খুব ভোরবেলাতেই বতু উঠে তার দাদার ঘরে গিয়েছিল আজ। এমনিতে বড় একটা যায় না। কি জানি আজ বোধহয় দাদার জন্য মায়া হয়েছিল একটু। তাই দেখে এল। কিংবা হয়তো রাতে কোনও স্বপ্ন দেখেছিল দাদাকে নিয়ে। বতুর ভালোবাসা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। মতুরটা যেমন যেত। তবু বতুর মনেও বড় মায়া–আমি জানি। মানুষের জন্য ও ভাবে, সমাজ-সংসারের জন্য ভাবে। পাড়ার লোকেদের দায়ে দফায় ও দেখে। মতুরও ভালোবাসা ছিল, তবে সেটা অন্য রকমের। অন্যের দুঃখ দেখলে মন খারাপ করে থাকত, হয়তো লুকিয়ে কাঁদতও, কিন্তু বুক দিয়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত না, বতু যেমন করে। হয়তো মতুর লজ্জা সংকোচ বেশি ছিল। তা ছাড়া ছিল ওর কুনো স্বভাব, মাথার মধ্যে ছিল চিন্তার কারখানা। তাই ওর ভালোবাসা ছিল ভাবের।
চা খেয়েই সকালেই বতু বেরিয়ে গেল। বলে গেল–’ভাত ঢাকা দিয়ে রেখো, ফিরতে দেরি হবে।’ ওর মুখ চোখের অবস্থা ভালো না। কী জানি কী হবে। ওর বন্ধুরা আমাকে বলে যায়–ওর কিছু হবে না। চাকরি গেলেও ও আবার চাকরি পাবে। পুলিশের কথা ভাবি। ওরা নাকি বড্ড মারে!
অনেক বেলা পর্যন্ত মতু শুয়ে আছে। গায়ে হাত দিয়ে ডাকলাম–ওঠ রে। উঠল। পারতপক্ষে অবাধ্যতা করে না। চায়ের কাপ হাতে দিলাম। বাসি মুখে চা খেতে লাগল। অনেক করেও ওকে দাঁত মাজাতে পারি না, স্নান করাতে পারি না। গায়ে চিট হয়ে ময়লা বসেছে। ওকে যে জোর করে কলঘরে টেনে নিয়ে যাব এমন আমার সাধ্যে কুলায় না। ছুটির দিনে মাঝে-মাঝে বতু জোর করে স্নান করিয়ে দেয়। ওই জোর করাটা দেখতে আমার ভালো লাগে না। বুকের মধ্যে একটু কেমন করে। বেশ কয়েক দিন হল বতু দাদাকে স্নান করায় না।
মেঝে থেকে সিগারেটের টুকরোগুলো তুলে বাঁ-হাতে তেলোয় জমা করছিলাম। শিউলি ফুল কুড়োনোর কথা মনে পড়ে। সামান্য একটু শ্বাস বুক থেকে বেরিয়ে গেল। আস্তে-আস্তে অথর্ব হতে চ লোম। অথচ খুব বেশি দিন আগে জন্মেছি বলে মনে হয় না। বে-ভুল মনে কেবল পুরোনো দিনের কথা কালকের কথার মতো মনে হয়। কিন্তু সেটা তো সত্যি নয়। মতুরই বয়স ছত্রিশ পার হয়ে গেল। ওর আগেও একটা হয়েছিল। বাঁচল না। ভালোই হয়েছে। সেটা আবার কোন রকমের পাগল হত কে জানে!
মতু একটুক্ষণ আমাকে দেখল। যেন চেনে না। তবু আমি জানি মতু মাঝে-মাঝে খুব স্বাভাবিক হয়ে যায়। একদিন মাঝরাতে ওর ডাক শুনলাম–মা, ওমা, আমার টেবিলে জল রাখোনি কেন? ভীষণ চমকে উঠেছিলাম। আনন্দে ধক করে উঠল বুকের ভিতরটা। জল খাওয়ার পর কিন্তু আর চিনল না আমাকে। তারপর মাঝে-মাঝে ইচ্ছে করে জল না রেখে দেখেছি আবার ‘মা’ বলে ডাকে কি না। ডাকত মাঝে-মাঝে। কিন্তু জল খাওয়ার পরই ভুলে যেত। জল না রেখে কষ্ট দিয়ে ওকে পরীক্ষা করতে আর ইচ্ছে হয় না। বেশি সিগারেট খায় বলেই বোধ হয় ওর জলতেষ্টা খুব। তেষ্টার জলের চেয়ে কি মা ডাকটা বেশি? তাই আমি জল রাখতে ভুলি না।
ওর এ অবস্থা হওয়ার সময়ে প্রথমদিকে বন্ধুরা খুব আসত। এখন আর আসে না। লজ্জার মাথা খেয়ে তাদের কাছে মেয়েটির কথা জিগ্যেস করতাম। কেমন মেয়ে, কীরকম বয়স, কোন জাত! তারাও কেউ দেখেনি। মতুর কাছেই শুনেছে বেশি বয়স না তার, খুব পবিত্র সুন্দর চেহারা, আর খুব অহংকারী। কোনওদিকে নাকি তাকাই না। তার নাম, জাত কেউই জানে না। এসব শুনে আমি একদিন বতুকে বলেছিলাম–’কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দে। তাতে মেয়েটার চেহারার বর্ণনা দিয়ে লেখ যে, আপনার জন্যই আমার দাদার এই অবস্থা, আপনি এসে তাকে বাঁচান। আমরা আপনার কাছে কেনা হয়ে থাকব।’ বতু রাজি হল না, ঝাঁকি দিয়ে বলল –’সে মেয়েটা কী করে বুঝবে যে, এটা তাকেই লেখা? তা ছাড়া আমরা এত হীন হতে যাবই বা কেন?’ তারপরেই বতু মেয়েটাকে গালাগাল দিতে লাগল, সে বড় লোকের মেয়ে বলে। আমি কিন্তু বতুর মতো করে বুঝি না। মেয়েটাকে চিনতে পারলে আমি গিয়ে তাকে সাধ্যসাধনা করতাম, দরকার হলে পায়ে ধরতাম। সম্মানের চেয়েও যে ছেলেটা আমার বেশি। হয়তো বিজ্ঞাপন মেয়েটা দেখত না, হয়তো দেখলেও বুঝত না, তবু চেষ্টা করলে দোষ কী ছিল? তা না করে বতু গেল সমাজের ব্যবস্থা পালটাতে। দূর থেকে যে এত ভালোবাসা যায় আর পাগল হওয়া যায় তা বতু বোঝেই না। আমি কিন্তু একটু-একটু বুঝি। বতু-মতুর বাবা এখন তো বহুদূরের লোক, তার শরীর নেই, ডাকলেও তার সাড়া পাওয়া যাবে না। তবু আমার এই বুকটাতে ওই লোকটার জন্য ভালোবাসা টলটলে হয়ে আছে। যদি ভগবানকে দেখতে চাই তবে হয়তো বলব–’তুমি ওই চেহারা ধরে এসো।’ কী জানি হয়তো মতুর ভালোবাসা সেরকম নয়। আমি তো তাকে পেয়েছিলাম কোনওদিন, মতু তো পায়ইনি। কিংবা হয়তো মতুও সেই মেয়েটিকে তার নিজের মতো করে মনে-মনে পেয়েছে। ঠিক
জানি না। আমার ভাবনা-চিন্তায় অনেক গণ্ডগোল। মতুর মনের ভিতরটা তো আমরা কেউ দেখতে পাই না।
একটা নীল কাগজ কুড়িয়ে টেবিলে রাখতে গিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। ছানিকাটা চোখ, মোটা চশমা, তাই ভালো পড়া গেল না। মনে হল যেন লেখা আছে যে, পৃথিবীতে কেউই ঠিকঠাক বেঁচে নেই, পুরোপুরি মরেও যায়নি কেউ। সুন্দর কথাটা। মতুর মাথায় চিরকালই সুন্দর-সুন্দর কথা আসে। মনে-মনে বললাম–’ঠিকই লিখেছিল মতু। পৃথিবীতে কেউই ঠিকঠাক বেঁচে নেই, আবার পুরোপুরি কেউই মরে যায়নি। তোর অনেক জ্ঞান, তুই বড় ভালো বুঝিস।’