বৃষ্টির সাদা চিক–এ ঢেকে গেল কয়েকজন ফুটবল খেলোয়াড়। মাঠে দুধের মতো সাদা–সাদা ফেনা তুলছে বৃষ্টি। বাতাসে বলটা ঘুরে যায় এদিক-সেদিক, জলের মধ্যে থপ করে পড়ে আটকে যায়, আবছা হয়ে গেল মাঠ। খেলোয়াড়রা দৌড়ে মাঠ ছেড়ে চলে আসতে থাকে। সবার আগে তোটন, তার বুকে ধরা বল।
চারধারেই পুকুর, মাঠ, ঘাট, আর শহরতলির নতুন না-হওয়া বাড়ির ভিত। তারা কেউ একসঙ্গে ছোটে না। দু-চারজন একটা বাড়ির নীচের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বাদবাকি সবাই শিবাজীর চায়ের দোকানে।
দাঁড়ায় না একমাত্র তোটন, বুকের বলটা শিবাজীর চায়ের দোকানের ভিতরে ভিড়ের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে বলে–সন্ধের পর দেখা হবে গণেশ।
গণেশ পিছন থেকে চেঁচায়–কোথায় যাচ্ছিস?
তোটন জবাব দেয় না। তার চারধারে ঝড় আর ঝড়। এক পাল পাগল হরিণের মতো বৃষ্টি ছুটছে। জলপ্রপাতের মতো পড়ছে। তার ভিতরে দেখা যায়, মজা পুকুরের কচুরিপানার পাতাগুলো উলটে দিচ্ছে বাতাস। তার পায়ে বুট, গায়ে কলারওয়ালা সাদা গেঞ্জি, পরনে খাটো প্যান্ট। ঝড়ের প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো নিজেকে বোধ করে সে। কোথায় যাবে? কোথাও না, তোটন দৌড়োবে একা, অনেক দূর।
নীল আগুন ঝলসে ওঠে অকাশে। গুড়গুড় করে মাটি কাঁপে। তোটন হা–হা করে হাসে। বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়োয়।
আজ স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে একটা রিগ্রেট লেটার এসেছে। চাকরিটা তার হল না। না হোক। তোটন এখন যে ঘাসপাতা, যে মাটির ওপর দিয়ে দৌড়োচ্ছ, চারধারে যে বৃষ্টির ঝরোকা,
উদ্ভিদের স্বেদগন্ধ, যে শব্দ ও স্পর্শ–এসবের মধ্যে ঠিকই থেকে যাবে তোটন। থাকবে আনন্দ। সে কখনও কাউকে কষ্ট দেবে না। কী ভালো এই ঝড় এবং একাকী সে! অনেকক্ষণ দৌড়োবে তোটন! একা একা।
.
সন্ধেবেলায় বীণা তার দোতলার অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে রোজ। মোটা কালো বীণার স্বামী আশু পোদ্দার পয়সা করেছে। দু-দুটো দোকান। কিন্তু এক দুঃখ, তাদের ছেলেপুলে নেই। স্বামীর তেমন টান নেই বীণার দিকে। রাত করে ফেরে, কাকভোরে আবার বেরোয়। সারাদিন বীণা একা। প্রেতচক্ষু মেলে সে দোতলা থেকে নীচের লোকালয়টির দিকে লক্ষ রাখে। পাড়ার সব কুমারীর খবর রাখে সে, সব বউয়ের। কোন কুমারীর পেটে জ্বণ এল, কোন বউকে স্বামী নেয় না, কে পরপুরুষের সঙ্গ করে, কার বা আছে বাঁধা মেয়েছেলে–কাকের মতো এইসব নোংরা খোঁটে সে, তারপর এ-বাড়ি ও-বাড়ি ছড়ায়।
সন্ধের পর নীচের রাস্তা দিয়ে তোটন যায়। টেরিলিনের প্যান্ট–শার্ট, চুল আঁচড়ানো, ঠোঁটে সিগারেট।
বীণা অন্ধকারে হেসে নেয়। তারপর গলা বাড়িয়ে ডাকে–তোটন। তোটন মুখ তুলে বলে–কী বউদি?
–কোথায় যাচ্ছ?
–অভিরামদার বাড়ি।
–রোজ যাও?
–যাই! দেখাশোনা করি, আমরা আত্মীয়রা কাছাকাছি আছি, আমরা না দেখলে কে দেখবে? বীণা হাসে-আত্মীয় আবার কী? তুমি তো অভিরামবাবুর পিসতুতো ভাইয়ের শালা, ওকে আত্মীয়তা বলে নাকি?
তোটন সিগারেটটা এতক্ষণ লুকিয়ে রেখেছিল পিছনে। হঠাৎ মেয়েমানুষটার প্রতি একটা ঘেন্না বোধ করে সিগারেটটা বের করে একটা টান দিয়ে বলল –যা ভাবেন।
–ভাবাভাবির কী আছে ভাই? যার যেখানে ভালো লাগবে যাবে।
–তাই তো যাচ্ছি।
বীণা একটা শ্বাস ফেলে। তোটন চলে গেলে আবার প্রেতচক্ষু মেলে চেয়ে থাকে। তার চোখে ঝড়ের আগের হলুদ আলোটি কখনও বিস্ময় সৃষ্টি করেনি। সে অনুভব করেনি বৃষ্টির সৌন্দর্য। নীচের লোকালয়টির মানুষগুলির পচনশীল শরীরের মাংস কৃমির কথা সে শুধু ভাবে। তার ভারী আনন্দ হয়।
.
শানু ঘুম থেকে উঠে ডাকে–মাসি।
–যাই! রান্নাঘর থেকে সাড়া দেয় মনোরমা।
–আমাকে মশা কামড়াচ্ছে। চুলকে দাও। কেটলির জল ফুটে গেল, ভোটন এখনও এল না। আবার বাবুর জন্য জল চড়াতে হবে নাকি? ভারী বিরক্ত বোধ করে মনোরমা।
রান্নাঘরে হাতজোড়া বলে মনোরমার উঠতে দেরি হচ্ছিল। অনুপমা ও-ঘর থেকে ডাকল–শানু, মাসি কাজ করছে, আমার কাছে আয়, গা চুলকে দেব।
পরিষ্কার রাগের গলায় শানু বলল না, মাসি দেবে।
বোধহয় অভিমানে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল অনুপমা, তারপর হতাশ গলায় বলল –মনো, শানু আমার পর হয়ে যাচ্ছে।
কেটলিটা নামিয়ে ও-বেলার তরকারি গরম করতে বসিয়ে মনোরমা বলল –কী যা তা বলল , মাসি কি কখনও মা হয়!
অনুপমা ও-ঘর থেকে গুনগুন করে বলে–তোর ওপর আমার হিংসে নেই রে মনো, শানু বরাবরই আমার পর ছিল। বাপ বেঁচে থাকতে বাপকেই চিনত, মার কাছে ঘেঁষত না।
শানুকে কলতলায় নিয়ে গেল মনোরমা। মুখ-চোখ ধুইয়ে যখন জামা পরাচ্ছে তখন এল তোটন।
–চা হয়ে গেছে নাকি! বলে গোটা দুই হাঁচি দিল পরপর।
অনুপমা বিছানায় উঠে বসল, বলল –তোটন, আজ একটা চড়াইয়ের বাচ্চা আমার হাতে মরল। মনো, তোটনকে নিয়ে একবার যা না, কুসি বাচ্চাটা, একটু খুঁজে আন।
–এনে কী হবে? ঝঙ্কার দেয় মনোরমা!
–একটু মাটি চাপা দিয়ে রাখ উঠোনে! অন্ধকার হয়ে গেছে, টর্চটা নিয়ে যা।
–যাচ্ছি বাবা, একটু রোসো। মেয়েকে খাওয়াই, তরকারিগুলো গরম করে দিই, তোমার যে কী সব বাতিক!
–বাতিক না রে, আমার হাতেই মরল তো! কষ্ট হয়। কাকে বেড়ালে ছিঁড়ে খাবে, একটু মাটি চাপা দে। হরিনাম করে দিস, ওতে গতি হয়।
খুক করে একটু হাসল তোটন, বলল –চড়াইয়েরও গতি আছে নাকি! অল্পবয়সেই আপনি বড় বুড়ো হয়ে গেলেন বউদি!