আজকাল কেমন যেন ভুলভাল হয়ে যায়। পুরোনো কথার সঙ্গে আজকালের কথা গুলিয়ে ফেলি। তাল থাকে না। বোধ হয় পরশু দিন দুপুরে একটু ঘুমিয়েছি। ঘুম ভাঙল যখন তখন শীতের বেলা ফুরিয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠতে-উঠতে সুদর্শন চাকরের নাম ধরে ডাকছিলাম। মনে হয়েছিল শ্বশুরমশাই কাছারি থেকে ফিরে এলে বড়ঘরের বারান্দায় পুবমুখো। ইজিচেয়ারটায় বসে আছেন, এখনও তাঁকে তামাক দেওয়া হয়নি। সুদর্শনকে ডাক দিয়ে আমি মাথার ঘোমটা ঠিক করে উঠতে যাচ্ছি, শ্বশুরমশাইয়ের পা থেকে জুতো খুলে দেব বলে। ভুল বুঝতে পেরে কেমন যেন অবশ-অবশ লাগল। কতকালকার কথা, সব তবু যেন মনে হয় গতকালের দেখা। সুদর্শন সাতাশ বছর চাকরি করে শ্বশুরবাড়ির কাছারিঘরে মারা গেল। তখন বতুর বয়স বোধ হয় চার কি পাঁচ। সুদর্শনের কাঁধে চড়ে সে অনেক ঘুরেছে। সুদর্শন মরে গেলে বাড়িসুষ্ঠু লোক কেঁদেছিল। সাতাশ বছরে ও আর চাকর ছিল না। যে কথা বলছিলাম, যে ভুল পেয়ে বসেছে আমাকে। বতু মাঝে-মাঝে জিগ্যেস করে, সারাক্ষণ বিড়বিড় করে কী বকো মা? চমকে উঠি। বিড়বিড় করি। হয়তো করি। সারাদিন বড় কথা বলতে ইচ্ছে করে। মাথার মধ্যে ঠাসা সব পুরোনো দিনের কথা। শোনার লোক নেই। তাই বোধ হয় আকাশ বাতাসকে শোনাই। তোরা তো কাছে থেকেও নেই। বতুর চাকরি আর ইউনিয়ন, সারা দিনে কথা দূরে থাক, আমার। দিকে ভালো করে তাকায় না পর্যন্ত। আর মতু! সে আমাকে চেনেই না। সারাদিন নীল চিঠির মধ্যে ডুবে থাকে। কর্তা বলত, ‘তোমার দুটো ঘোড়া, গাড়ি চলবে ভালো।’ গাড়ি বলতে আমাকেই বোঝাত, যেন আমার চলার ক্ষমতা নেই ছেলেরা না চালালে। কাছে তাকে পেলে এখন বলতাম–ঘোড়া দুটো কেমন দু-মুখো ছিটকে গেল দ্যাখো। খাদের মুখে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, একটু জোর বাতাস এলেই গড়িয়ে পড়বে। আর উঠবে না।
মরতে অবশ্য আমার একটুও দুঃখ নেই। কিন্তু মতু-বতুর কথা ভাবলে মরার ইচ্ছেটাই চলে যায়। ওরা দুজন দুরকমের পাগল। আবার ভাবি, ওদের জন্যেই যদি বেঁচে থাকতে হয় তবে তো আরও বহুকাল বেঁচে থাকতে হবে। সে যে বড্ড একঘেয়ে। আবার যদি মরে যাই তবে ওদের দেখবে কে? বিশেষ করে মতুকে! হয়তো ততদিনে বতুর বউ এসে যাবে। কিংবা এমনও তো হতে পারে যে, মতু ভালো হয়ে গেল আবার আগের মতো চাকরি–বাকরি করল। হতে পারে না কেন! এরকম কি হয় না।
সামনের শনিতে একটু বারের পুজো দেব। আর প্রতি বিষ্যৎ বারে একটা বামুন ছেলেকে ডেকে এনে পাঁচালি পড়াব। নিজে কয়েক দিন পড়বার চেষ্টা করেছি। চোখে বড় জল এসে যায়। তিনটে মানসিক করা আছে আমার মতুর জন্য। অনেক দিন হয়ে গেল। মনের ভুলে একটা মানসিক করে রেখেছি ময়মনসিংহের কালীবাড়িতে। কালীর সোনার চোখ গড়ে দেব। এখানে বসেই করেছি সেই মানসিক, এখন ভাবি মতু ভালো হলে কী করে ওখানে পুজো পাঠাব? ওরা কি দেবে আমাকে যেতে? বতুই কি ছাড়বে? কিন্তু বুঝি না, গেলে কী হয়! ওসব তো আমাদেরই দেশ জায়গা ছিল। বতু মতু দুজনেই, জন্মেছে ওখানে। কত যে বালাই তৈরি করছে মানুষ।
বতুর বউ এসে মতুকে দেখবে–এইরকম একটা বিশ্বাস আঁকড়ে আছি। মরার সময় হলে –যদি বতু ততদিনে বিয়ে না করে—
তবে ওই বিশ্বাস নিয়েই আমাকে যেতে হবে। তবু বড় ভয় করে। যদি বতুর বউ তেমন লক্ষ্মীমন্ত না হয়! যদি মায়াদয়া না থাকে তার! মাঝে-মাঝে এসব কথা ভেবে উতলা হয়ে বলে ফেলি। বতু রাগ করে–সমাজ-সংসারের কথা ভাবো মা, কেবল নিজেরটুকু চিন্তা করে করেই গেলে। দ্যাখো না, সমাজের চেহারা এমন পালটে দেব যে, মানুষকে আর নিজের সংসারের কথা ভাবতেই হবে না। তখন সবাইকেই দেখবে সমাজ। বতুটাও একরকমের পাগল। সমাজ কি আমার ঘরে এসে হাড়ির খোঁজ নেবে! কিংবা হয়তো ও ঠিকই বলে। সমাজ-সংসারের আমি কতটুকু দেখেছি? ঘোমটার মধ্যেই তো আদ্দেক বয়স কেটে গেল। যখন সহজভাবে চারদিকে তাকাতে পারলাম তখন চোখে ছানি আসছে। তবু আমি বতুর সমাজের ওপর ভরসা না করে ওর বউয়ের ভরসাই করে আছি। যদি সে মেয়েটার মনে একটু মায়ের ভাব থাকে তবে মতুর জন্য চিন্তা নেই। ওকে বালাই বলে না ভাবলেই হল। ও তো কাউকে জ্বালায় না, চেঁচামেচি করে না। খুব শান্ত থাকে। সারাদিন কেবল চিঠি আর সিগারেট। আমি মাঝে-মাঝে ঘরটা পরিষ্কার করি। চিঠির কাগজ জড়ো করে টেবিলে গুছিয়ে দিই। ওই কাগজগুলো ফেলতে গেলেই ভীষণ রাগ করে মতু। মুখে কিছু বলে না, কিন্তু ‘উঃ’ ‘উঃ’ বলে ওপর দিকে হাত ছুঁড়তে থাকে। তবু জোর করে যদি ফেলি তবে মাথার চুল ছেড়ে, দুমদুম করে দেওয়ালে মাথা ঠুকে কাঁদে। নিজের মাথাটার ওপরেই ওর চিরকালের রোখ। চুল ঘেঁড়া, মাথা ঠোকা সেই ছেলেবেলায় মতোই আবার ফিরে এসেছে। ছেলেবেলায় আমার ওপর রাগ হলে ও মাথা দিয়ে আমাকে ছুঁ মারত। একবার বুকের মাঝখানে ঢু মেরেছিল। এমনিতেই অম্বলের ব্যথা আমার, সেই টু খেয়ে দম বন্ধ হয়ে চোখে কপালে উঠল। এখনও বুকের হাড়ে পাঁজরায় সেই ব্যথা একটুখানি রয়ে গেছে। আর কোনওদিন কি মতু আদর করতে গিয়ে আমার বুকে মুখ গুজবে কিংবা রেগে গিয়ে মারবে টু? না, মতু আর সে মতু তো নেই। তাই বুকের সেই ছোট্ট ব্যথাটুকু আমার চিরকাল থাক। সেই ব্যথাটুকুই মতু হয়ে আমার কাছে আছে।