আমি ঘরের মাঝখানে যাই, কোণে চলে যাই, কিন্তু গণ্ডগোল সমানভাবে কানে আসতে থাকে। জানালার কাছে যাই, বাইরে অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকি। চেয়ারে বসে সিগারেট ধরিয়ে নিই। গণ্ডগোল, বড় বেশি গণ্ডগোল। হঠাৎ মনে পড়ে সকালে চায়ে চিনি কম হয়েছিল। বিকেলে চা দেওয়াই হয়নি। ইচ্ছে করে পাশের ঘরে গিয়ে ওদের ধমক দিয়ে বলি–’আমি জানতে চাই আমাকে কেন চা দেওয়া হয়নি? কেন আমার চায়ে চিনি কম হবে?’
বোধ হয় অনেক দিন বৃষ্টি হয়নি। আখের চারা গাছগুলি অসময়ে মরে গেছে। আমাদের দেশে তাই চিনি তৈরি হল না এবার। আমি মনে-মনে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতে থাকি। বিস্বাদ চায়ের স্বাদ মুখে লেগে থাকে।
টের পাই মাথার চুলের ভিতরে বিলি কেটে দিচ্ছে একখানা হাত। বুঝি, মা। ইচ্ছে হল জিগ্যেস করি, ‘আমার চায়ে চিনি দাওনি কেন মা? কোথাও যুদ্ধ বেধেছে খুব? চিনি আজকাল পাওয়া যায় না!’ কিন্তু সে প্রশ্ন করা হয় না। টের পাই পাশের ঘর থেকে দুড় দাঁড় লোক বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে। গালাগালি শুনতে পাচ্ছি। দাঁত ঘষার শব্দ। কোনও উত্তেজনা বোধ করি না। কেবল মাকে বলতে ইচ্ছে করে, “চিন্তা কোরো না মা। দূরের যুদ্ধ থেকে গেলে আবার সব ঠিকমতো পাওয়া যাবে। আগের মতোই।’ কিন্তু সে কথাও বলা হয় না। শুনি মা বিড়বিড় করে বলছে, ‘তুই কেন এমন হয়ে রইলি মতু! তুই থাকলে সব ঠিক হয়ে যেত।’ অমনি আমি ভয়ে। জড়সড়ো হয়ে যাই। চারপাশেই বড় গণ্ডগোল চলেছে। দুঃসময়। তাই বসে থাকি। অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকি। চাল–ধোয়া হাতের গন্ধ পাই। অন্ধকারে ঘরে বসে টের পাই চারদিকে যোজন জুড়ে অনাবৃষ্টির নিস্ফলা মাঠ পড়ে আছে। আখের চারাগুলি মরে গেল। দুঃসময়।
ভয় করে। চায়ে চিনি কম। পাশের ঘরে গণ্ডগোল। কোথাও যাওয়ার নেই। যেতে ইচ্ছে করে অথচ যথেষ্ট পোশাক নেই গায়ে। অবহেলা সহ্য করার মতো শক্তি নেই। অস্ত্রহীন যাওয়া যায় না তাই বসে থাকি। অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকি।
পাশের ঘরে গণ্ডগোল থেমে গেল। লোক বেরিয়ে যাচ্ছে। সবাই। নিস্তব্ধতা। শুনতে পাই মা কাঁদছে। অস্থির লাগে বড়। আমার মাথার ওপর একখানা হাত কাঁপে। বড় শান্ত ও সুন্দর বিশ্রামের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে শহর মিঠিপুর, জেলেদের গ্রাম, কিংবা সেই আশ্চর্য খনিগুলির বসতি। শান্ত ও সুন্দর বিশ্রামের রাত্রি আমার চারপাশে। তার মধ্যে মার কান্নার শব্দ হয়। খুব শব্দ হয়। বলে, ‘বতুকে ওরা কোথায় নিয়ে গেল? কি করবে ওকে? বতু কেন গেল?’ আমি চুপ করে। থাকি। নিস্তব্ধতার মধ্যে মা কাঁদতে থাকে। বুঝতে পারি না। দূরে বোধ হয় খুব যুদ্ধ চলছে। আর অনাবৃষ্টি। দুঃসময়। অস্থির লাগে। সিগারেট ফেলে দিয়ে আবার ধরাই। কিছুই মেলাতে পারি না। শুধু দেখি হিংসাশূন্য স্থবির ও অক্ষম রত্নাকর বসে আছে গাছতলায়, পথিকের অপেক্ষায়। আবার দেখি পশ্চিমের প্রকাণ্ড খোলা বারান্দায় একটি শিশু একা-একা হাঁটতে শিখছে। বতু না? হ্যাঁ, বতুই। আমার ছেলেবেলায় হারানো বল কোলে করে বসে আছে আল্লা বুড়ো দরজি, দেখতে পাই দুপুরের ঘুমে শুয়ে আছে মা, এলো চুলের ওপর প্রকাণ্ড খোলা মহাভারত উপুড় করে রাখা। শুনতে পাই কাছেই কোথাও যেন দিন রাত চলছে এক মাটি-মজুরের গর্ত খোঁড়ার কাজ। দেখি কুয়াশার মধ্যে তুমি দূরে চলে যাচ্ছ। মনে পড়ে চায়ে চিনি কম হয়েছিল। দূরে কোথাও খুব যুদ্ধ চলছে। আর অনাবৃষ্টি। কিছুই মেলাতে পারি না। বতুর নাম ধরে কাঁদছে মা। ইচ্ছে করে বলি –’ঈশ্বর প্রতিটি রাস্তাকেই নিরাপদ রাখছেন। কোনও ভয় নেই।’ পরমুহূর্তেই বোধ করি, এই কথার পিছনে আমার বিশ্বাস বড় কম। মা কাঁদে। মেলাতে পারি না। কিছুতেই মেলাতে পারি না।
চোখে জল চলে আসে। আমি আস্তে-আস্তে তোমার জন্য কাঁদতে থাকি।
আমরা
সেবার গ্রীষ্মকালের শেষদিকে দিন চারেক ইনফ্লুয়েঞ্জাতে ভুগে উঠলেন আমার স্বামী। এমনিতেই তিনি একটু রোগা ধরনের মানুষ, ইনফ্লুয়েঞ্জার পর তাঁর চেহারাটা আরও খারাপ হয়ে গেল। দেখতাম তাঁর হনুর হাড় দুটো গালের চামড়া কুঁড়ে বেরিয়ে আছে, গাল বসা, চোখের নীচে কালি, আর তিনি মাঝে-মাঝে শুকনো মুখে ঢোক গিলছেন–কণ্ঠাস্থিটা ঘনঘন ওঠা–নামা করছে। তাঁকে খুব অন্যমনস্ক, কাহিল আর কেমন যেন লক্ষ্মীছাড়া দেখাত। আমি তাঁকে খুব যত্ন করতাম। বীট গাজর সেদ্ধ, টেংরির জুস, দু-বেলা একটু-একটু মাখন, আর রোজ সম্ভব নয় বলে মাঝেমধ্যে এক-আধটা ডিমের হাফবয়েল তাঁকে খাওয়াতাম। কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জার এক মাস পরেও তাঁর চেহারা ভালো হল না, বরং আরও দুর্বল হয়ে গেল। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে তিনি ভয়ঙ্কর হাঁফাতেন, রাত্রিবেলা তাঁর ভালো ঘুম হত না, অথচ দেখতাম সকালবেলা চেয়ারে বসে চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তিনি ঢুলছেন, কষ বেয়ে নাল গড়িয়ে পড়ছে। ডাকলে চমকে উঠে সহজ হওয়ার চেষ্টা করতেন বটে, কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যেত যে তিনি স্বাভাবিক নেই। বরং অন্যমনস্ক এবং দুর্বল দেখাচ্ছে তাঁকে।
ভয় পেয়ে গিয়ে আমি জিগ্যেস করলাম–তোমার কী হয়েছে বলো তো!
তিনি বিব্রতমুখে বললেন,–অনু, আমার মনে হচ্ছে ইনফ্লুয়েঞ্জা আমার এখনও সারেনি। ভিতরে-ভিতরে আমার যেন জ্বর হয়, হাড়গুলো কটকট করে, জিভ তেতো–তেতো লাগে। তুমি আমার গা–টা ভালো করে দ্যাখো তো!