এবং এ ছাড়াও আরও কয়েকটা। তার উপরে সংগ্রহের বাতিক ছিল ! ওঁর বাড়িতে বাদ্যযন্ত্রের একটা ছোটখাটো মিউজিয়াম করে ফেলেছিলেন।’
‘কোন বাড়িতে?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।
আমহাস্ট স্ট্রিটে থাকতেই শুরু হয়, তারপর সে সব যন্ত্র বামুনগাছির বাড়িতে নিয়ে যান। যন্ত্রের সন্ধানে ভারতবর্ষের নানান জায়গায় গেছেন। বম্বেতে একবার এক ইটালিয়ান জাহাজির কাছ থেকে একটা বেহালা কেনেন, সেট কলকাতায় এনে কিছুদিনের মধ্যেই বিক্রি করে দেন ত্রিশ হাজার টাকায়।’
ফেলুদা একবার আমাকে বলেছিল ইটালিতে প্রায় তিনশো বছর আগে দু-তিনজন লোক ছিল যাদের তৈরি বেহালার এমন কয়েকটা আশ্চর্য গুণ ছিল যে আজকের দিনে সেগুলোর দাম প্রায় লাখ টাকায় পৌছে গেছে।
সমাদ্দার মশাই বলে চললেন, ‘এই সব গুণের পাশে কাকার একটা মস্ত দোষ ছিল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কৃপণ। এই যে শেষ বয়সে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে দূরে সরে গেলেন, তার একটা প্রধান কারণ হল তাঁর কৃপণতা।’
‘আত্মীয় বলতে আপনি ছাড়া আর কে আছে?’
‘এখন আর বিশেষ কেউ নেই। দূর সম্পর্কের আত্মীয় কিছু এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে আছে। আমার কাকার ছিলেন চার ভাই, দুই বোন। বোনেরা মারা গেছেন। ভাইয়ের মধ্যে কাকাকে নিয়ে তিনজন মারা গেছেন, আর একজন জীবিত কি মৃত জানা নেই। তিনি প্রায় ত্রিশ বছর আগে সংসার ছেড়ে চলে যান। রাধারমণ নিজে বিপত্নীক ছিলেন। একটি ছেলে ছিল, মুরলীধর, তিনিও প্রায় পচিশ বছর হল মারা গেছেন। তাঁর ছেলে ধরণীধর হল কাকার একমাত্র নাতি। ছেলেবেলায় সে কাকার খুবই প্রিয় ছিল। শেষটায় পড়াশুনোয় জলাঞ্জলি দিয়ে যখন নাম বদলে থিয়েটারে ঢুকল, তখন থেকে কাকা আর তার মুখ দেখেননি। এই হল আত্মীয়।’
‘ধরণীধর বেঁচে আছেন?
‘হ্যাঁ। সে এখন থিয়েটার ছেড়ে যাত্রার দলে যোগ দিয়েছে। কাকার মৃত্যুর পর তার খোঁজ করেছিলাম, কিন্তু সে কলকাতায় নেই। দলের সঙ্গে কোনও অজ পাড়াগাঁয়ে ট্যুরে বেরিয়েছে। ওর বেশ নামটাম হয়েছে। গান বাজনাতেও ট্যালেন্ট ছিল, যে কারণে কাকা ওকে ভালবাসতেন।’
মণিমোহনবাবু হঠাৎ যেন খেই হারিয়ে কয়েক সেকেণ্ড চুপ করলেন। তারপর আবার
বলে চললেন—
‘আমার সঙ্গে কাকার যে খুব একটা যোগাযোগ ছিল তা নয়। বড়জোর দুমাসে একবার দেখা হত। ইদানীং আরও কম। আসলে, আমার একটা ছাপাখানা আছে ভবানীপুরে, ইউরেকা প্রেস, তাতে এই গত ক’মাস লোডশেডিং নিয়ে খুব ভুগতে হচ্ছে। কাকার হার্ট অ্যাটাকটা হওয়াতে ওঁর প্রতিবেশী অবনীবাবু আমাকে টেলিফোন করে খবর দেন, আমি তৎক্ষণাৎ চিস্তামণি বোসকে নিয়ে চলে যাই। যখন পৌঁছই তখন জ্ঞান ছিল না। মারা যাবার ঠিক আগে জ্ঞান হয়। আমাকে দেখে মনে হল চিনলেন। দু-একটা ভাঙা ভাঙা কথাও বললেন – ব্যস — তারপরেই শেষ।’
‘কী বললেন?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। সে এখন আর পায়ের উপর পা তুলে নেই; চেয়ারের সামনের দিকে এগিয়ে বসেছে।
‘প্রথমে বললেন – “আমার…নামে”। তারপর কিছুক্ষণ ঠোঁট নড়ছে, কথা নেই। শেষে অনেক কষ্টে দুবার বললেন—”চাবি, চাবি…”’। ব্যস্।’
ফেলুদা ভুরু কুঁচকে চেয়ে রয়েছে মণিমোহনবাবুর দিকে। বলল, ‘কী বলতে চাচ্ছিলেন সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন কি?’
‘প্রথম অংশ শুনে মনে হয় ওঁর নামে যে কৃপণ বলে অপবাদ রটেছিল সেটার বিষয় কিছু বলতে চাইছেন। আমার ধারণা ওঁর মনে একটা অনুশোচনার ভাব জেগেছিল। কিন্তু আসল কথাটা হচ্ছে ওই চাবি৷ কীসের চাবির কথা বলছেন কিছুই বোঝা গেল না। ঘরে একটা থাকত। বাড়িতে ঘর মাত্র তিনটে, আর একটা বাথরুম, সেটা শোবার ঘরের সঙ্গে লাগ। আসবাবপত্র বলতে বিশেষ কিছুই নেই। অন্তত চাবি লাগে এমন জিনিস তো নেই বললেই চলে। দরজায় যে তালা ব্যবহার করতেন, সেটা একরকম জামান তালা, তাতে চাবির দরকার হয় না, নম্বরের কম্বিনেশনে খুলতে হয়।’
‘সিন্দুক আর আলমারিতে কী ছিল?’
‘আলমারির তাকে কিছু জামা কাপড় ছিল, আর দেরাজে কিছু কাগজপত্র। দরকারি কিছুই না। আর সিন্দুক ছিল একেবারে খাঁ খাঁ খালি।’
‘টাকা পয়সা?’
‘নাথিং। নট এ পাইস। টেবিলের দেরাজে কিছু খুচরো পয়সা ছিল, আর বালিশের নীচে একটা বটুয়াতে কিছু দুটাকা পাঁচ টাকার নোট। ব্যস্ ! বটুয়া থেকে নাকি সংসারের জন্য টাকা বার করে দিতেন। অন্তত চাকর অনুকূল তাই বলে।’
‘কিন্তু সেও তো বলছেন সামান্য টাকা। সেটা ফুরিয়ে গেলে অন্য কোথাও থেকে বার করতে হত নিশ্চয়ই।’
‘নিশ্চয়ই।’
‘আপনি কি বলতে চান উনি ব্যাঙ্কে টাকা রাখতেন না?’
মণিমোহনবাবু হেসে বললেন, ‘তাই যদি রাখবেন তা হলে আর সাধারণ মানুষের সঙ্গে তফাতটা হবে কোথায়? এককালে রাখতেন, তবে বছর পচিশেক আগে একটা ব্যাঙ্ক ফেল পড়ায় উনি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। তারপর থেকে আর ব্যাঙ্কের সঙ্গে কোনও সংশ্ৰব রাখেননি। অথচ –’ মণিবাবু গলার স্বর নামিয়ে নিলেন – ‘আমি জানি ওঁর বিস্তর টাকা ছিল। এবং সেটা যে বাড়ি তৈরি করার পরেও ছিল সেটা তাঁর দুপ্রাপ্য বাজনার কালেকশন। দেখলেই বুঝতে পারবেন। তা ছাড়া উনি নিজের পিছনে বেশ ভালই খরচ করতেন। ভাল খেতেন, বাড়িতে ভাল বাগান করেছিলেন, একটা সেকেন্ড হ্যান্ড অস্টিন গাড়িও কিনেছিলেন; মাঝে মাঝে বেরোতেন, শহরে আসতেন। কাজেই…’