডই আমাদের রহস্যের চাবিকাঠি।’
তারপর টেলিফোনটা রেখে গভীর গলায় বলল, একটা রিস্ক আছে রে তোপসে, কিন্তু সেটা না নিলেই নয়।’
মণিবাবুর ড্রাইভার গুরুচরণ দেখতে বুড়ো হলেও ভি আই পি রোডে পঁচাশি কিলোমিটার পার আওয়ার স্পিড তুলল। ফেলুদার ভাব দেখে মনে হল হ্যান্ড্রেড-টান্ড্রেড হলে সে আরও খুশি হত। এয়ারপোর্টের পর খানিকটা রাস্তা লোকজনের ভিড়ে স্পিড অনেক কমল, কিন্তু পরের দিকে আবার ষাটে উঠল – যদিও রাস্তা তত চওড়া নয়, আর সন্ধেও হয়ে আসছে।
রাধারমণবাবুর গেটের কাছাকাছি এসে ফেলুদা বলল, ‘পাহারার লোক আসার সময় হয়নি বোধহয় এখনও।’
গেট দিয়ে ঢুকতেই বাগানে দেখলাম বন্দুক হাতে সাধন দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি থেকে নেমে ফেলুদা বলল, ‘কী সাধনবাবু, এই সন্ধের আলোতে কী শিকার হচ্ছে?
সাধন বলল, ‘বাদুড়।’
রাধারমণবাবুর কম্পাউন্ডের ঠিক বাইরে একটা অশ্বখ গাছ থেকে কয়েকটা বাদুড় ঝুলছে সেটা গাড়ি থেকে নেমেই আমার চোখে পড়েছিল।
অনুকূল গাড়ির আওয়াজ পেয়ে তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল; মণিবাৰু তাকে লণ্ঠন জ্বালতে বলে বাড়ির ভিতর ঢুকলেন, আর আমরাও ঢুকলাম তাঁর পিছন পিছন। এইট-টু-নাইন-ওয়ান তালাটা খুলতে খুলতে মণিবাবু বললেন, ‘রহস্যের কীভাবে সমাধান হল সেটা জানতে খুব ইচ্ছে করছে।’ আসলে ফেলুদা সারা রাস্তা কোনও কথা বলেনি, কাজেই মণিবাবুর যা অবস্থা, আমারও তাই।
অন্ধকার ঘরে ঢুকে ফেলুদা তার ভীষণ জোরালো টর্চটা ঘরে পশ্চিমের দেয়ালের নীচের দিকে ফেলল। আমার বুক টিপ টিপ করছে। আলোটা সোজা গিয়ে টেবিলে রাখা মেলোকর্ডের উপর পড়েছে। ঝকঝকে সাদা পদগুলো দেখে মনে হচ্ছে বাজনাটা দাঁত বের করে হাসছে। ফেলুদা টর্চটা সেইভাবেই ধরে রেখে বলল –
‘চাবি। ইংরিজিতে Key, বাংলায় চাবি। এই যে সাদা-কালো পদাগুলো দেখছিস, ওর আর একটা নাম হল চাবি, আর সেই চাবির কথাই—’
চোখের পলকে এমন একটা ব্যাপার ঘটে গেল যেটা ভাবতে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। মণিবাবু হঠাৎ বাঘের মতো লাফিয়ে মেলোকর্ডটাকে তুলে নিয়ে সেটা দিয়ে ফেলুদার মাথায় একটা প্রকাণ্ড বাড়ি মেরে আমাকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে উর্ধ্বশ্বাসে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।