দেখি আল্লা বুড়ো দরজি। আল্লার বুকের ভিতরে হঠাৎ জেগে উঠছে ধানভানার তোলপাড় শব্দ। ফসলের মতো উঠে আসছে ভালোবাসা। তাই তার ছুঁচের মুখে সুতো ছিঁড়ে যাচ্ছে বারবার। আল্লা বুড়ো দরজি অন্যমনে চেয়ে আছে। কিছুই মেলানো যায় না। কিছুতেই মেলানো যায় না। তবু চেয়ে দেখি আমার ছেলেবেলায় হারানো বল তার কোলের কাছে পড়ে আছে।
একদিন সুসময়ে তিনি সব ফিরিয়ে দেবেন।
চায়ে চিনি কম হয়েছিল, খুব কম। হয়তো দেওয়াই হয়নি। কদাচিৎ কখনও টের পাই চায়ে চিনি কম কিংবা বেশি। আজ পেলাম। তার মানে আজ আমি স্বাভাবিক আছি। অন্য অনেক দিনের চেয়ে ভালো।
আমি ভালো আছি। তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। তুমি কেমন আছ? মনে হয় তুমি একরকমের ভালো আছ। আমি আর-একরকমের। তবু হয়তো চেনা মানুষেরা একে অন্যকে ডেকে মতীনের দুঃখের কথা বলে, ‘দেখ হে, এতদিনে সুখেই মতীনদের দিন কেটে যাচ্ছিল। সবই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু তারপর একদিন মতীনের চোখে পড়ে গেল সুন্দর একটি মেয়ে…।’ এইভাবেই মতীনের দুঃখের কথা ছড়িয়ে যাচ্ছে। হয়তো তোমার কানেও যাবে একদিন। চিন্তা কোরো না। আমি ভালো আছি। ভালো থাকা এক-একরকমের।
চায়ে চিনি কম হয়েছিল। কেন? কোথাও কি কোনও গণ্ডগোল হচ্ছে খুব! দূরে কোথাও যুদ্ধ বাধলে আমাদের চায়ে মাঝে-মাঝে চিনি কম হয়ে যায়। মনে হয় কি যেন একটা টানাপোড়েন চলছে চারপাশে। হয়তো এটা এ-বাড়িতে, হয়তো সেটা বাইরের জগতে কোথাও। সংসারে কি খুব অভাব চলছে! কে জানে। বাইরে কোথাও কি হচ্ছে কোনও গণ্ডগোল? কে জানে! আমি শুধু জানি, আজ চায়ে, চিনি কম হয়েছিল।
সকালের দিকে কে একজন ঘরে এসেছিল। আমার মুখের ঢাকা সরিয়ে তাকাল। চোখে চোখ। মনে হল তার চোখে বড় আক্রোশ। হয়তো মারবে। কিন্তু মারল না। আবার আমার মুখ ঢেকে দিল। যখন চলে যাচ্ছে লোকটা, তখন পিছন থেকে দেখে চিনতে পারলাম না। বতু। আমার ভাই ব্রতীন। ঘরে পোড়া সিগারেটের গন্ধ। বতু কি সিগারেট খায়? আগে তো খেত না। কেমন যেন দেখলাম ওর মুখ চোখ! ইচ্ছে হল ডেকে জিগ্যেস করি, ‘তোর কিছু হয়নি তো বতু? ভালো আছিস তো?’ কিন্তু কেমন লজ্জা করল।
একটু পরেই ঘরে এল মা। চিনতে পারলাম। দেখলাম মা মেঝে থেকে আমার সিগারেটের টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিচ্ছে; চিঠির একটা কাগজ পড়ার চেষ্টা করল ভ্রূ কুঁচকে। কী যেন বিড়বিড় করল একটু। ইচ্ছে হল জিগ্যেস করি, ‘চোখে আজকাল কেমন দেখছ মা?’
মায়েরা হয়তো কিছু টের পায়। দরজায় দাঁড়িয়ে মা ফিরে তাকাল। যেন তক্ষুনি বলবে, ‘মতু, তুই কি কিছু বলবি?’ লজ্জা করল। চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
জানলার রোদ এসে লেগে আছে। জানালার কাছে এসে দাঁড়াই। খুবই স্বাভাবিক দেখি চারপাশ। রাস্তার তেমাথায় বকুল গাছ, চৌধুরীদের বাগানের ঘেরা পাঁচিলের ইট বেরিয়ে আছে, দেখা যাচ্ছে একটা চৌখুপি জমি–বাড়ি উঠবে বলে ইট সাজানো হয়েছে, পাল্লাখোলা লরি থেকে বালি খালাস করছে কয়েকজন কুলি, ইলেকট্রিকের তারে লটকে আছে পুরোনো ছেঁড়া সাদা একটা ঘুড়ি। চিন্তিত মানুষেরা হেঁটে যাচ্ছে। উঁচুতে নীল ছাদের মতো আকাশ, কয়েকটা কাক চিল উড়ছে।
খুবই স্বাভাবিক আছে চারপাশ। তবে কেমন চায়ে চিনি কম হয়েছিল। দূরে কিংবা কাছে কোথাও কি যুদ্ধ হচ্ছে খুব? সংসারে কি খুব অভাব চলছে? অতি তুচ্ছ ঘটনা। চায়ে চিনি কম। মাঝে-মাঝেই তো এরকম ঘটে। ভুল হতে পারে। তবু দ্যাখো, সারাদিন বিস্বাদ চায়ের স্বাদ মুখে লেগে আছে।
মাঝে-মাঝে মনে হয় আমি থেমে আছি। বড় বেশি থেমে। মৃত্যু এরকমই হয়। নিস্তব্ধতার মতো। অথচ দ্যাখো সারাদিন আমার চারদিকে চলছে কাজ। পরিশ্রমী পিঁপড়েদের, ধৈর্যশীল মাকড়সার, উইপোকার। সারা পৃথিবীময় জঘন্য জীবাণুরাও ঘুরছে কাজের সন্ধানে, কিংবা আশ্রয়ের। আমিই থেমে আছি কেবল। ইচ্ছে করে জাল ফেলে বসে থাকি, গর্ত খুঁড়ি, কিংবা চাষ। করে ফসল নিয়ে আসি ঘরে। এরকম ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ যেন আমার ভিত নড়ে যায়। যেন ঘুম থেকে জেগে উঠি। প্রশ্ন করি, ‘আমি এরকম হয়ে আছি কেন? কেন আর সব জীবন্ত প্রাণীর মতো আমারও নেই সুখ দুঃখ? আমি কি মরে গেছি? কিংবা, আমার জন্মই হয়নি? আমি কি সব পাওয়া পেয়ে গেছি? কিংবা কিছুই পাইনি।’ আস্তে-আস্তে কারণমুখী হতে চেষ্টা করি। অমনি জীবন বড় জটিল বলে বোধ হয়। আমি সারা ঘরময় বেড়াই, দেওয়ালে হাত চেপে ধরি, ঢকঢক করে মাথা ঠুকি। বেরিয়ে পড়ব বলে দরজার কাছে চলে যাই। তখনই মনে পড়ে–আমি অস্ত্রহীন। যথেষ্ট পোশাক নেই গায়ে। অবহেলা সহ্য করার মতো যথেষ্ট শক্তি নেই। যাওয়া হয় না। ফিরে আসি ঘরের ভিতরে। স্বপ্নের ভিতরে।
পাশের ঘরে কারা কথা বলছে! বিকেলে ঘুম থেকে উঠে শুনি খুব গণ্ডগোল। চিৎকার। আস্তে আস্তে উঠি, ঘরের মধ্যে বেড়াই। চিৎকার খুব বেড়ে যায়। বিরক্তি বোধ হয়। মাঝখানের দরজা বন্ধ। সেই বন্ধ দরজায় টোকা দিয়ে বলি–’চুপ করো।’ কেউ চুপ করে না। মাঝে মাঝেই ওই ঘরে কারা যেন আসে। গোপনে কথা বলে। হয়তো পরস্পরকে ভালোবাসার কথা। কিন্তু আজ বড় গণ্ডগোল। আমি আবার চিষ্কার করে বলি–”চুপ করো।’ কেউ চুপ করে না; হতাশ লাগে বড়। শুনতে পাই মোটা ভাঙা বিশ্রী গলায় কে যেন চিৎকার করে বলছে–’আমারও পাগল ভাই, বিধবা মা আছে, আমি স্বার্থত্যাগ করছি না?’ কথাটা শুনে লোকটার জন্য আমার সামান্য দুঃখ হয়। আহা রে, লোকটা! পাগল ভাই আর বিধবা মা নিয়ে দুঃখে আছে বড়। ইচ্ছে করে ওকে এই ঘরে ডেকে আনি, একটি দুটি সান্ত্বনার কথা বলি। বলা হয় না। ওরা ভয়ংকরভাবে চিৎকার করে ওঠে। ইমপস্টার। সোয়াইন। তোমার জন্যই আমরা ডুবে যাচ্ছি।…বাঁচার জন্য…সংগ্রামের জন্য…। তুমি আমাদের খুন করছ, খুন……স্বার্থত্যাগ করতে শেখো…।