আমি মশারির ঢাকাটা রুক্ষ হাতে সরিয়ে নিলাম। রোগা একখানা মুখ। চমকে চোখ খুলল। জুলজুল করে ভীত সন্ত্রস্তভাবে আমাকে দেখতে থাকল। মশারির মুঠ ধরে থাকা আমার লোহাকাটা প্রকাণ্ড হাতখানার দিকে তাকিয়েই আমি লজ্জা পেলাম। আবার ঢাকা দিয়ে দিলাম দাদার মুখ। ও তো খুব বেশি কিছু চায় না। কেবল চিঠির কাগজ আর সস্তা সিগারেট। দেখলাম ওর ময়লা ঘেমো গন্ধের গেঞ্জি, গালে না-কামানো দাড়ি, আ-ছাঁটা চুল। বড় যত্নে নেই আমার দাদা মতীন। ঘুম ভেঙে ও এখন সন্দেহের চোখে ভীত মুখে আমাকে দেখছে। না, আমি ওর স্বপ্নের কেউ না। আমি বাস্তব, যার সঙ্গে ওর পাট অনেক দিন চুকে গেছে। আমি তাই আস্তে-আস্তে ও ঘর থেকে এ ঘরে চলে এলাম।
থাক, আমার দাদা মতীন ওরকমই থাক। আমরা যা দেখতে পাই না, ও হয়তো তাই দেখে। বনের পাখিপাখালিরা এসে হয়তো ওর সঙ্গে কথা বলে যায়, হয়তো মায়ারাজ্য থেকে আসে ওর চেনা পরিরা, ওকে ঘিরে আছে স্বপ্নের সব মানুষ। মনে হয় আমার দাদা মতীনের এখন আর কোনও দুঃখ নেই। সেই অচেনা মেয়েটি যদি এসে এখন সামনে দাঁড়ায়, যদি বলে, ‘আমাকে চাও?’ তা সে ওইরকম ভয় পাওয়া চোখে জুলজুল করে চেয়ে দেখবে। চিনবেই না; সেও তো এখন আর দাদার সেই স্বপ্নরাজ্যের কেউ নয়। কী হবে ওকে আর সুখ-দুঃখের বাস্তবের মধ্যে টেনে এনে? তার চেয়ে এই বেশ আছে আমার দাদা মতীন। পাগল মানুষ।
মা
কাল রাতে যেন খুব বৃষ্টি হয়ে গেল। ঘুমের মধ্যেই শুনছিলাম টিনের চালের ওপর খই–ফোঁটার মিষ্টি শব্দ। করমচা গাছের ডালপালায় বাতাস লাগছে। কী বৃষ্টি! কী বৃষ্টি! সেই বৃষ্টির মধ্যে দেখি কর্তা খোলা জানালা বন্ধ করবার চেষ্টা করছে। বৃষ্টির ছাটে ভিজে যাচ্ছে মানুষটা। সেদিকে খেয়াল না করে আমি রাগে দুঃখে মানুষটাকে জিগ্যেস করছি–তুমি বেঁচে থাকতেও আমার বিধবার দশা কেন! সেই শুনে খুব হাসছিল মানুষটি। বেঁচে থাকতে একটা হাড়জ্বালানো শ্লোক বলত প্রায়ই–’সেই বিধবা হলি আমি থাকতে হলি না।’ দেখলাম জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বিড়বিড় করে সেই শ্লোকটাই বলছে। এই দেখতে-না-দেখতেই ঘুম ভেঙে গেল। ওমা, কোথায় বৃষ্টি। আর কোথায়ই বা সেই মানুষ। টিনের চালই বা কোথায়, কোথায়ই বা সেই করমচার গাছ। মরা মানুষের স্বপ্ন দেখা ভালো না। তবু আমি প্রায়ই দেখি। তাঁর মরার পর বারো বছর হয়ে গেল। ধর্মকর্মের দিকে ঝোঁক ছিল খুব। বলত–’যদি জন্মান্তর থাকে–বুঝলে, তবে আমি বতুর ছেলে হয়ে আসব।’ বোধহয় সেইজন্যেই এখনও পৃথিবীতে জন্মায়নি মানুষটা। আত্মাটা আমাদের কাছাকাছি ঘুরঘুর করে। দেখে যায় তাঁর আসার রাস্তা কতদূর তৈরি হল। ঘুম ভেঙে উঠে বসে চুলের জট ছাড়াচ্ছিলাম। কর্তার স্বপ্ন দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওদের তো বাড়িঘর নেই, আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ানো। হয়তো শীতে বৃষ্টিতে বড় কষ্ট পেতে হয়। ওম পাওয়ার জন্য আমাদের কাছে চলে আসেন। ইচ্ছে করে কয়েকজন ব্রাহ্মণ ডেকে ছাতা আর কম্বল দান করি। অনেক টাকার ঝক্কি! মাঝরাতে বসে কত কথা ভাবছিলাম। শুনি বাইরে কাক ডাকছে। রাতে কত ডাকা ভালো নয়। হয়তো জ্যোৎস্না ফুটেছে খুব। তবু বড় বুক কাঁপে। মঙ্গলের কোনও চিহ্ন তো দেখি না। টের পেলাম বতু তার বিছানায় পাশ ফিরল। আগে এক কাতের ঘুম ছিল ওর। ভোরবেলা তুলে দিতে গেলে ময়দার দলার মতো বিছানার সঙ্গে লেগে থাকত। বাচ্চাবেলার মতো খুঁতখুঁত করে বলত–আর একটু মা, আর একটু। ডান কাতের ঘুম হল, এবার বাঁ-কাতে একটু ঘুমোতে দাও। পাঁচ মিনিট। কষ্ট হত তুলতে। তবু চাকরি উন্নতি এসব ভেবে মায়া করতাম না। তুলে দিতাম। যখন চা করে রুটি তরকারি খেতে দিতাম তখনও দেখতাম, ওর দুচোখে রাজ্যের ঘুম লেগে আছে। আর, এখন কয়েক দিন হল রাতে ওর পাশ ফেরার শব্দ পাই। সারা রাত কেবলই পাশ ফেরে। ঘুম হয় না বোধ হয়। ও এখন জামিনে খালাস আছে। পরশু দিনও পুলিশের লোক এসে বলে গেল–ও যেন বাড়িতে থাকে, কোথাও না যায়। কারখানার ব্যাপারটা আমি একটু একটু জানি। বেশি জানতে ভয় করে। তবু একদিন সাহস করে জিগ্যেস করেছিলাম–’তোরা কি জিতবি?’ ও ঠোঁট ওলটাল। বুঝি অবস্থা ভালো নয়। বললাম –কী দরকার ওসব হাঙ্গামা করে! মিটিয়ে ফেল।’ ও শুকনো হেসে একটা কবিতার লাইন বলল –’যে পক্ষের পরাজয় সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে কোরো না আহ্বান…!’ ভালো বুঝলাম না। কারখানা থেকে ওর বন্ধুরা আসে। আমি রান্নাঘরে গিয়ে বসে থাকি, এ ঘরে ওরা মিটিং করে। মাঝে-মাঝে একটু চেঁচামেচি হয়, এ ওকে শাসায়। বুঝি ওদের মধ্যে মিল হচ্ছে না। সবাই এককাট্টা নয়। বতু গোঁয়ার। তবু জানতে ইচ্ছে করে ও এখন কোন দলে। ওর অবস্থাটা কী! আবার ভাবি বাইশ বছর বয়স থেকে সংসার ঘাড়ে নিয়েছে। ও কি আর ওর দায়িত্ব বোঝে না! আমার চেয়ে বরং ভালোই বোঝে। আমি তো মাত্র রান্না করি আর ঘর আগলাই। ওকে কত কষ্ট করতে হয়, হয়তো অপমান সহ্য করে বকাঝকা খায়, শীতে বৃষ্টিতে কতটা পথ পার হয়ে যাতায়াত করে। খুঁটে এনে আমাদের খাওয়ায়। গত আশ্বিনে আঠাশে পা দিল বতু। কারখানায় যখন ঢুকল তখনও দাড়িতে ভালো করে ক্ষুর পড়েনি, কচি মুখখানি। এখন বয়েসকালের। গোটাগুটি মানুষ হয়ে উঠেছে। মতু যদি ঠিক থাকত তবে বতুর বিয়ে দিতাম। এটাই ঠিক বয়স। কর্তাকে আবার আমাদের মধ্যে ফিরিয়ে আনবার রাস্তা তৈরি হয়ে যেত। বতুর ছেলে হলে রোদে বসে তেল মাখাতাম, চুপচুপে করে। ঠাট্টা করে বলতাম, ‘হ্যাঁ রে, সত্যিই কি আর জন্মে তুই আমার ভাতার ছিলি?’ ভাবতেই গায়ে কেমন শিরশির করে কাঁটা দেয়। বতুর ছেলে হয়ে কর্তা যদি সত্যিই আসত তবু নতুন সম্পর্কে কেমন লাগত আমার!