সদর খোলা ছিল। সিঁড়িতেও শব্দ হয়নি।
অন্ধকার ঘরের ভিতর একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ায়! প্রশ্ন করে–এ কী, সব অন্ধকার কেন?
চমকে ওঠে বউটি, বুঝতে পারে, মানুষটা ফিরেছে।
–কী হয়েছিল শুনি?
–আর বোলো না, সত্যকে মনে আছে?
–কে সত্য?
–কোন্নগরের। আমার বুজুম ফ্রেন্ড। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে মারা গেল। খবর পেয়ে অফিস থেকেই গিয়েছিলুম। মনটা যে কী খারাপ লাগছে।
বউটি আলো জ্বালে, ঘরদোর আবার হেসে ওঠে! তারা খাওয়াদাওয়া সারে। হাসে গল্প করে।
মানুষটা বারবারই তার মৃত বন্ধুর কথা বলে। বউটি বলে আহা গো।
কিন্তু বউটি তবু সুখীই বোধ করে। কারণ তার মানুষটা ফিরেছে। মানুষটা ফিরেছে। মানুষটা বেঁচে আছে।
অবেলায়
খুব ভোরবেলায় আমি ঘুম থেকে উঠেছিলাম। ঘুম থেকে ওঠা বলতে যা বোঝায় ঠিক তা নয় অবশ্য। আসলে রাতে আমার সত্যিকারের ঘুম একটুও হয়নি। একটু-একটু তন্দ্রা এসেছিল হয়তো বা, আর সঙ্গে-সঙ্গে অস্বস্তিকর সব স্বপ্ন। পাগলাটে, অযৌক্তিক সব স্বপ্ন। ভয় পেয়ে বার বার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। বিরক্ত হয়ে বিছানা ছাড়লাম। ঘড়িতে দেখি সোয়া পাঁচটা প্রায়। শীতকাল বলে আলো ফোটেনি। পাছে মায়ের ঘুম ভেঙে যায় সেই ভয়ে নিঃসাড়ে উঠে কলঘরে গিয়ে চোখে জল দিয়ে এলাম। না ঘুমোনো চোখ কর–কর করে উঠল। স্নায়ু শিরা সব উত্তেজিত হয়ে আছে, মাথার মধ্যে এলোমেলো অস্থির চিন্তা। আমি পাথরের মতো ঠান্ডা বাসি জল ঘাড় মাথার তালু কনুই আর পায়ে ঘষে থাবড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। হাড়ের ভিতরে চলে গেল শীতের ভাব তবু একটুও সতেজ লাগল না নিজেকে।
ভোর রাতের দিকেই মার একটু ঘুম হয়। সকালের দিকে আমার ডিউটি থাকলে আমি মার সেই সামান্য ঘুমটুকুও কেড়ে নিই। অত সকালে বিশেষত শীতকালে বড় কষ্ট হয় মার। খদ্দরের একটা পুরোনো খাটো চাদর জড়িয়ে জড়সড়ো হয়ে মা যখন আমাকে চা করে বাসি রুটি তরকারি সাজিয়ে দিতে থাকে, তখন প্রায়ই মনে হয়, মাকে সারাজীবন বড় কষ্ট দিলাম। মার গলায় কিছু একটা অসুখ আছে, সকালে সারাক্ষণ মা কাশতে থাকে। শুকনো কাশি, কিন্তু সেই শব্দে আমার বুকের ভিতরটা কেমন গুলিয়ে ওঠে। মনে হয় আমারও ওইরকম কাশি শুরু হয়ে যাবে।
আজ মাকে আমি ঘুমোতে দিলাম। জানালাটা খুলে দিয়ে একটু বাইরের বাতাসে শ্বাস টানতে ইচ্ছে করছিল। ঘরের মধ্যে কেমন একটা ভেজা চুলের গন্ধ, পুরোনো কাপড়-চোপড়ের গন্ধ। স্যাঁতসেঁতে ঘর, অস্বাস্থ্যকর। ইচ্ছে করলেও জানালা খু লোম না। মায়ের কাশিটার কথা মনে পড়ল। গতকাল রাতে এক প্যাকেট সিগারেট কেনা ছিল। তোশকের তলায় লুকিয়ে রেখেছিলাম। বের করে দেখি প্যাকেটটা চেপটে গেছে। কোনওদিনই অভ্যাস ছিল না, কিন্তু কয়েক দিন খাচ্ছি সিগারেট। খুব যে কিছু হয় খেলে তা বুঝি না। অন্তত মন বা শরীরের কোনও পরিবর্তন টের পাই না, গলাটা কেবল খুশখুশ করে, আর ধোঁয়া লেগে চোখে জল আসে। তবু সিগারেট ধরালে নতুন খেলনার মতো একটা কিছু নিয়ে খানিকটা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়।
পাশের ঘরে যাওয়ার দরজাটা খোলা। ঘরটা আমার দাদা মতীনের। পাগল মানুষ। ঘরটায় আমার আজকাল আর ঢাকাই হয় না। আমি আর মা ঘরটা দাদাকে পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছি। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখি দাদার মাথার কাছে জানালাটা খোলা। সারা রাত ধরে হিম এসে ঘরটাকে ঠান্ডা করে রেখেছে। মেঝেয় অনেক সিগারেটের টুকরো। আমার দাদা মতীন সত্যিই সিগারেটের স্বাদ জানে। সস্তা বাজে সিগারেট, তবু কতগুলো খায় দিনে! কতবার মাকে ঘর ঝাঁট দিতে হয়। অনেক দিন পরে এ ঘরে এলাম। তাও সিগারেট খাওয়ার জন্য। খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আমি একটা সিগারেট খাব। কোনওদিন দাদার শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে এরকম সিগারেট খাওয়ার কথা ভাবা যায়নি। ঘুমন্ত দাদার শিয়রে দাঁড়িয়েও না। আমার দাদা মতীনকে ছেলেবেলা থেকেই আমি ভয় করি। সাত-আট বছরের তফাত তো ছিলই। তা ছাড়া ছিল আমাদের সবাইকে আড়াল করে রেখে দাঁড়ানোর অদ্ভুত গুণ। তাই সিগারেট ধরাতে আমার বাধোবাধো লাগছিল একটু। একবার চেয়ে দেখলাম। গা থেকে লেপ সরে গেছে, মশারির চারটে খুঁট ছিঁড়ে সেটাতে জড়িয়েছে সারাটা শরীর। মুখটা দেখা যায় না। বালিশের ওপর চুলের ভারে প্রকাণ্ড একটা মাথা পড়ে আছে। আসবাব বলতে চৌকি বাদ দিলে একটা টেবিল আর চেয়ার, একটা শেলফে বই। এ সবই দাদার মাস্টারির চাকরির সময় কেনা। তখন সামান্য আসবাবেরই কত গোছগাছ ছিল, যত্ন ছিল বইয়ের। মাঝে-মাঝে টেবিলের ফুলদানিতে নিজেই ফুল এনে সাজাত, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দিত সন্ধেবেলায়। দেখলাম সুন্দর পাতিলেবুর রঙের ফুলদানিটার গায়ে সন্ন্যাসীর শরীরের মতো ছাই মাখা। বোধহয় ওতে এখন সিগারেটের ছাই ফেলা হয়। ভালো করে দেখলে দেখা যাবে সারা ঘরেই সন্ন্যাসীর শরীরের সেই ছাই রং। উদাসীন ঘরখানা। সারা ঘরে ছড়ানো চিঠির প্যাডের নীল কাগজ। সুন্দর কাগজ। প্রতি কাগজেই খুদে খুদে কী যেন লেখা। সারাদিন লেখে আমার দাদা মতীন। চিঠি লেখে। কাকে লেখে কে জানে। শুনেছি বালিগঞ্জে কোথায় যেন পাথরের কড়িওয়ালা একটা প্রকাণ্ড বাড়ি ছিল, তার চারধারে ছিল ঘেরা পাঁচিলে ঘেরা প্রকাণ্ড বাগান, আর সেই বাড়িতে ছিল একটি মেয়ে। না, তাদের সঙ্গে কোনও কালে বিন্দুমাত্র পরিচয় ছিল না দাদার। দাদা কেবল দূর থেকে তাকে মাঝে-মাঝে দেখেছিল। আমার দাদা মতীনকে সে মেয়েটি বোধ হয় দেখেওনি। বোধ হয় দুর্বল লোকেদেরই অসম্ভব কিছু করার দিকে ঝোঁক বেশি থাকে। আমার দাদারও ছিল। কথাটা হয়তো একটু কেমন শোনাবে। একটু আগেই বললাম দাদা আমাদের সবাইকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিল। তবু কথাটা কিন্তু সত্যি। আমার বিশ্বাস দাদা দুর্বল প্রকৃতির মানুষ। অতি বেশি টান ভালোবাসা মানুষকে দুর্বল করে দেয়। আমার এবং মায়ের প্রতি দাদার অসম্ভব ভালোবাসা দেখে বরাবর মনে হয়েছে দাদা বড় দুর্বল মানুষ! মার সঙ্গে রাগারাগি করে আর ভাব করার জন্য চিরকাল ঘুরঘুর করেছে মায়ের আশেপাশে। যা বলছিলাম, অসম্ভব কিছু করার দিকে এই দুর্বল মানুষটির হয়তো প্রবল একটা ঝোঁক ছিল। নইলে আমাদের মতো ঘরের সাধারণ ছেলে হয়ে কেউ ওই বড় বাড়ির মেয়ের জন্য পাগল হয়! তাও পরিচয় নেই, নাম জানা নেই, ভালো করে চোখাচোখি অবধি হয়নি। সঠিক ঘটনাটা আমি জানি না। শুনেছি ওই অসম্ভব সুন্দর নির্জন পাড়ার রাস্তায়–রাস্তায় ঘুরে আমার দাদা মতীন তার অবসরের সময় বইয়ে দিত। সম্ভবত মা ব্যাপারটা টের পেয়েছিল। মায়েরা পায়। মাঝে-মাঝে মাকে বলতে শুনেছি, ‘কী জানি কোন ডাইনি ধরেছে।’ আমি তখন সদ্য বেহালার। একটা কারখানায় ঢুকেছি, প্রথম মাসের মাইনে পাইনি। সে সময়ে একদিন দাদা ফিরলে দেখলাম তাকে খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। অবাস্তব। জ্বলজ্বল করছে চোখ, মুখখানা লাল, আর ক্ষণে-ক্ষণে হাসির লহর তুলে সে যে কত কী কথা! খেতে বসেছি পাশাপাশি, সামনে মা, দাদা হঠাৎ হেসে বলল , ‘একটা ব্যাপার হয়ে গেল মা।’ বলে নিজেই খুব হাসল। ‘একটা মেয়ে বুঝলে বেশ সুন্দর চেহারার পবিত্র মেয়ে সন্ন্যাসিনী হলে মানাত–তাকে দেখলাম স্কুটারের পিছনে বসে বিচ্ছিরি গুন্ডা টাইপের একটা ছেলের সঙ্গে হাওয়া হয়ে গেল।’ বলেই ভীষণ হাসল দাদা। ‘সমাজটা যে কী হয়ে যাচ্ছে না মা! কার বউ যে কার ঘরে যাচ্ছে! কী ভীষণ যে ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে সব, তোমরা ঘরে থেকে বুঝতেই পারছ না।’ বলতে-বলতে বিষম খাচ্ছিল দাদা। মা মাথায় ফু দিয়ে বলল , ‘কথা বলিস না আর। জল খা।’ কার বউ কার ঘরে যাচ্ছে! আমার দাদা মতীনের ওই কথাটা আমার আজও বুকের মধ্যে লেগে আছে। আমরা তখন পাশাপাশি চৌকিতে দু-ভাই শুই, অন্য ঘরে একা মা। সে রাতে দাদাকে দেখলাম খুব হাসিখুশি মনে শুতে এল। টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে শোয়ার আগে কী যেন লিখছিল। চিরকালই আমাদের মধ্যে কথাবার্তা কম হয়। সে রাতে দাদা জিগ্যেস করল হঠাৎ, ‘তুই যেন কত মাইনে পাস?’ বললাম। শুনে দাদা একটু ভেবে আপনমনে বলল , ‘চলে যাবে।’ নতুন চাকরির পরিশ্রমে খুব নিঃসাড়ে ঘুম হত তখন। মাঝরাতে সেই চাষাড়ে ঘুম ভেঙে গেল। চমকে উঠে দেখি আমার শরীরের ওপর দু-খানা হাত ব্যাকুল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উঠে বসলাম। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে দাদা, মাথাটা চৌকির ওপর রাখা, হাত দু-খানা দিয়ে আমাকে জাগানোর শেষ একটা চেষ্টা করছে সে। আমি উঠতেই তার অবশ শরীর মাটিতে পড়ে গেল। তখনই আমাদের পরিবারের একজন কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু কমল না। ছারপোকা মারার যে বিষ দাদা খেয়েছিল হাসপাতালের ডাক্তাররা সেটা তার শরীর থেকে টেনে বের করে দিল। বের করল কিন্তু পুরোটা নয়। খানিকটা বোধ হয় দাদার মাথার মধ্যে রয়ে গেল।