কামুর আউটসাইডার বইখানা পড়েছে হৃদয়, অ্যালিয়েশনের কথাও তার অজানা নয়। সে কি ওইসবেরই শিকার? হৃদয়ের ইনস্টিংকট সঙ্গে-সঙ্গে বলে ওঠে—না হে, তা নয়। আসলে তোমার সন্নিসী হওয়ারই কথা ছিল যে! তা হতে পারোনি বলে তোমার মনটা তোমাকে ফেলে জঙ্গলে চলে গেল। এখন তুমি আর তোমার মন ভাই-ভাই ঠাঁই-ঠাঁই।
মানিব্যাগটা বুকে বড্ড চাপ দিচ্ছে। দম চেপে ধরছে। অস্ফুট একটু শব্দ করে হৃদয়। ট্যাকসিওলা বাঙালি ছোকরাটি একবার ফিরে চায়। বলে–কিছু বলছেন?
হৃদয় মাথা নাড়ে। হ্যাঁ, সে কিছু বলছে, বহুদিন আমাকে বড় অনাদর করেছে তোমরা। ঠিকমতো লক্ষ করোনি আমার রক্তচাপ, হৃদযন্ত্র বা ফুসফুস ঠিকঠাক কাজ করেছে কি না। জানতে চাওনি কতখানি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে আমার হৃদয়।
হৃদয় মানিব্যাগটাকে পকেটসুদ্ধ খামচে ধরে বুক থেকে আলগা করে রাখে। তারপর ট্যাকসির মুখ ঘোরাতে বলে। কোথাও যাওয়ার নেই শুধু ওই নিয়তি বারান্দাটা ছাড়া।
বাড়ি ফিরে আসতে-আসতে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল হৃদয়ের। কেন এই বাড়ি ছাড়া তার আর কোনও গন্তব্য থাকবে না? কেন আর কোথাও তার যাওয়ার নেই। কেন এত কম মানুষকে চেনে সে?
মানিব্যাগটা আলগা করে ধরে রেখেও বুকের বাঁ-ধারের অস্বস্তিটা গেল না। দমচাপা একটা ভাব। রসা রোডে নিজের গলির মোড়ে ট্যাকসিটা ঠিক যেখানে ধরে ছিল সেখানেই আবার ছেড়ে দিল সে। কী অর্থহীন এই যাওয়া আর ফিরে আসা!
বেলার রোদ খাড়া হয়ে পড়েছে। জ্বলে যাচ্ছে শরীর, ঝলসে যাচ্ছে চোখ। হৃদয় ধীর পায়ে হেঁটে গলিতে ঢুকল। আস্তে দোতলায় সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগল। ওপরে খুব হইচই শোনা যাচ্ছে। এবার পুজোয় কাজলের একটা আধুনিক গানের একসটেন্ডেডপ্লে রেকর্ড বেরিয়েছে। স্টিরিওতে সেই রেকর্ডটা বাজছে এখন। বহুবার শোনা হৃদয়ের। কেউ বাড়িতে এলেই বাজানো হয়। জঘন্য গান। প্রায় অশ্লীল দেহ ইঙ্গিতে ভরা ভালোবাসার কথা আর তার সঙ্গে ঝিনচাক মিউজিক।
দোতলার বারান্দায় উঠতে খুবই কষ্ট হল হৃদয়ের। মানিব্যাগটা বের করে ঝুল পকেটে রেখেছে, তাও বাঁ-দিকের বুকে চাপটা যায়নি। এখন সেই চাপ-ভাবের সঙ্গে সামান্য পিন ফোঁটানোর ব্যথাও। সিঁড়ির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দম নিচ্ছিল হৃদয়। বুঝতে পারছে তার মুখ সাদা, গায়ে কলকল করে ঘাম নামছে।
ললিতা ডাইনিং হলের পরদা সরিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। দেখে থমকে দাঁড়ায়। দু-পা এগিয়ে এসে বলে–কী হয়েছে?
হৃদয় কখনও এ মেয়েটার চোখে চোখ রাখতে পারে না। মনে পাপ। চোখ সরিয়ে নিয়ে খুব অভিমানের গলায় বলে–কিছু না!
এ অভিমানের দাম দেয় কে? হৃদয় হাঁফ ধরা বুক হাতে চেপে ঘরের দিকে এগোয়। বুঝতে পারে, শব্দগুলো আবছা হয়ে আসছে চোখে, বুকে ফুরিয়ে আসছে বাতাস। স্ট্রোক কি?
ভাবতেই মনটা অদ্ভুত ফুরফুরে হয়ে গেল আনন্দে। দীর্ঘকাল সামনের বারান্দায় বসে সে কি এই স্ট্রোকেরই অপেক্ষা করেনি? ইনস্টিংকট বলত—আসবে হে আসবে একদিন। সে এসে সব যন্ত্রণা ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে।
কার কথা বলত তার ইনস্টিংকট তা তখন বুঝতে পারত না সে। আজ মনে হল, এই অদ্ভুত অসুখের কথাই বলত।
হৃদয় ভেবেছিল, খুব নাটকীয়ভাবে সে ঘরের দরজায় লাট খেয়ে পড়ে যাবে। কিন্তু পড়ল না। হাত পা কাঁপছিল থরথর করে, বুকে অসম্ভব ধড়ধড়ানি আর হুলের ব্যথা, গায়ে ফোয়ারার মতো ঘাম। তবু পড়ল না। চেতনা রয়েছে এখনও, খাড়া থাকতে পারছে। পরদাটা সরিয়ে ড্রইং কাম ডাইনিং স্পেসে ঢুকল সে।
দরজার মুখে ললিতা এসে পিছন থেকে দুটো কাঁধ ধরে বলে—শরীরটা তো আপনার ভালো নেই। বউদিকে ডাকব?
বিরক্তি গলায় হৃদয় বলে—না, কাউকে ডাকতে হবে না।
ললিতা বোকা নয়। সব জানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। তাই মৃদু স্বরে বলে—আচ্ছা চলুন আমি বারান্দায় পৌঁছে দিই আপনাকে!
খুব যত্নে ইজিচেয়ারে তাকে স্থাপন করে ললিতা। টুল থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে সেটা সামনে রেখে পা দুটো টান করে মেলে দেয় টুলের ওপর। মৃদুস্বরে বলে—চোখ বুঝে একটু বিশ্রাম করুন।
মুখে বড় ঘাম জমেছিল হৃদয়ের। ললিতা কিছু খুঁজে না পেয়ে তাড়াতাড়িতে নিজের শাড়ির আঁচলে যত্নে ঘামটুকু মুছে দিল। বলল—পাখা আনছি। চোখ বুজে ঘুমোন তো।
আলো মুছে যাচ্ছিল, ক্লান্তিতে এক অতল খাদে গড়িয়ে যাচ্ছে শরীর। তবু চোখ খুলে চেয়ে থাকে হৃদয়। হাঁ করে চেয়ে থাকে ললিতার দিকে। একটুও কাম বোধ করে না সে। সব ভুলে হঠাৎ ‘মা’ বলে ডেকে উঠতে ইচ্ছে করে।
ঝিনচাক মিউজিকের সঙ্গে কটু সুরের গান বেজে যাচ্ছে স্টিরিওতে, সঙ্গে বাচ্চা-বুড়োর গলায় হাঃহাঃ হোঃ-হোঃ। কিন্তু এই সামনের বারান্দায় এই শরৎকালের উজ্জ্বল দুপুরে ভারী পুরোনো দিনের এক আলো এসে পড়ল। হৃদয়ের ইনস্টিংকট বলল, মরবে না এ যাত্রায়।
অপেক্ষা
মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে জানলার চৌকাঠে। দু-হাতে ধরে আছে জানলার শিক, শিকের ফাঁকে মুখ গলানো। তার বাবা ফিরতে দেরি করছে। বাবা ফিরলে তারা সবাই দোকানে যাবে। আজ ফ্রক। কেনা হবে পুজোর। কিন্তু বাবা ফিরছে না।
পাঁচ বছরের মেয়ে, সব কথা কইতে পারে। হঠাৎ মুখটা ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে জিগ্যেস করল–ক’টা বাজে মা?
মেয়ের মা সেলাই মেশিন থেকে মুখ তুলে ঘড়ি দেখে। সাতটা, মানুষটা এত দেরি কখনও করে না। বড় মেয়ে ন্যাওটা। বউ ন্যাওটা মানুষ, অফিসের পর আড্ডা–টাজ্ঞা দেয় না বড় একটা। দিলেও আগে ভাগে বলে যায় ফিরতে দেরি হবে। সরকারি অফিস, তাই ছুটি–টুটির ধার ধারে না, অফিসের ভিড় ভাঙার আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে। তার ওপর আজ পুজোর কেনাকাটা করতে যাওয়ার কথা। দেরি হওয়ার কারণ নেই। তবু সাতটা বেজে গেল, মানুষটা আসছে না।