মালী এলে ফেলুদা তাকে দিয়ে ঘরের জানালায় রাখা দুটাে ফুলের টব থেকে মাটি বার করিয়ে তাতে কিছু নেই দেখে আবার মাটি ভরিয়ে ফুল সমেত টব জানালায় রাখল।
এর মধ্যে অনুকূল বসবার ঘর থেকে চারটে চেয়ার এনে তার সামনে একটা গোল টেবিল পেতে তার উপর লেবুর সরবত রেখে গেছে। সরবতে চুমুক দিয়ে মণিবাবু বললেন, ‘কিছু বুঝলেন?’
ফেলুদা মাথা নেড়ে বলল, ‘এতগুলো বাজনা এক সঙ্গে না থাকলে এঘরে যে কোনও অবস্থাপন্ন লোক বাস করত সেটা বিশ্বাস করা কঠিন হত।’।
‘সেই তো বলছি’, মণিবাবু বললেন, ‘সাধে কি আপনাকে ডেকেছি! আমি তো একেবারে বোকা বনে গেছি মশাই। ‘
আমি বাজনাগুলোর দিকে দেখছিলাম। তার মধ্যে সেতার সরোদ তানপুরা এসরাজ তবলা বাঁশি—এগুলো আমি চিনি। অন্যগুলো আমি কখনও চোখেই দেখিনি। ফেলুদাও দেখেছে কি না সন্দেহ। সে মণিবাবুকে প্রশ্ন করল, ‘সব কটা বাজনার নাম জানেন? ওই যে দেয়াল থেকে তারের যন্ত্রটা ঝুলছে, ওটার কী নাম?’
মণিবাবু হেসে বললেন, ‘আমি মশাই এক্কেবারে বেসুরে। আমাকে ও সব জিজ্ঞেস করলে কিন্তু ফাঁপরে পড়ব।’
একটা পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে দেখি সেই বন্দুকওয়ালা ছেলেটির সঙ্গে বছর চল্লিশের একজন ফরসা ভদ্রলোক আমাদের ঘরে এসে ঢুকলেন। মণিবাবু আলাপ করিয়ে দিতে জানলাম ইনিই হলেন ফুলের দোকানের মালিক অবনী সেন। ছেলেটির নাম হল সাধন। অবনীবাবু প্রদোষ মিত্তিরের নাম শুনেছেন জেনে ফেলুদা একটা ছোট্ট একপেশে হাসির সঙ্গে একটা গলা খাক্রানি দিল। অবনীবাবু খালি চেয়ারটায় বসে মণিবাবুর দিকে ফিরে বললেন, ‘ভাল কথা, আপনার কাকা কি কাউকে তাঁর কোনও বাজনা বিক্রি করার কথা বলেছিলেন?’
‘কই না তো ! মণিবাবু অবাক।’
‘কাল একটি ভদ্রলোক এসেছিলেন। এখানে কাউকে না পেয়ে আমার বাড়িতে যান। আমি তাঁকে আজ আবার আসতে বলে দিয়েছি। আমি আন্দাজ করেছিলাম আপনি হয়তো আসতে পারেন। ভদ্রলোকের নাম সুরজিৎ দাশগুপ্ত। আপনার কাকার মতোই বাজনা সংগ্রহের বাতিক। রাধারমণবাবুর লেখা একটি চিঠি দেখালেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগেই লেখা ! সেই চিঠি পেয়ে ভদ্রলোক নাকি আগেই একবার দেখা করে গেছেন। আপনাদের চাকরও তাকে দেখেছে বলে বলল৷’
‘আমিও দেখেছি।’
কথাটা বলল সাধন। সে একটা টেবিলের উপর রাখা ছোট্ট হারমেনিয়ামের মতো একটা বাজনার সামনে দাঁড়িয়ে তার পদার উপর আস্তে আস্তে আঙুল টিপে টুং টাং সুর বার করছে।
অবনীবাবু ছেলের কথা শুনে হেসে বললেন, ‘সাধন প্রায় সারাটা দিনই এই বাড়ির আশেপাশেই ঘোরাফেরা করে। দাদুর সঙ্গে তার খুব ভাব ছিল।’
‘দাদুকে কেমন লাগত তোমার?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘মাঝে মাঝে খারাপ।’ সাধন আমাদের দিকে পিছন ফিরেই উত্তরটা দিল।
‘খারাপ কেন?’ ফেলুদা আবার প্রশ্ন করল।
‘খালি খালি সারেগামা গাইতে বলতেন।’
‘আর তুমি গাইতে না?’
‘না। কিন্তু আমি গাইতে পারি।’
‘যত রাজ্যের হিন্দি ফিল্মের গান,’ হেসে বলে উঠলেন অবনীবাবু।
‘দাদু জানতেন তুমি গান গাইতে পারো?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ৷’
‘তার মানে তোমার গান শুনেছিলেন তিনি?’
‘না।’
‘তা হলে কী করে জানলেন?’
‘দাদু বলতেন যার নামে সুর থাকে, তার গলায়ও সুর থাকে।’
কথাটা ঠিক পরিষ্কার হল না, তাই আমরা এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। ফেলুদা বলল, ‘তার মানে?’
‘জানি না।’
‘তোমার দাদুর গান তুমি শুনেছ?’
‘না। বাজনা শুনেছি।’
এই কথাটায় মণিমোহনবাবু যেন বেশ হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, ‘সে কী, সাধনবাবু! তুমি ঠিক বলছ? আমি তো জানি উনি বাজনা বাজানো ছেড়ে দিয়েছিলেন। তোমার সামনে বাজিয়েছেন কখনও?’
‘সামনে না। আমি বাইরে ছিলাম, বাগানে। বন্দুক দিয়ে নরকোল মারছিলাম। উনি তখন বাজালেন৷’
‘অন্য কোনও লোক বাজায়নি তো?’ মণিবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
‘আর কেউ ছিল না।’
ফেলুদা বলল, ‘অনেকক্ষণ ধরে বাজনা শুনলে?’
‘না। বেশিক্ষণ না।’
ফেলুদা এবার মণিমোহনবাবুকে বলল, ‘একবার আপনার অনুকূলকে ডাকুন তো।’
অনুকূল এসে হাত দুটোকে জড়ো করে দরজার মুখে দাঁড়াল। ফেলুদা বলল, ‘তোমার মনিবকে সম্প্রতি কখনও বাজনা বাজাতে শুনেছ?’
অনুকূল ভীষণ কাঁচুমাচু ভাব করে বলল, ‘এজ্ঞে বাবু তো ঘরের ভিতরেই থাকতেন সৰ্ব্বক্ষণ, তা সে কখন কী করতেন না করতেন…’
‘তোমার সামনে বাজনা বাজাননি কখনও?’
‘এজ্ঞে না।’
‘বাজনার আওয়াজ শুনেছ?’
‘এজ্ঞে তা যেন কয়েকবার..তবে কানে তো ভাল শুনি না…’
‘মারা যাবার আগে একজন অপরিচিত লোক ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন কি? যিনি কাল সকালেও এসেছিলেন?’
‘তা এসেছিলেন বটে; এই ঘরে বসেই কথা বললেন।’
‘প্রথম কবে এসেছিলেন মনে আছে?’
‘এজ্ঞে হ্যাঁ। যেদিন তিনি চলে গেলেন সেদিন সকালে৷’
‘যেদিন কাকা মারা গেলেন?’ মণিবাবু চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলেন।
‘এজ্ঞে হ্যাঁ৷’
অনুকূলের চোখে জল এসে গেছে। সে গামছা দিয়ে চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, ‘সে ভদ্দরলোক গেলেন চলে, আর তার কিছু পরেই আমি বাবুর চানের জল গরম করে নিয়ে তেনাকে বলতে গিয়ে দেখি কি তেনার যেন হুশ নেই। কয়েকবার ‘বাবু বাবু’ করে ডেকে যখন সাড়া পেলাম না তখন এনার বাড়িতে গেলাম খবর দিতে অনুকূল অবনীবাবুর দিকে দেখিয়ে দিল। অবনীবাবু বললেন, ‘আমি ব্যাপার দেখেই মণিবাবুকে টেলিফোন করে একজন ডাক্তার নিয়ে আসতে বলি। অবিশ্যি বিশেষ কিছু করার ছিল না।’