ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখি মতু তাকিয়ে আছে। ঠিক যেমন ছেলে মায়ের দিকে তাকায়। মনে হল এক্ষুনি ‘মা’ বলে ডাকবে, বলবে, ‘খিদে পেয়েছে, খেতে দাও।’ চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রইলাম ওর একটু কথা শোনার চেষ্টায়। ও চোখ ফিরিয়ে নিল।
সেই মেয়েটার ওপর মাঝে-মাঝে বড় রাগ হয় আমারও। কেন রে পোড়ারমুখী, কোন কপালে আমার ছেলের চোখে তুই পড়েছিলি? হ্যাঁ, ঠিক ওইরকম গ্রামের ভাষায় মেয়েটার সঙ্গে আমি মনে-মনে ঝগড়া করি। আবার ভাবি, আমার মতু যাকে অত ভালোবেসেছিল তাকে আমি কী করে ওরকম ঘেন্না করব! তাই আবার মনে মনে বলি, ‘তোমাকে চিনি না, তবু বলি, মা, সুখে থাকো।’
মতীন
কেউ ঠিকঠাক বেঁচে নেই। পুরোপুরি মরেও যায়নি কেউ। ওরকম কিছু কি হয় কোনওদিন? ঠিকঠাক বেঁচে থাকা, কিংবা পুরোপুরি মরে যাওয়া?
তবু দ্যাখো মাঝে মাঝেই মানুষেরা মরে যায়। হঠাৎ সময় চলে আসে। অসময়ে। কেউ বুঝতেই পারে না। সখেদে বলে–বহু কাজ বাকি রয়ে গেল। বাস্তবিক মানুষের, পিঁপড়ের, পাখিদেরও বহু কাজ বাকি থেকে যায়। ঠিক সময়ে-সময়ে হয় না।
আবার একটু পুরোনো হলে সকলেই নতুন জীবন চায়, নতুন শরীর কিংবা চায় দুঃখ–দূর, কিংবা চায় তাকে, যাকে এবার পাওয়া হল না।
তাই নির্বাসনে কেউ যায় না, কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে। কেউ একজন করপুটে ধরে নেয়। আবার ফিরিয়ে দেয় খেলার ভিতরে।
ফিরে এলে আবার সেই অবিরল মাটিকাটার শব্দ। ধুপ ধুপ ধুপ। দিনরাত। খুব দূরে নয়। মাঝে-মাঝে অন্য সব শব্দের সঙ্গে মিশে যায়। তবু শোনা যায়, ঠিকমতো কান পাতলে। যেন গভীর মাটির নীচে নেমে যাচ্ছে একজন মাটি–মজুর। পরিশ্রমী সে। সারাক্ষণ তৈরি করছে বিচিত্র সুড়ঙ্গ, সঁড়িপথ। হয়তো তুচ্ছ কাজ, অকাজের। তবু তার কত মনোযোগ! সে ফিরেও দেখে না কতখানি কাটা হল, হিসেবও করে না আর কতখানি বাকি। সারাদিন রাত অবিশ্রান্ত তার কাজ চলতে থাকে। শব্দ উঠে আসে, গর্ত গভীরের দিকে নেমে যায়।
মনে হয় ওটা বুকের শব্দ! কিন্তু তা নয়।
কিংবা হয়তো ওটা বুকের শব্দই! আমারই ভুল হয় কেবল।
কোনও কাজ নেই। তাই মাঝে-মাঝে মিঠিপুর ঘুরে আসি। তুচ্ছ শহর। জানালার তাকের ওপর এক দুই দানা চিনি ফেলে দিই। শূন্য শহরের লুকোনো জায়গা থেকে অমনি উঠে আসে পরিশ্রমী পিঁপড়ের সারি। মিঠিপুরে সচ্ছলতা দেখা দেয়। ওরা কি জানে পরিশ্রমই সচ্ছলতা? কিংবা মনে করে সচ্ছলতা ঈশ্বরের দয়া?
হামাগুড়ি দিয়ে আমি জেলেদের গ্রামে চলে আসি। আমার টেবিলের তলায় ঘন ছায়ায় নিবিড় সেই গ্রাম। জাল ছড়িয়ে অপেক্ষা করছে তিনজন জেলে। শান্ত, ধৈর্যশীল, আশাবাদী তিন। মাকড়সা। কখনও মুড়ির টুকরো ছুঁড়ে মারলে জালে একটু আটকে থাকে। সঙ্গে-সঙ্গে তারা নড়ে ওঠে। শান্ত ধৈর্যশীল তিনজন আশাবাদী মাকড়সার কাছে জ্ঞানলাভের জন্য বসে থাকি।
খনিশ্রমিকের মতো আঁকাবাঁকা পথ কাটছে উইপোকা আমার বইয়ের তাকে। তাক থেকে বইয়ের ভিতরে। আমার বইগুলো ঝুরঝুরে হয়ে এল। তবু আমি বাধা দিই না। তাদের ক্লান্তিহীন কাজ দেখি। দ্যাখো, কেমন তৈরি করছে গভীর জালিপথ, নকশা ছাড়াই মিলিয়ে দিচ্ছে এ ধারের সঙ্গে ওধারের সুড়ঙ্গ। যশোলাভ নেই, বাহবার ধারও ধারে না।
দেখে যাই। আশ্চর্য এইসব শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে খনির কাছাকাছি। সুন্দর ভ্রমণ। লোভ বেড়ে যায়। দেখতে ইচ্ছে করে আরও কত গ্রাম, গঞ্জ, পাহাড় ও প্রান্তর পড়ে আছে এইখানে, রয়েছে নিস্তব্ধ জীবাণুদের বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র, ধুলোর কণার মধ্যে নিহিত রয়েছে পরমাণুর দিক–প্রদক্ষিণ। দ্যাখো আমাদের ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা কত কম। সব আছে চারধারে, দেখা যায় না।
দুঃশীল রত্নাকর বসে আছে গাছতলায়। পথিকের অপেক্ষায়। এ পথে এখন আর কোনও পথিক আসে না। সম্ভবত ঈশ্বর তাদের নিরাপদ ঘুরপথ চিনিয়ে দিয়েছেন। তবু অপেক্ষায় বেলা যায়। জীর্ণ হয়ে আসে ঘরদুয়ার, বয়স বেড়ে যায়, ক্ষুধা বাড়ে। রত্নাকর বসে থাকে গাছতলায় পথিকের অপেক্ষায়। বহুকাল কেটে যায়। অভ্যাসবশত রত্নাকর বসে আছে, পাশে রাখা বশংবদ খাড়া, হঠাৎ দূরে শোনা গেল পথিকের গান, সর্বাংস্তবানুরঞ্জয়ানি…।’ অমনি শরীরে রক্ত ছলকে ওঠে। রত্নাকর খড়গ তুলে নেয় শূন্যে, দৌড়ে যায়। তারপরই ঢলে পড়ে, ভয়ংকর ভারী খড়গ তাকে টেনে রাখে। ঝাঁপসা চোখে রত্নাকর চেয়ে দেখে অদূরে পথিক। তরুণ, ঐশ্বর্যবান। রত্নাকর কেঁদে ওঠে। পথিক সামনে এসে দাঁড়ায়, ‘কী চাও রত্নাকর?’ রত্নাকর হাতজোড় করে বলে, ‘আমার পরিবার উপোস করে আছে, দয়াময়, দয়া করো। ভগবান তোমার মঙ্গল করবেন।’
মাঝে-মাঝে তাকে ডাক দিই, ‘রত্নাকর, ওহে রত্নাকর।’ বুড়ো ভিখিরিটা জানালার কাছে চলে আসে। আমি তাকে একটা দুটো পয়সা দিই। জিগ্যেস করি, ‘কখনও কি ডাকাত ছিলে?’ সে মাথা নাড়ে। হাসে। চলে যায়।
প্রায়ই তাকে দেখি বসে আছে গাছতলায়। পথিকের অপেক্ষায়। একমাত্র সঙ্গী তার কর্মফল।
কোনও মানে নেই। তবু দেখি ভাঙা, ভেঁড়া, অবান্তর দৃশ্য ভেসে যায়। কিছুতেই মেলানো যায় না।
কখনও দেখি একটা বল গড়িয়ে যাচ্ছে ঘাসের ওপর। খেলুড়ির দেখা নেই। তবু বল গড়িয়ে যাচ্ছে। একা, সাদা, রৌদ্রের ভিতরে।
কখনও দেখি প্রকাণ্ড ভাঙা একটা মসজিদবাড়ি। আগাছায় ভরা, পরিত্যক্ত, দেউলিয়া। তবু পড়ন্ত বেলায় তার উঠোনে কে একজন নীরবে নমাজ পড়ছে।