ওই তো এখন বিছানায় মশারি জড়িয়ে শুয়ে আছে আমার দাদা মতীন। পাগল মানুষ। দাদা কিছুই দেখে না, লক্ষও করে না আমাদের। ঘুমিয়ে আছে। তবু তার শিয়রে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাতে কেমন বাধোবাধো লাগে। ভেবে দেখলে আমার সেই দাদা মতীন তো আর নেই। তবু না থেকেও যেন আছে।
সিগারেট ধরিয়ে আমি খোলা জানালার কাছে দাঁড়ালাম। অমনি হি–হি বাতাস নাক গলা চিরে ভিতরে ঢুকে অবশ করে দিল। চোখে জল এসে গেল। শরীরে উত্তেজিত অসুস্থ ভাবটা সামান্য নাড়া খেল। ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আছে, তবু একটুও ঘুম হয় না আজকাল। কারখানা বন্ধ না থাকলে শীতের এই ভোরে সামনের ওই রাস্তাটা দিয়ে আমি কাজে যেতাম। এই ভোরবেলার চারপাশ কী সুন্দর থাকে। ঠিক কতখানি সুন্দর তা বলে বোঝানোই যায় না। একমাত্র এই ভোর রাত্রেই কলকাতাকে নিঃঝুম মনে হয়। অন্ধকারে পাখিরা ডাকাডাকি করে বাসা ছাড়ে না। রাস্তায় পা দিয়ে মনে হয় গ্রামের রাস্তায় চলেছি। বাতাস খুব পরিষ্কার থাকে, জীবাণুশূন্য। একটু অন্ধকার আর একটু কুয়াশা থাকে বলে চারপাশে নানা রহস্যময় ছবি ভেসে ওঠে, চেনা জায়গার গায়ে অচেনার প্রলেপ পড়ে যায়। চারদিকের বাড়িগুলো আবছা আর ঝুপসি গাছের মতো দেখায়। প্রকৃতির সঙ্গে তারা এক হয়ে যায়। দাদার ঘরে একখানা বই আছে, সংবাদপত্রে সেকালের কথা। তাতে পুরোনো কলকাতার দুটো চারটে ছবি আমি দেখেছি। কাঁচা রাস্তা, পুকুর আর গাছগাছালিতে ভরা কলকাতা, শেয়াল ঘুরে বেড়ায়। পুরোনো আমলের গোল গম্বুজ আর থামওয়ালা বাড়ির সামনে ঘোড়ায় টানা ব্রহাম গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, বাঙালিবাবুদের মাথায়। টোপরের মতো টুপি, পায়ে নাগরা, আর পরনে কাবাকুর্তা। ভোর রাত্রের কলকাতা সেই পুরোনো কলকাতা। পুকুর আর গাছগাছালির গ্রাম্য শহর। আমি সেই পুরোনো শহর ধরে হেঁটে যাই কসবা থেকে বালিগঞ্জ স্টেশনের ট্রাম ডিপো পর্যন্ত। ভোরের প্রথম ট্রাম ধরি।
কারখানার মধ্যে বিলিতি শহর। ফুলগাছে আধো-ঢাকা কাঁচের বাড়ি যত্নে লাগানো ঝাউ আর ইউক্যালিপটাসের সারির লন। স্বয়ংক্রিয় লন-মোয়ার বটবট করে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। দয়ালু পাদরির মতো সুন্দর হাসিমাখা মুখে সাহেব ম্যানেজার ডিলান সারা দিন আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। ভাবতেই এখন বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে। আমি মুখ ঘুরিয়ে ঘরের দেওয়াল খুঁজলাম। দাদার ঘরে কোনও ক্যালেন্ডার নেই। না থাক। গতকাল ছিল ষোলো, আজ ধর্মঘটের সতেরো দিন। মনে হচ্ছে আমরা একটা হারা–লড়াই লড়ে যাচ্ছি। প্রবেশন পিরিয়ডে বিশ্বনাথকে ছাঁটাই করা হল। সেটা কোম্পানির ইচ্ছে। শিক্ষানবিশের চাকরির কোনও নিশ্চয়তা থাকে না। বিশ্বনাথের হাতের জব বারবার স্ক্রাপ হয়ে যেত। কোম্পানির দোষ ছিল না। তবু ইউনিয়ন রুখে। দাঁড়াল। তিনদিন ধর্মঘটের পর কোনও বিজ্ঞ লোক এসে বলল –এটা বে-আইনি হচ্ছে। স্ট্রাইক টিকবে না। তোমরা বরং চার্টার অব ডিমান্ড দাও। রাতারাতি চার্টার অব ডিমান্ড তৈরি হল। চোদ্দো দফা দাবি। তবু বোঝা যাচ্ছিল হারা-লড়াই। ট্রাইব্যুনালে চলে গেল দাবিপত্র। কোথাকার কোন আনাড়ি কারিগর বিশ্বনাথের জন্য সুন্দর মনভোলানো বিলিতি শহর থেকে আমি চললুম নির্বাসনে। যেমন নাম-না-জানা অচেনা একটা বড় বাড়ির মেয়ের জন্য আমার দাদা মতীন চিরকালের জন্য হয়ে রইল পাগল মানুষ। কেমন যেন অদ্ভুত যোগাযোগ। বললে অবিশ্বাস্য শোনাবে। তবু এটা সত্য যে, সেই অচেনা মেয়েটার জন্য দাদা পাগল না হলে আমি ইউনিয়নে নামতামই না। সে ছিল বড় বাড়ির মেয়ে, আমার খ্যাপা দাদা মতীন তার কাছাকাছিই যেতে পারল না। বলতেই পারল না, ‘তোমাকে চাই।’ কেবল ঘুরে বেড়াল রাস্তায়–রাস্তায়। তারপর একদিন তার চোখের ওপর দিয়ে চালাক একটি সাহসী ছেলে মেয়েটিকে স্কুটারের পেছনে নিয়ে চলে গেল। কেন এরকম হবে? কেন এরকম দুষ্প্রাপ্য হয়ে থাকবে একটি মেয়ে আমার দাদার কাছে? কেন থাকবে তাদের এরকম দামি বাগানের চারদিকে ওই অত উঁচু ঘেরা–পাঁচিল, যার মধ্যে আমরা কোনওদিনও যেতে পারব না? মেয়ে ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কারও কারও থাকবে স্কুটার, যা কেন আমাদেরও নেই? নিজের ঘরসংসার বজায় রেখে, পাগল ভাই আর বিধবা মায়ের দায় নিয়ে সমাজের সেই অব্যবস্থা আমি কী করে পালটে দেব? তেমন কোনও উপায় আমার ছিল না হাতের কাছে। টিমটিম করে অফিসের ইউনিয়নটা চলছিল তখন। আমার মাত্র একুশ কি বাইশ বছর বয়স। রাগে আক্রোশে ক্ষোভে আমি সেই ইউনিয়নের মধ্যে ফেটে পড়লাম। যদি তা না পড়তাম তবে আজ আমার পিছিয়ে যাওয়ার রাস্তা থাকত। আমি ইউনিয়নের চিহ্নিত কর্মী, দাঙ্গাবাজ, আক্রমণকারী মনোভাবাপন্ন লোক; আমার পিছনে ঘুরছে চার্জসিট আর। তিনটে পুলিশ কেস। ভেবে দেখলে আমার দাদা মতীনের জন্যই আজ আমার এই রাত জাগার ক্লান্তি, অনভ্যাসের সিগারেট আর ভয়। হাইস্কিলড অপারেটরের সুন্দর বেতন থেকে শূন্যতা। কিংবা এই সবের জন্য সেই মেয়েটাই দায়ী, যাকে আমি চিনি না, যাকে চিনত না আমার দাদা মতীনও। তা হোক। তবু সমাজের ব্যবস্থা পালটে যাওয়াই ভালো। আজ বরং আমি একটা হারা লড়াই না-হয় হেরেই গেলাম। মেয়েটিকে ধন্যবাদ।
চিঠির একটা নীল কাগজ সামান্য উড়ে এসে আমার পায়ের গোঁড়ালিতে লাগল। কৌতূহলে তুলে নিলাম। খুদে খুদে অক্ষরে লেখা–’কেউ ঠিকঠাক বেঁচে নেই। পুরোপুরি মরেও যায়নি কেউ। ওরকম কিছু কি হয় কোনওদিন? ঠিকঠাক বেঁচে থাকা, কিংবা পুরোপুরি মরে যাওয়া? …’ আমি আর পড়লাম না। কী যে লেখে পাগল। মাঝে-মাঝে ঠিকানা-না-লেখা খাম আমাকে দিয়ে বলে, ‘ডাকে দিয়ে দিস।’ কখনও নিজেই গিয়ে ডাকবাক্সে ফেলে আসে ভাঁজ করা কাগজ। পিওনেরা হয়তো ফেলে দেয়, কিংবা হয়তো বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পড়ে হাসাহাসি করে। সারা ঘরময় ছড়ানো এই কাগজ আর সিগারেটের টুকরো। পয়সা নষ্ট। হঠাৎ রাগ হয়ে গেল বড়। তোমার জন্যই, তোমার জন্যই এত সব গণ্ডগোল।