‘অন্ধকারের মধ্যে সে লোককে চিনতে পারনি বোধহয়?’ মণিবাবু প্রশ্ন করলেন।
‘না বাবু। আমি বুড়ো মানুষ, চোখে ভাল দেখি না, আর কাল আবার ছিল অমাবস্যা…’
রাধারমণবাবুর ঘরে গিয়ে দেখলাম জিনিসপত্তর যেমন ছিল তেমনই আছে। কিন্তু তাও ফেলুদার গম্ভীর গলার স্বরে বেশ ঘাবড়ে গেলাম।
‘মণিবাবু, বারাসত থানায় খবর দিতে হবে। এ বাড়িতে আজ রাত থেকে পাহারার বন্দোবস্ত করতে হবে। সে লোক আবার আসতে পারে। আর সুরজিৎ দাশগুপ্ত যদি সঞ্জয় লাহিড়ী নাও হন, তা হলেও তাকে সন্দেহ করতে হবে, কারণ ওই দুটাে যন্ত্রের উপর তার যথেষ্ট লোভ৷ পয়সা দিয়ে কেনা সম্ভব না হলে অন্য উপায়ে ওগুলো হত করার চেষ্টা অস্বাভাবিক নয়। এই সব কালেক্টরদের গোঁ বড় সাংঘাতিক।’
মণিবাবু বললেন, ‘আমি অবনীবাবুর বাড়ি থেকে এক্ষুনি থানায় ফোন করে দিচ্ছি। ও-সির সঙ্গে আমার আলাপ আছে।’
ভদ্রলোক ব্যস্তভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফেলুদা মেলোকর্ডটাকে নিয়ে খাটের ওপর বসে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। দারুণ মজবুত তৈরি, দুপাশের কাঠে সুন্দর কাজ করা। জিনিসটাকে চিত করে আলোতে ধরতে একটা রং চটে যাওয়া লেবেল দেখা গেল। ফেলুদা চোখ কুঁচকে লেখাটা পড়ে বলল, ‘স্পীগলার কোম্পানির তৈরি। মেড ইন জামানি।’
ফেলুদা হরমোনিয়াম বাজাতে জানে না ঠিকই, কিন্তু কাঁচা হাতে একটা একটা করে পর্দা টিপে যখন জনগণমন-র খানিকটা মেলোকর্ডে বাজাল, তখন যন্ত্রটার গুণে সেটা শুনতে বেশ ভালই লাগছিল। তারপর সেটাকে আবার টেবিলের উপর রেখে বলল, ‘একবার ইচ্ছে করে জিনিসটাকে ভেঙে ভেতরে কী আছে দেখি; কিন্তু যদি দেখি কিছু নেই তা হলে বাজনাটার জন্য আপশোস হবে। সুরজিৎ দাশগুপ্ত এক হাজার টাকা অফার করছিল এটার জন্যে।’
অনুকূল এই শরীর নিয়েও সরবত করে এনেছিল, সেটায় চুমুক দেবার সঙ্গে সঙ্গেই মণিমোহনবাবু ফিরে এসে বললেন, ‘থানায় বলে দিয়েছি। দুজন লোক থাকবে সন্ধ্যা থেকে। অবনীবাবু বাড়ি ছিলেন না; সাধনকে নিয়ে কলকাতা গেছেন। ফিরবেন বিকেলে।’
ফেলুদা বলল, ‘রাধারমণবাবুর টাকা লুকিয়ে রাখার ব্যাপারটা আপনি ছাড়া আর কে জানতে পারে?’
মণিবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, ‘আমি নিজে জেনেছি কাকার মৃত্যুর পরে। টাকা যে খোঁজাখুঁজি হচ্ছে সেটা অবিশ্যি অবনীবাবু জানেন, কিন্তু তার অ্যামাউন্টটা কত হতে পারে সেটা জানার কথা নয়। আর সুরজিৎ দাশগুপ্ত যদি আসলে ধরণীধর হয়ে থাকে, তা হলে সে যেদিন কাকার সঙ্গে এসে কথা বলেছিল সেদিন কিছু জেনে থাকতে পারে। আমার তো বিশ্বাস সে কাকার কাছে টাকাই চাইতে এসেছিল। তারপর কাকার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়, তার ফলে…’
মণিবাবু কথাটা শেষ করলেন না।
ফেলুদা তাঁর দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে বলল, তার ফলে আপনার কাকার হার্ট অ্যাটাক হয়। আর সেই অবস্থাতেই ধরণীধর ঘরের মধ্যে টাকার অনুসন্ধান করে। আপনি এই ভাবছেন তো?’
‘হুঁ…কিন্তু আমি এটাও জানি যে সে টাকা খুঁজে পায়নি।’
‘যদি পেত তা হলে সে বাজনা কেনার অজুহাতে আবার ফিরে আসত না – এই তো?’
‘ঠিক তাই। তার ধারণা ওই দুটাে বাজনার একটার মধ্যে টাকাটা রয়েছে।’
‘মেলোকর্ড।’
মণিবাবু ফেলুদার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিলেন।
‘আপনি তাই বলছেন?’
‘আমার মন তাই বলছে,’ ফেলুদা বলল। ‘তবে আমি আন্দাজে টিল মারা পছন্দ করি না। আর আপনার কাকার শেষ কথাগুলোও আমি ভুলতে পারছি না। আপনার শুনতে কোনও ভুল হয়নি তো? উনি “চাবি” কথাটাই বলেছিলেন তো?’
মণিবাবু হঠাৎ কেমন যেন অপ্রতিভ হয়ে পড়লেন। হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, ‘কী জানি মশাই, চাবি বলেই তো মনে হল। অবিশ্যি..এমন হতে পারে যে কাকা আসলে প্রলাপ বকছিলেন। চাবি কথাটার হয়তো কোনও অর্থ নেই।’
কথাটা শুনে আমার মনটা বেশ দমে গিয়েছিল। কিন্তু ফেলুদার মধ্যে দমবার কোনও লক্ষণ দেখলাম না; ও বলল, ‘প্রলাপই হোক আর যাই হোক, এ ঘরে টাকা আছে। আমি যেন সে টাকার গন্ধ পাচ্ছি। চাবিটা আসল কথা নয়। আসল কথা টাকা।’
‘তা হলে আপাতত কী করবেন সেটা ঠিক করুন।’
‘করেছি। আপাতত বাড়ি ফিরব। দিনের বেলা কোনও ভয় নেই। অনুকুলকে বলে দেবেন চোখ রাখতে আর বাইরের কোনও লোককে যেন ঢুকতে না দেওয়া হয়। রাত্রে তো পাহারাই থাকবে। আমি বাড়ি গিয়ে আমার খাতা নিয়ে আমার ঘরে আমার খাটের উপর বালিশে বুক দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে চিন্তা করব। একটা আবছা আলো দেখতে পাচ্ছি, সেটা আরও উজ্জ্বল হওয়া দরকার। তবে একটা কথা, তেমন বুঝলে আজ রাতটা আমি এখানে কাটাতে চাই। আপনার আপত্তি নেই তো?’
‘মোটেই না। আটটা নাগাদ আপনাকে তুলে নিতে পারি।’
‘ভাল কথা – আপনি সংখ্যাতত্ত্বে বিশ্বাস করেন?’
‘সংখ্যাতত্ত্ব?’ মণিমোহন ভাবাচ্যাকা।
ফেলুদা তার একপেশে হাসি হেসে বলল, আপনাদের সবাইয়ের নাম দেখছি পাঁচ অক্ষরের – রাধারমণ, মুরলীধর, ধরণীধর, মণিমোহন – তাই প্রশ্নটা মনে এল।’
সমাদ্দারের চাবি – ৫
‘আগে লেখ— মৃত ব্যক্তির নাম কী ছিল।’
ফেলুদা তার খাটে বসে আছে, আমি তার পাশের চেয়ারে। আমার হাতে সে খাতা পেনসিল ধরিয়ে দিয়েছে। আমি লিখলাম—
‘রাধারমণ সমাদ্দার।’
‘তার নাতির নাম?
‘ধরণীধর সমাদ্দার।’
‘নাতির থিয়েটারি নাম?’
‘সঞ্জয় লাহিড়ী৷’
‘দেরাদুনের বাজনা সংগ্রাহকের নাম?’