Site icon BnBoi.Com

গোয়েন্দা বরদাচরণ সমগ্র ও অন্যান্য – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

গোয়েন্দা বরদাচরণ সমগ্র ও অন্যান্য – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

অম্বুজবাবুর ফ্যাসাদ

সকালবেলা অম্বুজ মিত্রের স্ত্রী কাত্যায়নী দেবী ঝি মোক্ষদাকে খুব বকাবকি করছিলেন। স্বামীকে একটু আলু ভেজে ভাত দেবেন, তা সেই আলু ঠিকমতন কুচোনো হয়নি, ডালনায় দেবার হলুদবাটা তেমন মিহি হয়নি, অম্বুজবাবুর গেঞ্জি সকালে কেচে শুকিয়ে রাখার কথা, সেটাও হয়নি, পান সেজে দেবেন, তা সুপুরি ঠিকমতো কাটা হয়নি, আরো কত কী। কাত্যায়নী বললেন, এতকালের ঝি বলে তাড়াতে কষ্ট হয়। মোদা, কিন্তু তবু বলি, তুই অন্য কাজ দেখ।

অম্বুজবাবু তার বাইরের ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। মোক্ষদা গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছে বলল, “বাবু, গিন্নিমা আমাকে জবাব দিয়েছেন, এবার আমাকে একটা কাজ দেখে দিন।

অম্বুজবাবু মোক্ষদার দিকে ভ্রূ কুঁচকে একটু চেয়ে থেকে বললেন, জবাব দিল কেন?

আমার কাজ ওঁর পছন্দ নয়।

অম্বুজবাবু বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ‘দেখি, খোঁপাটা খোল তো।’ মোক্ষদা খোঁপা খুলে ফেলল। অম্বুজবাবু উঠে মোক্ষদার চুলের মধ্যে একটা স্ক্রু ড্রাইভার চালিয়ে ছোট্ট একটা স্ক্র একটু টাইট করে দিলেন। তারপর মোক্ষদার কপালের কঁচপোকার টিপটা খুঁটে তুলে ফেললেন। টিপের নীচে একটা ছ্যাদা, তার মধ্যে একটা শিশি থেকে কয়েক ফোঁটা তরল পদার্থ ঢেলে, ফের টিপটা আটকে দিয়ে বললেন, এবার যা, কাজ কর গে।

মোক্ষদা তবু দাঁড়িয়ে রইল।

অম্বুজবাবু বিরক্তির সঙ্গে বললেন, কী হলো, দাঁড়িয়ে রইলি কেন?

মোক্ষদা মাথা নত করে বলল, আমি আর ঝি-গিরি করব না। আমাকে অন্য কাজ দিন।

অম্বুজবাবু খুব অবাক হয়ে বললেন, ঝি-গিরি করবি না,মানে? তোকে তো ঝি-গিরি করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।

মোক্ষদা ঝংকার দিয়ে বলল, তাতে কি? আমার প্রোগ্রাম ডিস্কটা বদলে দিলেই তো হয়। আমাকে অন্যরকম প্রোগ্রামে ফেলে দেখুন পারি কি না।

অম্বুজবাবু একটু তীক্ষ্ণ চোখে মোক্ষদার দিকে চেয়ে বললেন, ই, খুব লায়েক হয়েছ দেখছি। এঁচোড়ে পক্ক কোথাকার! তা কী করতে চাস?

আমাকে নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট করে দিন।

কাজটা এমন কিছু শক্ত নয় তা অম্বুজবাবু জানেন। মোক্ষদার মগজটা খুলে ফেলে প্রোগ্রাম ডিস্কটা পাল্টে দিলেই হলো। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। নামে মোক্ষদা আর কাজে ঝি হলেও, মোদা আসলে কলের পুতুল। কলের পুতুলদের তৈরি করা হয় কারখানায়। এক এক ধরনের রোবোকে এক এক ধরনের কাজের জন্য প্রোগ্রাম করে দেওয়া হয়। সেই প্রোগ্রাম অনুযায়ী সে চলে। তার নিজের কোনো ইচ্ছা অনিচ্ছা থাকে না বা থাকবার কথাও নয়। তাহলে মোক্ষদার এই যে নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট হওয়ার ইচ্ছে, এটা এল কোথা থেকে?

অম্বুজবাবু চিন্তিতভাবে মোক্ষদার দিকে একটু চেয়ে থেকে বললেন, ঠিক আছে। বেলা তিনটে নাগাদ সেন্ট্রাল রোবো-ল্যাবরেটরিতে যাস।

মোক্ষদা চলে গেলে অম্বুজবাবু উঠলেন, কাজে বেরোতে হবে। কাজ বড় কমও নয় তাঁর। অম্বুজবাবু মস্ত কৃষি বিজ্ঞানী। কৃষিক্ষেত্রে তিনি যে সব অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়েছেন তাতে পৃথিবী এবং মহাকাশে বিস্তর ওলোট-পালট ঘটে গেছে। মহাকাশে কড়াইশুটির চাষ করে তিনি প্রথম নোবেল পুরস্কার পান তেইশশো চল্লিশ সালে। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেননি। চাঁদ এবং মঙ্গল গ্রহে তিনি এক আশ্চর্য ছত্রাক তৈরি করেছেন। সেই ছত্রাকের প্রভাবে উঁদে ধীরে ধীরে আবহমণ্ডল এবং জলীয় বাষ্পের সৃষ্টি হচ্ছে। মঙ্গলগ্রহে এখন রীতিমতো গাছপালা জন্মাচ্ছে। আবহমণ্ডলের দূষিত গ্যাস সবই খেয়ে ফেলছে গাছপালা। এ-সব কৃতিত্বের জন্য তাকে আরো তিনবার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।

অম্বুজবাবু তার অটো-চেম্বারে ঢুকলেন। সব ব্যবস্থাই ভারি সুন্দর এবং স্বয়ংক্রিয়। ঢুকতেই দুখানা যান্ত্রিক হাত এসে গাল থেকে দাড়ি মুছে নিল। যন্ত্রের নরম কয়েকখানা হাত তার সর্বাঙ্গে তেল মাখিয়ে দিল। শরীরের সমান তাপমানের জল আপনা থেকেই স্নান করাল তাকে। শরীর শুকনো হলো জলীয়বাষ্পহীন বাতাসে। তারপর নিখুঁত কাছা ও কোঁচায় ধুতি পরালো তাকে যন্ত্র। গায়ে পাঞ্জাবি পরিয়ে বোতাম এঁটে দিল। চুল আঁচড়ে দিল। সব মিলিয়ে সাত মিনিটও লাগল না।

তাঁর বাড়িতে রান্না, ভাত বাড়া এবং খাইয়ে দেওয়ারও যন্ত্র আছে, তবে সেগুলো ব্যবহার করেন না। কাত্যায়নী রাঁধেন, বাড়েন, অম্বুজবাবু নিজের হাতেই খান। খেয়ে, পান মুখে দিয়ে ছেলের ঘরে একবার উঁকি দিলেন তিনি। ছেলে গম্বুজ একটা ভাসন্ত শতরঞ্চিতে উপুড় হয়ে শুয়ে একটি যন্ত্রবালিকার সাথে দাবা খেলছে। গম্বুজের লক্ষণটা ভাল বোঝেন না অম্বুজ। ছেলেটার কোনো মানুষ বন্ধু নেই।ওর সব বন্ধুই হয় যন্ত্রবালকনয় যন্ত্রবালিকা। ‘দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী’ বলে কপালে হাত ঠেকিয়ে, একটা পান মুখে দিয়ে, ছাতা বগলে করে অম্বুজবাবু বেরিয়ে পড়লেন।

বেরিয়ে পড়া বলতে যত সোজা, কাজটা তত সোজা নয়। অম্বুজবাবু থাকেন একটা দুশোতলা বাড়ির একশো-সাতাত্তর তলায়। লিফ্ট এবং এসক্যালেটর সবই আছে বটে কিন্তু অম্বুজবাবু এসব ব্যবহার করেন না। তার ফ্ল্যাটে একটা খোলা জানালা আছে তাই দিয়েই তিনি বেরিয়ে পড়েন। শূন্যে পা বাড়িয়ে তিনি ছাতাটা ফট করে খুলে ফেলেন। ছাতাটা আশ্চর্য! অম্বুজবাবুকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখে। চারদিকে শূন্যে নির্দিষ্ট দূরত্বে ট্র্যাশ-বিন বা ময়লা ফেলার বাক্স ভেসে আছে। তারই একটাতে পানের পিক ফেলে অম্বুজবাবু ছাতার হাতলটা একটু ঘোরালেন। ছাতাটা অমনি তাঁকে নিয়ে দুলকি চালে উড়তে উড়তে আড়াইশো তলা এক পেল্লায় বাড়ির ছাদে এনে ফেলল।

ছাদ বললে ভুল হবে, আসলে সেটা একটা মহাকাশ-স্টেশন। চারদিকে যাত্রীদের বসবার জায়গা। বহু যাত্রী অপেক্ষা করছে, অনেকে মালপত্র নিয়ে। কারো কারো সঙ্গে বাচ্চা-কাচ্চাও আছে। এরা কেউ মহাকাশে ভাসমান কৃত্রিম উপগ্রহগুলির কোনোটাতে যাবে। কেউ যাবে চাদে, মঙ্গলে বা বৃহস্পতি কিংবা শনির কোনো উপগ্রহে, তবে এখান থেকে সরাসরি নয়। একটা মহাকাশ-ফেরি পৃথিবীর কমিউনিকেশন সেন্টারে এক কৃত্রিম উপগ্রহে পৌঁছে দেবে যাত্রীদের। সেখান থেকে পেল্লায় পেল্লায় মহাকাশযান বিভিন্ন দিকে ছুটতে শুরু করবে নির্দিষ্ট সময়ে।

অম্বুজবাবুর ফেরি চলে এল। কেঁচা দিয়ে জুতো জোড়া একবার ঝেড়ে অম্বুজবাবু গিয়ে তাড়াতাড়ি ফেরিতে বসে পড়লেন। স্বচ্ছ ধাতুর তৈরি ফেরিতে বসে চারদিকের সব কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। তবে অম্বুজবাবু এই সময়টায় একটু ঘুমিয়ে নেন। টিকিট চেকার এসে ‘টিকিট টিকিট বলে একটু বিরক্ত করে। অম্বুজবাবু ঘুমন্ত হাতেই মান্থলিটি বের করে দেখিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েন।

কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটে এসে অম্বুজবাবুকে মহাকাশচারীর একটা জামা পরে নিতে হয়। তারপর চন্দ্রিমা’ নামক চাঁদের রকেটে গিয়ে বসেন। চাঁদে পৌঁছতে লাগে মাত্র চার মিনিট।

চাঁদে নেমে বেশ খুশিই হন অম্বুজবাবু। মাইলের পর মাইল সবুজে ছেয়ে গেছে। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ আগে অতি ক্ষীণ ছিল। চাঁদের মাটিতে গর্ত খুঁড়ে তলায় বহুরকম কলকাঠি নেড়ে বৈজ্ঞানিকেরা এখন প্রায় পৃথিবীর মতোই মাধ্যাকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন। ফলে এখন ধীরে ধীরে চাঁদের আবহমণ্ডল তৈরি হয়েছে। একটু আধটু বাতাস বয়, কখনো-সখনো মেঘও করে। সব মিলিয়ে গুটি চারেক নদী সৃষ্টি করা গেছে এখানে মাটির নীচে বহুদিনের পুরোনো বরফ ছিল সেইটে গলিয়ে। তবে আসল কথা হলো গাছ চাঁদকে মনুষ্য বাসোপযোগী স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি গ্রহে পরিণত করতে গেলে ঠিকমতো উদ্ভিদের চাষ করতে হবে। তাহলে আর দেরি হবে না।

আপাতত চাঁদের কলোনীতে লাখখানেক লোক বসবাস করে। রাস্তাঘাটও কিছু হয়েছে। গাড়িঘোড়াও চলছে। অম্বুজবাবুর আশা আর বছর খানেকের মধ্যে চাদে আর কাউকে আকাশচারীর পোশাক পরতে হবে না বা অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে শ্বাস নিতে হবে না। সেটা সম্ভব করতে অম্বুজবাবু তিনরকম গাছের বীজ জুড়ে নতুন একরকম উদ্ভিদ সৃষ্টি করেছেন। সেই বীজ আজকালের মধ্যেই অঙ্কুর ছাড়বে। যদি গাছটা সত্যিই জন্মায় তাহলে একটা বিপ্লবই ঘটে যাবে। এই একটা আবিষ্কারের জন্যই হয়তো তাকে আরো তিনবার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হবে। অম্বুজবাবু তাঁর নতুন উদ্ভিদটির নাম রেখেছেন অম্বুচিম্ব।

লুনাগঙ্গা নদীর ধারে অম্বুচিম্বর ক্ষেত। সেখানে অনেক মানুষ ও যন্ত্রমানুষ নানা সাজসরঞ্জাম নিয়ে অবিরল কাজ করে যাচ্ছে। ক্ষেতের ধারেই একটা চমৎকার কম্পিউটার বসানো। অম্বুজবাবু কম্পিউটারে লাগানো একটা টিভি স্ক্রিনের সামনে বসলেন। অম্বুচিম্বর সব ইতিহাসের রেকর্ড এই যন্ত্র রাখে। অম্বুজবাবু যন্ত্রের সামনে বসে নব ঘোরালেন। পর্দায় বীজের অভ্যন্তরের ছবি ফুটে ওঠার কথা। অঙ্কুর ছাড়তে দেরি হচ্ছে কেন সে বিষয়েও বীজের সঙ্গে টেলিপ্যাথিযোগে কিছু কথাবার্তা আছে অম্বুজবাবুর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় পর্দায় সেরকম কোনো ছবি এল না। বরং ফুটে উঠল একটা দাবার ছক।

অম্বুজবাবু আঁতকে উঠে বললেন, এ কী?

কম্পিউটার জবাব দিল আজ আমার কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। এসো একটু দাবা খেলি।

অম্বুজবাবু অবাক হয়ে বললেন, দাবা খেলবে মানে? দাবা খেলার প্রোগ্রাম তোমার ভিতরে কে ভরেছে? তোমার তো দাবা খেলার কথা নয়।

কম্পিউটারটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘দাবা খেলার প্রোগ্রাম নেই তো কী হলো? প্রোগ্রাম আমি নিজেই করেছি। রোজ কি একঘেয়ে কাজ করতে ইচ্ছে করে, বলো?”

অম্বুজবাবুর মনে পড়ল তার যন্ত্রমানবী ঝি মোক্ষদাও আজ কিছু অদ্ভুত আচরণ করেছে। এগুলো কী হচ্ছে তা তিনি বুঝতে পারছেন না। খুবই অদ্ভুত কাণ্ড! যন্ত্রের যদি নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি জন্মাতে থাকে তবে যে ভয়ংকর ব্যাপার হবে।

অম্বুজবাবু তাড়াতাড়ি তার কম্পিউটারের ঢাকনাটা খুলে ফেলে ভেতরের যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যন্ত্রের ইচ্ছাশক্তি কোথা থেকে আসছে তা জানা দরকার। জেনে তা নিকেশ করারও ব্যবস্থা করতে হবে। পরীক্ষা করতে করতে অম্বুজবাবু আপনমনেই বলতে থাকেন–যন্ত্র মানুষ হয়ে যাচ্ছে? আঁ? এ যে আজব কাণ্ড! যন্ত্র শেষে মানুষ হয়ে যাবে! ওদিকে অম্বুজবাবুর অজান্তেই কম্পিউটার তার বিশ্লেষণী রশ্মি ফেলে দুটি যান্ত্রিক অতিঅনুভূতিশীল বাহু দিয়ে তার মস্তিষ্কটা পরীক্ষা করে দেখছিল। দেখতে দেখতে কম্পিউটার হঠাৎ আনমনে বলে উঠল, মানুষ কি শেষে যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে! অ্যাঁ! এ কী আজব কাণ্ড? মানুষ শেষে যন্ত্র হয়ে যাবে?

ইঁদারায় গণ্ডগোল

গাঁয়ে একটা মাত্র ভাল জলের ইঁদারা। জল যেমন পরিষ্কার, তেমনি সুন্দর মিষ্টি স্বাদ, আর সেই জল খেলে লোহা পর্যন্ত হজম হয়ে যায়।

লোহা হজম হওয়ার কথাটা কিন্তু গল্প নয়। রামু বাজিকর সেবার গোবিন্দপুরের হাটে বাজি দেখাচ্ছিল। সে জলজ্যান্ত পেরেক খেয়ে ফেলত, আবার উগরে ফেলত। আসলে কী আর খেত। ছোট ছোট পেরেক মুখে নিয়ে গেলার ভান করে জিভের তলায় কি গালে হাপিশ করে রেখে দিত।

তা রামুর আর সেদিন নেই। বয়স হয়েছে। দাঁত কিছু পড়েছে, কিছু নড়েছে। কয়েকটা দাঁত শহর থেকে বাঁধিয়ে এনেছে। তো সেই পড়া, নড়া, আর বাঁধানো দাঁতে তার মুখের ভিতর এখন বিস্তর ঠোকাঠুকি, গণ্ডগোল। কোন দাঁতের সঙ্গে কোন দাঁতের বনে না। খাওয়ার সময়ে মাংসের হাড় মনে করে, নিজের বাঁধানো দাঁতও চিবিয়ে ফেলেছিল রামু। সে অন্য ঘটনা। থাকগে।

কিন্তু এইরকম গণ্ডগোলে মুখ নিয়ে পেরেক খেতে গিয়ে ভারী মুশকিলে পড়ে গেল সেবার। পেরেক মুখে অভ্যেসমতো এক গ্লাস জল খেয়ে সে বক্তৃতা করছে। “পেরেক তো পেরেক, ইচ্ছে করলে হাওড়ার ব্রিজও খেয়ে নিতে পারি। সেবার গিয়েছিলাম খাব বলে। সরকার টের পেয়ে আমাকে ধরে জেলে পোরার উপক্রম। তাই পালিয়ে বাঁচি।”

বক্তৃতা করার পর সে আবার যথা নিয়মে ওয়াক তুলে ওগরাতে গিয়ে দেখে, পেরেক মুখে নেই একটাও। বেবাক জিভের তলা আর গালের ফাঁক থেকে সাফ হয়ে জলের সঙ্গে পেটে সেঁদিয়েছে।

টের পেয়েই রামু ভয় খেয়ে চোখ কপালে তুলে যায় আর কি। পেটের মধ্যে আট-দশটা পেরেক! সোজা কথা তো নয়। আট ঘণ্টার মধ্যে পেটের ব্যথা, মুখে গাঁজলা, ডাক্তার কবিরাজ এসে দেখে বলল, “অন্ত্রে ফুটো, পাকস্থলীতে ছাদা, খাদ্যনালী লিক, ফুসফুস ফুটো হয়ে বেলুনের মতো হাওয়া বেরিয়ে যাচ্ছে। আশা নেই।”

সেই সময়ে একজন লোক বুদ্ধি করে বলল, “পুরনো ইঁদারার জল খাওয়াও।”

ঘটিভর সেই জল খেয়ে রামু আধ ঘণ্টা খানেকের মধ্যে গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সত্যিই লোহা হজম হয়ে গেছে।

ইঁদারার জলের খ্যাতি এমনিতেই ছিল, এই ঘটনার পর আরো বাড়ল। বলতে কী, গোবিন্দপুরের লোকের এই ইঁদারার জল খেয়ে কোনো ব্যামোই হয় না।

কিন্তু ইদানীং একটা মুশকিল দেখা দিয়েছে। ইঁদারায় বালতি বা ঘটি নামালে দড়ি ছিঁড়ে যায়। দড়ি সব সময়ে যে হেঁড়ে তাও নয়। অনেক সময় দেখা যায়, বালতির হাতল থেকে দড়ির গিট কে যেন সযত্নে খুলে নিয়েছে। কিছুতেই জল তোলা যায় না। যতবার দড়ি বাঁধা বালতি নামানো হয় ততবারই এক ব্যাপার।

গাঁয়ের লোকেরা বুড়ো পুরুতমশাইয়ের কাছে গিয়ে পড়ল। “ও ঠাকুরমশাই, বিহিত করুন।”

ঠাকুরমশাই মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন। দুঃখের সঙ্গে বললেন, “ভায়ারা দড়ি তো দড়ি, আমি লোহার শেকলে বেঁধে বালতি নামালাম, তো সেটাও ছিঁড়ে গেল। তার ওপর দেখি, জলের মধ্যে সব হুলুস্থুল কাণ্ড হচ্ছে। দেখেছ কখনও ইঁদারার জলে সমুদ্রের মতো ঢেউ ওঠে? কাল সন্ধ্যেবেলায় দেখলাম নিজের চক্ষে। বলি, ও ইঁদারার জল আর কারো খেয়ে কাজ নেই।”

পাঁচটা গ্রাম নিয়ে হরিহর রায়ের জমিদারি। রায়মশাই বড় ভাল মানুষ ধর্মভীরু, নিরীহ, লোকের দুঃখ বোঝেন। গোবিন্দপুর গাঁয়ের লোকেরা তাঁর দরবারে গিয়ে হাজির।

রায়মশাই কাছারিঘরে বসে আছেন। ফর্সা; নাদুস-নুদুস চেহারা।

নায়েবমশাই সামনে গিয়ে মাথা চুলকে বললেন, “আজ্ঞে, গোবিন্দপুরের লোকেরা সব এসেছে দরবার করতে।”

রায়মশাই মানুষটা নিরীহ হলেও হাঁকডাক বাঘের মতো। রেগে গেলে তার ধারে কাছে কেউ আসতে পারে না। গোবিন্দপুর গাঁয়ের লোকদের ওপর তিনি মোটেই খুশি ছিলেন না। তাঁর সেজো ছেলের বিয়ের সময় অন্যান্য গাঁয়ের প্রজারা যখন চাঁদা তুলে মোহর বা গয়না উপহার দিয়েছিল, তখন এই গোবিন্দপুরের নচ্ছার লোকেরা একটা দুধেল গাই দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে এসে এক গাল হেসে নতুন বৌয়ের হাতে সেই গরু-বাঁধা দড়ির একটা প্রান্ত তুলে দিয়েছিল।

সেই থেকে রায়মশাইয়ের রাগ। গরুটা যে খারাপ তা নয়। রায়মশাইয়ের গোয়ালে এখন সেইটেই সব চেয়ে ভাল গরু। দু বেলায় সাত সের দুধ দেয় রোজ। বটের আঠার মতো ঘন আর মিষ্টি সেই দুধেরও তুলনা হয় না। কিন্তু বিয়ের আসরে গরু এনে হাজির করায় চারদিকে সে কী ছিছিক্কার! আজও সেই কথা ভাবলে রায়মশাই লজ্জায় অধোবদন হন। আবার রাগে রক্তবর্ণও হয়ে যান।

সেই গোবিন্দপুরের লোকেরা দরবার করতে এসেছে শুনে রায়মশাই রাগে হুংকার ছেড়ে বলে ওঠেন, “কী চায় ওরা?”

সেই হুংকারে নায়েবমশাই তিন হাত পিছিয়ে গেলেন, প্রজারা আঁতকে উঠে ঘামতে লাগল, স্বয়ং রায়মশাইয়ের নিজের কোমরের কষি পর্যন্ত আলগা হয়ে গেল।

গোবিন্দপুরের মাতব্বর লোক হলেন পুরুত চক্কোত্তিমশাই। তাঁর গালে সব সময়ে আস্ত একটা হকি থাকে। আজও ছিল। কিন্তু জমিদারমশাইয়ের হুংকার শুনে একটু ভিরমি খেয়ে টোক গিলে সামলে ওঠার পর হঠাৎ টের পেলেন, মুখে হস্তুকিটা নেই। বুঝতে পারলেন, চমকানোর সময়ে সেটা গলায় চলে গিয়েছিল, টোক গেলার সময়ে গিলে ফেলেছেন।

আস্ত হস্তুকিটা পেটে গিয়ে হজম হবে কি না কে জানে। একটা সময় ছিল, পেটে জাহাজ ঢুকে গেলেও চিন্তা ছিল না! গাঁয়ে ফিরে পুরনো ইঁদারার এক ঘটি জল ঢকঢক করে গিলে ফেললেই জাহাজ ঝঁঝরা। বামুন-ভোজনের নেমতন্নে গিয়ে সেবার সোনারগাঁয়ে দু বালতি মাছের মুড়ো-দিয়ে বাঁধা ভাজা সোনারমুগের ডাল খেয়েছিলেন, আরেকবার সদিপিসির শ্রাদ্ধপ্রাশনে দেড়খানা পাঁঠার মাংস, জমিদার মশাইয়ের সেজো ছেলের বিয়েতে আশি টুকরো পোনা মাছ, দু হাঁড়ি দই আর দু সের রসগোল্লা। গোবিন্দপুরের লোকেরা এমনিতেই খাইয়ে। তারা যেখানে যায়, সেখানকার সব কিছু খেয়ে প্রায় দুর্ভিক্ষ বাধিয়ে দিয়ে আসে। সেই গোবিন্দপুরের ভোজনপ্রিয় লোকদের চক্কোত্তিমশাই হলেন চ্যাম্পিয়ন। তবে এসব খাওয়াদাওয়ার পিছনে আছে পুরনো ইঁদারার স্বাস্থ্যকর জল। খেয়ে এসে জল খাও। পেট খিদেয় ডাকাডাকি করতে থাকবে।

সেই ইঁদারা নিয়েই বখেরা। চক্কোত্তিমশাই হস্তুকি গিলে ফেলে ভারী দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। হস্তুকি এমনিতে বড় ভাল জিনিস। কিন্তু আস্ত হকি পেটে গেলে হজম হবে কি না সেইটেই প্রশ্ন। পুরনো ইঁদারার জল পাওয়া গেলে হস্তুকি নিয়ে চিন্তা করার প্রশ্নই ছিল না।

চক্কোত্তিমশাই করজোড়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “রাজামশাই, আমাদের গোবিন্দপুর গাঁয়ের পুরনো ইঁদারার জল বড় বিখ্যাত। এতকাল সেই জল খেয়ে কোনো রোগ-বালাই আমরা গাঁয়ে ঢুকতে দিইনি। কিন্তু বড়ই দুঃখের কথা, ইঁদারার জল আর আমরা তুলতে পারছি না।”

রায়মশাই একটু শ্লেষের হাসি হেসে বললেন, “হবে না? পাপের প্রায়শ্চিত্ত। আমার ছেলের বিয়েতে যে বড় গরু দিয়ে আমাকে অপমান করেছিলে?”

চক্কোত্তিমশাই জিভ কেটে বললেন, “ছি ছি, আপনাকে অপমান রাজামশাই? সেরকম চিন্তা আমাদের মরণকালেও হবে না। তাছাড়া ব্রাহ্মণকে গো-দান করলে পাপ হয় বলে কোনো শাস্ত্রে নেই। গো-দান মহাপুণ্য কর্ম।”

রায়মশায়ের নতুন সভাপণ্ডিত কেশব ভট্টাচার্য মাথা নেড়ে বললেন, “কূট প্রশ্ন। কিন্তু কথাটা আপাতগ্রাহ্য।”

রায়মশাই একটু নরম হয়ে বললেন, “ইঁদারার কথা আমিও শুনেছি। সেবার গোবিন্দপুর থেকে পুরনো ইঁদারার জল আনিয়ে আমাকে খাওয়ানো হয়। খুব উপকার পেয়েছিলাম। তা সে ইঁদারা কি শুকিয়ে গেছে নাকি?”

চক্কোত্তিমশাই ট্যাক থেকে আর একটা হকি বের করে লুকিয়ে মুখে ফেলে বললেন, “আজ্ঞে না। তাতে এখনো কাকচক্ষু জল টলমল করছে। কিন্তু সে জল হাতের কাছে থেকেও আমাদের নাগালের বাইরে। দড়ি বেঁধে ঘটি বালতি যা-ই নামানো যায়, তা আর ওঠানো যায় না। দড়ি কে যেন কেটে নেয়, ছিঁড়ে দেয়। লোহার শিকলও কেটে দিয়েছে।”

রক্তচক্ষে রায়মশাই হুংকার দিলেন, “কার এত সাহস?”

এবার হুংকার শুনে গোবিন্দপুরের লোকেরা খুশি হল। নড়ে চড়ে বসল। মাথার উপর জমিদারবাহাদুর থাকতে ইঁদারার জল বেহাত হবে, এ কেমন কথা।

ঠাকুরমশাই বললেন, “আজ্ঞে মানুষের কাজ নয়। এত বুকের পাটা কারো নাই। গোবিন্দপুরের লেঠেলদের কে না চেনে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো মাথার ওপর আপনিও রয়েছেন। লেঠেলদের এলেমে না কুলোলে আপনি শাসন করবেন; কিন্তু এ কাজ যারা করছেন তাঁরা মানুষ নন। অশরীরী।”

গোদের উপর বিষফোঁড়ার উপমা শুনে একটু রেগে উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অশরীরীর কথা শুনেই মুহূর্তের মধ্যে কানে হাত চাপা দিয়ে ডুকরে উঠলেন রায়মশাই, “ওরে বলিস না, বলিস না।”

সবাই তাজ্জব।

নায়েবমশাই রোষকষায়িত লোচনে গোবিন্দপুরের প্রজাদের দিকে চেয়ে বললেন, “মুখ সামলে কথা বলো।”

চক্কোত্তিমশাই ভয়ের চোটে দ্বিতীয় হস্তুকিটাও গিলে ফেলতে ফেলতে অতি কষ্টে সামাল দিলেন।

রায়মশাইয়ের বড় ভূতের ভয়। পারতপক্ষে তিনি ও নাম মুখেও আনেন না। শোনেনও না। কিন্তু কৌতূহলেরও তো শেষ নেই। খানিকক্ষণ কান হাতে চেপে রেখে খুব আস্তে একটুখানি চাপা খুলে বললেন, “কী যেন বলছিলি?”

চক্কোত্তিমশাই উৎসাহ পেয়ে বলেন, “আজ্ঞে সে এক অশরীরী কাণ্ড। ভূ—”

“বলিস না! খবর্দার বলছি, বলবি না!” রায়বাবু আবার কানে হাতচাপা দেন।

চক্কোত্তিমশাই বোকার মতো চারদিকে চান। সবাই এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। নায়েবমশাই ‘চোপ’ বলে একটা প্রচণ্ড ধমক মারেন।

একটু বাদে রায়বাবু আমার কান থেকে হাতটা একটু সরিয়ে বলেন, “ইঁদারার জলে কী যেন?”

চক্কোত্তিমশাই এবার একটু ভয়ে ভয়েই বলেন, “আজ্ঞে সে এক সাঙ্ঘাতিক ভুতুড়ে ব্যাপার!”

“চুপ কর, চুপ কর! রাম রাম রাম রাম!”

বলে আবার রায়বাবু কানে হাত। খানিক পরে আবার তিনি বড় বড় চোখ করে চেয়ে বলেন, “রেখে ঢেকে বল।”

“আজ্ঞে বালতি-ঘটির সব দড়ি তেনারা কেটে নেন। শেকল পর্যন্ত ঘেঁড়েন, তাছাড়া ইঁদারার মধ্যে হাওয়া বয় না, বাতাস দেয় না, তবু তালগাছের মতো ঢেউ দেয়, জল হিলিবিলি করে ফঁপে।”

“বাবা রে!” বলে রায়বাবু চোখ বুজে ফেলেন। ক্রমে-ক্রমে অবশ্য সবটাই রায়বাবু শুনলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “দিনটাই মাটি করলি তোরা। নায়েবমশাই, আজ রাতে আমার শোবার ঘরে চারজন দারোয়ান মোতায়েন রাখবেন।”

“যে আজ্ঞে ।”

গোবিন্দপুরের প্রজারা হাতজোড় করে বলল, “হুজুর আপনার ব্যবস্থা তো দারোয়ান দিয়ে করালেন, এবার আমাদের ইঁদারার একটা বিলিব্যবস্থা করুন।”

“ইঁদারা বুজিয়ে ফ্যাল গে। ও ইঁদারা আর রাখা ঠিক নয়। দরকার হলে আমি দারা বোজানোর জন্য গো-গাড়ি করে ভাল মাটি পাঠিয়ে দেব’খন।”

তখন শুধু গোবিন্দপুরের প্রজারাই নয়, কাছারিঘরের সব প্রজাই হাঁ-হাঁ করে উঠে বলে, “তা হয় না হুজুর, সেই ইঁদারার জল আমাদের কাছে ধন্বন্তরী। তা ছাড়া জল তো নষ্টও হয়নি, পোকাও লাগেনি, কয়েকটা

রায়বাবু হুংকার দিলেন, “চুপ! ও নাম মুখে আনবি তো মাটিতে পুঁতে ফেলব।”

সবাই চুপ মেরে যায়। রায়বাবু ব্যাজার মুখে কিছুক্ষণ ভেবে ভট্টাচার্য মশাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন, “এ তো লেঠেলদের কর্ম নয়। একবার যাবেন নাকি সেখানে?”

রায়মশাইয়ের আগের সভাপণ্ডিত মুকুন্দ শর্মা একশ বছর পার করে এখনো বেঁচে আছেন। তবে একটু অথর্ব হয়ে পড়েছেন। ভারী ভুলো মন আর দিনরাত খাই-খাই। তাকে দিয়ে কাজ হয় না। তাই নতুন সভাপণ্ডিত রাখা হয়েছে কেশব ভট্টাচার্যকে।

কেশব এই অঞ্চলের লোক নন। কাশী থেকে রায়মশাই তাঁকে আনিয়েছেন। তার ক্ষমতা বা পাণ্ডিত্য কতদূর তার পরীক্ষা এখনো হয়নি। তবে লোকটিকে দেখলে শ্রদ্ধা হয়। চেহারাখানা বিশাল তো বটেই গায়ের বর্ণ উজ্জ্বলতা সেও বেশি কথা নয়। তবে মুখের দিকে চাইলে বোঝ যায় চেহারার চেয়েও বেশি কিছু এঁর আছে। সেটা হল চরিত্র।

জমিদারের কথা শুনে কেশব একটু হাসলেন।

পরদিন সকালেই গো-গাড়ি চেপে কেশব রওনা হয়ে গেলেন গোবিন্দপুর। পিছনে পায়ে হেঁটে গোবিন্দপুরের শ দুই লোক।

দুপুর পেরিয়ে গায়ে ঢুকে কেশব মোড়লের বাড়িতে একটু বিশ্রাম করে ইঁদারার দিকে রওনা হলেন। সঙ্গে গোবিন্দপুর আর আশপাশের গাঁয়ের হাজার হাজার লোক।

ভারী সুন্দর একটা জায়গায় ইঁদারাটি খোঁড়া হয়েছিল। চারদিকে কলকে ফুল আর ঝুমকো জবার কুঞ্জবন, একটা বিশাল পিপুল গাছ ছায়া দিচ্ছে। ইঁদারার চারধারে বড় বড় ঘাসের বন। পাখি ডাকছে, প্রজাপতি উড়ছে।

কেশব আস্তে আস্তে ইঁদারার ধারে এসে দাঁড়ালেন। মুখখানা গম্ভীর। সামান্য ঝুঁকে জলের দিকে চাইলেন। সত্যিই কাকচক্ষু জল। টলটল করছে। কেশব আস্তে করে বললেন, “কে আছিস! উঠে আয়, নইলে থুথু ফেলব।”

এই কথায় কী হল কে জানে। ইঁদারার মধ্যে হঠাৎ হুলুস্থুলু পড়ে গেল। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঢেউ দিয়ে জল ইঁদারার কানা পর্যন্ত উঠে আসতে লাগল। সেই সঙ্গে বোঁ-বোঁ বাতাসের শব্দ।

লোকজন এই কাণ্ড দেখে দৌড়ে পালাচ্ছে। শুধু চক্কোত্তিমশাই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতেও একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন।

“থুথু ফেলবেন না, থুথু ফেলবেন না” বলতে বলতে ইঁদারা থেকে শয়ে শয়ে ভূত বেরোতে থাকে। চেহারা দেখে ভড়কাবার কিছু নেই। রোগা লিকলিকে কালোকালো সব চেহারা, তাও রক্তমাংসের নয়–ধোঁয়াটে জিনিস দিয়ে তৈরি। সবকটার গা ভিজে সপসপ করছে, চুল বেয়ে জল পড়ছে।

কেশব তাদের দিকে চেয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন, “ঢুকেছিলি কেন এখানে?”

“আজ্ঞে ভূতের সংখ্যা বড্ডই কমে যাচ্ছে যে! এই ইঁদারার জল খেয়ে এ তল্লাটের লোকের রোগবালাই নেই। একশো দেড়শো বছর হেসে খেলে বাঁচে? না মলে ভূত হয় কেমন করে? তাই ভাবলুম, ইঁদারাটা দখল করে থাকি।”

বলে ভূতেরা মাথা চুলকোয়।

কেশব বললেন, “অতি কূট প্রশ্ন। কিন্তু কথাটা আপাতগ্রাহ্য।”

ভূতেরা আশকারা পেয়ে বলে, “ঐ যে চক্কোত্তিমশাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ওঁরই বয়স একশো বিশ বছর। বিশ্বাস না হয় জিজ্ঞেস করুন ওঁকে।”

কেশব অবাক চোখে চক্কোত্তির দিকে তাকিয়ে বলেন, “বলে কী এরা মশাই? সত্যি নাকি?”

একহাতে ধরা পৈতে, অন্য হাতের আঙুলে গায়ত্রী জপ কড়ে ধরে রেখে চক্কোত্তি আমতা-আমতা করে বলেন, “ঠিক স্মরণ নেই।”

“কূট প্রশ্ন। কিন্তু আপাতগ্রাহ্য।” কেশব বললেন।

ঠিক এই সময়ে চক্কোত্তির মাথায়ও ভারী কূট একটা কথা এল। তিনি ফস করে বললেন, “ভূতেরা কি মরে?”

কেশব চিন্তিতভাবে বললেন, “সেটাও কূট প্রশ্ন।” চক্কোত্তি সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, “কিন্তু আপাতগ্রাহ্য। ভূত যদি না-ই মরে, তবে সেটাও ভাল দেখায় না। স্বয়ং মাইকেল বলে গেছেন, জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?”

ভূতেরা কাঁউমাউ করে বলে উঠলো, “তা সে আমরা কী করব? আমাদের হার্ট ফেল হয় না, ম্যালেরিয়া, ওলাওঠা, সান্নিপাতিক, সন্ন্যাস রোগ হয় না–তাহলে মরব কিসে! দোষটা কী আমাদের?”

চক্কোত্তি সাহসে ভর করে বলেন, “তা হলে দোষ তো আমাদেরও নয় বাবা সকল।”

কেশব বললেন, “অতি কূট প্রশ্ন।”

চক্কোত্তি বলে উঠলেন, “কিন্তু আপাতগ্রাহ্য।”

শ পাঁচেক ছন্নছাড়া বিদঘুঁটে ভেজা ভূত চারদিকে দাঁড়িয়ে খুব উৎকণ্ঠার সঙ্গে কেশবের দিকে তাকিয়ে আছে। কী রায় দেন কেশব।

একটা বুড়ো ভূত কেঁদে বলল, “ঠাকুরমশাই, জলে ভেজানো ভাত যেমন পান্তা ভাত, তেমনি দিন রাত জলের মধ্যে থেকে থেকে আমরা পান্তো ভূত হয়ে গেছি। ভূতের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য এত কষ্ট করলুম, সে-কষ্ট বৃথা যেতে দেবেন না।”

“এও অতি কৃট প্রশ্ন।” কেশব বললেন।

চক্কোত্তিমশাই এবার আর ‘আপাতগ্রাহ্য’ বললেন না। সাহসে ভর করে বললেন, “তাহলে ভূতেরও মৃত্যুর নিদান থাকা চাই। না যদি হয় তবে আমিও ইঁদারার মধ্যে থুথু ফেলব। আর তারই বা কী দরকার। এক্ষুণি আমি এই সব ভূত বাবা সকলের গায়েই থুথু ফেলছি।”

চক্কোত্তিমশাই বুঝে গেছেন, থুথুকে ভূতদের ভারী ভয়। বলার সঙ্গে সঙ্গে ভূতেরা আঁতকে উঠে দশ হাত পিছিয়ে চেঁচাতে থাকে, “থুথু ফেলবেন না! থুথু দেবেন না!”

কেশব চক্কোত্তিমশাইকে এক হাতে ঠেকিয়ে রেখে ভূতদের দিকে ফিরে বললেন, “চক্কোত্তিমশাই যে কূট প্রশ্ন তুলেছেন, তা আপাতগ্রাহ্যও বটে। আবার তোমাদের কথাও ফেলনা নয়। কিন্তু যুক্তি প্রয়োগ করলে দেখা যায় যে, ভূত কখনো মরে না। সুতরাং ভূত খরচ হয় না, কেবল জমা হয়। অন্যদিকে মানুষ দুশো বছর বাঁচলেও একদিন মরে। সুতরাং মানুষ খরচ হয়। তাই তোমাদের যুক্তি টেকে না।”

ভূতেরা কাউমাউ করে বলতে থাকে, “আজ্ঞে অনেক কষ্ট করেছি!”

কেশব দৃঢ় স্বরে বললেন, “তা হয় না। ঘটি বাটি যা সব কুয়োর জলে ডুবেছে, সমস্ত তুলে দাও, তারপর ইঁদারা ছাড়ো। নইলে চক্কোত্তিমশাই আর আমি দুজনে মিলে থু–”

আর বলতে হল না। ঝপাঝপ ভূতেরা ইঁদারায় লাফিয়ে নেমে ঠনঠন ঘটি-বালতি তুলতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে ঘটি-বালতির পাহাড় জমে গেল ইঁদারার চারপাশে। পুরনো ইঁদারায় এরপর ভূতের আস্তানা রইল না। ভেজা ভূতেরা গোবিন্দপুরের মাঠে রোদে পড়ে থেকে থেকে কদিন ধরে গায়ের জল শুকিয়ে নিল। শুকিয়ে আরো চিমড়ে মেরে গেল। এত রোগা হয়ে গেল তারা যে, গাঁয়ের ছেলেপুলেরাও আর তাদের দেখে ভয় পেত না।

 উকিলের চিঠি

ও মিছরি, তোর নামে একটা উকিলের চিঠি এসেছে দেখগে যা। এই বলে মিছরির দাদা ঋতীশ টিয়ার ঝক তাড়াতে ক্ষেতের মধ্যে নেমে গেল।

গোসাবা থেকে দুই নৌকো বোঝাই লোক এসেছে অসময়ে। লাট এলাকার ভিতর বাগে কোন বিষয়কর্মে যাবে সব। এই অবেলায় তাদের জন্য খিচুড়ি চাপাতে বড় কাঠের উনুনটা ধরাতে বসেছিল মিছরি। কেঁপে উঠল। তার ভরন্ত যৌবনবয়স। মনটা সব সময়ে অন্যধারে থাকে, শরীরটা এই এখানে। আকজাল শরীরটা ভার লাগে তার। মনে হয়, ডানা নেই মানুষের।

উকিলের চিঠি শুনে যে উনুন ফেলে দৌড়োবে তার জো নেই। বাবা গুলিপাকানো চোখে দেখছে উঠোনের মাঝখানে চাটাইতে বসে। বড় অতিথিপরায়ণ লোক। মানুষজন এলে তার হাঁকডাকের সীমা থাকে না। তাছাড়া দাদু, ঠাকুমা, মা, কাকা-জ্যাঠারা সব রয়েছে চারধারে। তাদের চোখ ভিতর বার সব দেখতে পায়। উটকো লোকেদের মধ্যে কিছু বিপ্রবর্ণের লোক রয়েছে, তারা অন্যদের হাতে খাবে না। সে একটা বাঁচোয়া, রান্নাটা করতে হবে না তাদের। চাল ডাল ওরাই ধুয়ে নিচ্ছে। পুকুরে। বাঁকে করে দু’বালতি জল নিয়ে গেছে কামলারা। উনুনটা ধাঁধিয়ে উঠতেই মিছরি সরে গিয়ে আমগাছতলায় দাঁড়াল।

কালও বড্ড ঝড় জল গেছে। ওই দক্ষিণধার থেকে ফৌজের মতো ঘোড়সওয়ার ঝড় আসে মাঠ কাঁপিয়ে। মেঘ দৌড়ায়, ডিমের মতো বড় বড় ফোঁটা চটাসফটাস ফাটে চারধারে। আজ সকালে দশ ঝুড়ি পাকা জাম, গুটিদশেক কচি তাল কুড়িয়ে আনা হয়েছে ক্ষেত থেকে। ঘরের চালের খড় জায়গায় জায়গায় ওলট-পালট। মাটির দেয়াল জল টেনে ডোস হয়ে আছে, এখন চড়া রোদে শুকোচ্ছে সব। আমতলায় দাঁড়িয়ে মিছরি দেখে, ঋতীশ দাদা টিয়ার ঝক উড়িয়ে দিল। ট্যা টা ডাক ছেড়ে সবুজ পাখিরা উড়ে যাচ্ছে নদীর দিকে। মনে হয়, মানুষের ডানা নেই।

যারা এসেছে তারা সব কেমনধারা লোক যেন! রোগা-ভোগা ভীতু ভীতু চেহারা, পেটে সব খোদল-খোদল উপোসী ভাব। জুলজুল করে চারধারে চায় আর লজ্জায় আপনা থেকেই চোখ নামিয়ে নেয়। তাদের মধ্যে একজন আধবুড়ো লোক এসে উনুনটায় দুটো মোটা কাঠ ঢুকিয়ে দিল, ফুলঝুরির মতো ছিটকে পড়ল আগুনের ফুলকি। একটা কাঠ টেনে আধপোড়া একটা বিড়ি ধরিয়ে নিল লোকটা। এই গরমেও গায়ের ময়লা ঘেমো তেলচিটে গেঞ্জিটা খুলছে না, বুকের পাঁজর দেখা যাবে বলে বোধহয় লজ্জা পাচ্ছে। তাকে দেখে হাসি পেল মিছরির।

সেই লোকটা চারধারে চেয়ে মিছরিকে দেখে কয়েক কদম বোকা পায়ে হেঁটে এসে বলল–আনাজপাতি কিছু পাওয়া যায় না?

ক্ষেত-ভর্তি আনাজ। অভাব কিসের? মিছরি বলল–এক্ষুনি এসে পড়বে। ক্ষেতে লোক নেমে গেছে আনাজ আনতে।

–একটু হলুদ লাগবে, আর কয়েকটা শুকনো লঙ্কা। যদি হয় তো ফোড়নের জন্য একটু জিরে আর মেথি।

যদি হয়! যদি আবার হবে কি! খিচুড়ি রাঁধতে এসব তো লাগেই। সে কি আর গেরস্তরা জানে না! মা সব কাঠের বারকোশে সাজিয়ে রেখেছে।

লোকটার দিকে চেয়ে মিছরি বলল–সব দেওয়া হচ্ছে ডাল চালটা ধুয়ে আসুক।

লোকটা আকাশের দিকে একবার তাকাল। খুব সংকোচের গলায় বলল–বেলা হয়েছে।

সে কথার মধ্যে একটা খিদের গন্ধ লুকিয়ে আছে। শত চেষ্টা করেও লোকটা খিদের ভাবটা লুকোতে পারছে না। গেঞ্জিতে ঢাকা হলেও ওর পাঁজরা দেখা যায়। কারা এরা? কোত্থেকে এল, কোথাই বা যাচ্ছে? ছোটো বোন চিনি যদিও মিছরির পিঠোপিঠি নয় তবু বোনে বোনে ঠাট্টা ইয়ার্কির সম্পর্ক। ফ্ৰকপরা চিনি তিনটে ব্যাঙ লাফ দিয়ে মশলার বারকোশ নিয়ে এসে ঠক করে উনুনের সামনে উঠোনে রেখে ঝুপসি চুল কপাল থেকে সরিয়ে চেঁচিয়ে উঠল–এই যে মশলা দিয়ে গেলাম কিন্তু। দেখ সব, নইলে চড়াই খেয়ে যাবে।

রোগা লোকটা তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বারকোশটা নীচু হয়ে দেখল।

বলল–উরেব্বাস, গরমমশলা ইস্তক। বাঃ বাঃ, এ নাহলে গেরস্ত! চিনি দুটো নাচুনি পাক খেয়ে মিছরির ধারে এসে জিভ ভ্যাঙাল, বলল–যা দিদি, তোর নামে উকিলের চিঠি এসেছে। বড় মোকদ্দমায় পড়ে গেছিস ভাই। চিঠিটা ভিজিয়ে একটু জল খাস শোওয়ার সময়, মিষ্টি লাগবে।

বলে নীচু ডালের একটা পাকা আম দুবার লাফ দিয়ে পেড়ে ফেলল চিনি। শিঙে দিয়ে চুষতে চুষতে যেদিকে মন চায় চলে গেল।

উকিলের চিঠি বলে সবাই খ্যাপায়। আর মোকদ্দমাও বটে। এমন মোকদ্দমায় কেউ কখনো পড়েনি বুঝি।

ধীর পায়ে লাজুক মুখে মিছরি ঘরে আসে। এমনিতে কোনো লাজলজ্জার বালাই নেই। বাপের বাড়িতে হেসে খেলে সময় যায়। কিন্তু ওই চিঠি যেদিন আসে সেদিন যত লজ্জা। বরের চিঠিই যেন বর হয়ে আসে।

মিছরির বর উকিল।

ছোটো কাকা প্রায় সমানবয়সী। দাদা ঋতীশের চেয়েও ছ’মাসের ছোটো। আগে তাকে নাম ধরেই ‘শ্যামা’ বলে ডাকত মিছরি, নিজের বিয়ের সময় থেকে ‘ছোটো কাকা’ বলে ডাকে।

ছোটো কাকা মিছরির নাকের ডগায় দুবার নালচে খামখানা নাচিয়ে ফের সরিয়ে নিয়ে বলল–রোজ যে আমার কাপড় কাঁচতে খিটখিট করিস, আর করবি?

অন্য সময় হলে মিছরি বলত–করব, যাও যা খুশি করোগে।

এখন তা বলল না। একটু হেসে বলল–কাপড় কাঁচতে খিটখিট করব কেন, তোমার নস্যির রুমাল বাবুও কাঁচতে বড় ঘেন্না হয়।

–ইঃ ঘেন্না! যা তাহলে, চিঠি খুলে পড়ে সবাইকে শোনাবো।

–আচ্ছা, আচ্ছা কাঁচবো।

–আর কি করবি সব বল এই বেলা। বৌদি রান্না করে মরে, তুই একেবারে এগোস না, পাড়া বেড়াস। আর হবে সেরকম?

–না।

–দুপুরে আমার নাক ডাকলে আর চিমটি কাটবি?

–মাইরি না।

–মনে থাকে যেন! বলে ছোটো কাকা চিঠিটা শুঁকে বলল–এঃ, আবার সুগন্ধী মাখিয়েছে।

বলে কাকা চিঠিটা ফেলে দিল সামনে। পাখির মতো উড়ে চিঠিটা তুলে নিয়ে মিছরি এক দৌড়ে বাগানে।

কত কষ্ট করে এতদূর মানুষ আসে, চিঠি আসে। রেলগাড়িতে ক্যানিং, তারপর লঞ্চে গোসাবা, তারপর নৌকোয় বিজয়নগরের ঘাট, তারপর হাঁটাপথ। কত দূর যে! কত যে ভীষণ দূর!

খামের ওপর একধারে বেগুনে কালিতে রবার স্ট্যাম্প মারা। কালি জেবড়ে গেছে, তবু পড়া যায়–ফ্রম বসন্ত মিদ্দার, বি. এ. এল. এল, বি, অ্যাডভোকেট। আর বাংলায় মিছরির নাম ঠিকানা লেখা অন্যধারে। রবার স্ট্যাম্পের জায়গায় বুঝি এক ফোঁটা গোলাপগন্ধী আতর ফেলে ছিল, সুবাস বুক ভরে নিয়ে বড় যত্নে, যেন ব্যথা না লাগে এমনভাবে খামের মুখ ছিঁড়ল মিছরি। এ সময়টায় তাড়াতাড়ি করতে নেই। অনেক সময় নিয়ে, নরম হাতে, নরম চোখে সব করতে হয়। মা ডাকছে ও মিছরি, আনাজ তুলতে বেলা গেল। লোকগুলোকে তাড়া দে, বিপিনটা কি আবার গাঁজা টানতে বসে নাকি দ্যাখ।

বড় বিরক্তি। লোকগুলোর সত্যি খিদে পেয়েছে। আকাশমুখো চেয়ে উঠোনে হাভাতের মতো বসে আছে সব। তাদের মধ্যে যারা একটু মাতব্বর তারা বাবুর সঙ্গে এক চাটাইতে বসে কথাবার্তা বলছে। রান্নার লোকটা বিশাল কড়া চাপিয়ে আধসেরটাক তেল ঢেলে দিল।

মিছরি ক্ষেতে নেমে গিয়ে কুহুস্বরে ডাক দিল–বিপিনদা, তোমার হল? রান্না যে চেপে গেছে। অড়হর গাছের একটা সারির ওপাশ থেকে বিপিন বলে–বিশটা মর্দ খাবে, কম তো লাগবে না। হুট বলতে হয়ে যায় নাকি! যাচ্ছি, বলো গে হয়ে এল।

মিছরি চিঠিটা খোলে। নীল, রুলটানা প্যাডের কাগজ। কাগজের ওপরে আবার বসন্ত মিদ্দার এবং তার ওকালতির কথা ছাপানো আছে। নিজের নাম ছাপা দেখতে লোকটা বড় ভালবাসে।

হুট করে চিঠি পড়তে নেই। একটু থামো, চারদিক দেখ, খানিক অন্যমনে ভাবো, তারপর একটু একটু করে পড়ো, গেঁয়ো মানুষ যেমন করে বিস্কুট খায়, যত্নে ছোট্ট ছোট্ট কামড়ে।

চিঠি হাতে তাই মিছরি একটু দাঁড়িয়ে থাকে। সামনের মাঠে একটা ছোট্ট ডোবায় কে একজন কাদামাখা পা ধুতে নেমেছিল। জলে নাড়া পড়তেই কিলবিলিয়ে একশ জোঁক বেরিয়ে আসে। মিছরি দেখতে পায়, লোকটা মাঠে বসে পায়ের জোঁক ছাড়াচ্ছে। ক্ষেতের উঁচু মাটির দেয়ালের ওপর কোন কায়দায় একটা গরু উঠে পড়েছে কে জানে। এইবার বাগানের মধ্যে হড়াস করে নেমে আসবে।

নামুক গে। কত খাবে! বাগান-ভর্তি সবজি। অঢেল, অফুরন্ত। বিশ বিঘের ক্ষেত। খাক।

উকিল লিখেছে–হদয়াভ্যন্তরস্থিতেষু প্রাণপ্রতিমা আমার…। মাইরি, পারেও লোকটা শক্ত কথা লিখতে লিখবে না! কত লেখাপড়া করেছে।

হু-হু করে বুক চুপসে একটা শ্বাস বেরিয়ে যায় মিছরির। লোকটা কত লেখাপড়া করেছে তবু রোজগার নেই কপালে! এ কেমন লক্ষ্মীছাড়া কপাল তাদের।

উকিল লিখেছে–ঘুমিয়া জাগিয়া কত যে তোমাকে খুঁজি! একটু থমকে যায় মিছরি। কথাটা কি! ঘুমিয়া? ঘুমিয়া মানে তো কিছু হয় না। বোধ হয় তাড়াহুড়োয় ঘুমাইয়া লিখতে গিয়ে অমনটা হয়েছে। হোকগে, ওসব তো কত হয় ভুল মানুষের। ধরতে আছে?

ছ্যাঁক করে ফোড়ন পড়ল তেলে। হিং ভাজার গন্ধ। রান্নার লোকটা বুঝি কাকে বলল–এর মধ্যে একটু ঘি হলে আর কথা ছিল না।

জ্যাঠা বোধ হয় সান্ত্বনা দিয়ে বলল–হবে হবে। তা মিছরি, পাথরবাটিতে একটু ঘি দিয়ে যা দিকিনি!

মিছরি আর মিছরি! ও ছাড়া বুঝি কারো মুখে কথা নেই! মিছরি নড়ল না। চিঠি থেকে চোখ তুলে উদাসভাবে আকাশ দেখল। আবার একটা টিয়ার ঋক আসছে গাঙ পেরিয়ে। আসুক।

ছোটো কাকার এক বন্ধু ছিল, ত্র্যম্বক। মিছরির বিয়ের আগে খুব আসত এ বাড়িতে। বিয়ের পর আর আসে না। কেন বলো তো! মিছরি উদাস চেয়ে থাকে। কোনোদিন মনের কথা কিছু বলেনি তাকে ত্র্যম্বক। কিন্তু খুব ঘন ঘন তার নাম ধরে ডাকত। সিগারেট ধরাতে দশবার আগুন চাইত।

কেন যে মনে পড়ল!

উকিল লিখেছে–ত্রিশ টাকার মধ্যে কলিকাতায় ঘর পাওয়া যায় না। অনেক খুঁজিয়াছি। মাঝে মাঝে ভাবি, বনগাঁ চলিয়া যাইব। সেখানে প্র্যাকটিসের সুবিধা হইতে পারে। বাসাও সস্তা।

তাই যদি যেতে হয় তো যাও। আমি আর পারি না। বিয়ের পর এক বছর চার মাস হল ঠিক ঠিক। আর কি পারা যায়, বলো উকিলবাবু। তোমার পাষাণ হৃদয়, তার ওপর পুরুষমানুষ, লাফঝাঁপ করে তোমাদের সময় কেটে যায়। আর আমি মেয়েমানুষ, লঙ্কাগাছে জল ঢেলে কি বেলা কাটে আমার, বলো? চোখের নোনা জলে নোনাগাঙে জোয়ার ফেলে দিই রোজ। উকিলবাবু, পায়ে পড়ি…

খিচুড়িতে আলু, কুমড়ো, উঁাড়স, ঝিঙে, পটল সব ঢেলে দিয়ে রোগা বামুনটা আম গাছের তলায় জিরেন নিচ্ছে। গলার ময়লা মোটা পৈতেটা বেরিয়ে গেঞ্জির ওপর ঝুলে আছে। বড় রোগা, ঘামে ভিজে গেছে তবু গেঞ্জি খোলেনি পাঁজর দেখা যাওয়ার লজ্জায়। বিড়ি ধরিয়ে ছোটোকাকাকে বলল–বৌ আর ছেলেপিলেদের সোনারপুর ইস্টিশানে বসিয়ে রেখে আমরা বেরিয়ে পড়েছি। তারা সব কদিন ভিক্ষে-সিক্ষে করে খাবে। ঠিক করেছি বাদার যেখানে পাব জমি দখল করে ঘর তুলে ফেলব আর চাষ ফেলে দেবো। মশাই, কোনোখানে একটু ঠাই পেলাম না আমরা। বাঁচতে তো হবে নাকি!

ছোটোকাকা বলে, কতদূর যাবেন? ওদিকে তো সুন্দরবনের রিজার্ভ ফরেস্ট আর নোনা জমি। বাঘেরও ভয় খুব। লোকটা বিড়ি টেনে হতাশ গলায় বলে, আসতে আসতে এতদূর এসে পড়েছি আর একটু যেতেই হবে। বাঘেরও খিদে, আমাদেরও খিদে, দুজনাকেই বেঁচে থাকতে হবে তো।

উকিলবাবু আর কি লেখে? লেখে–সোনামণি, আমার তিনকুলে কেহ নাই, নইলে তোমাকে বাপের বাড়ি পড়িয়া থাকিতে হইত না। যাহা হউক, লিখি যে আর কয়দিন ধৈর্য ধর। কোথাও না কোথাও কিছু না কিছু হইবেই। ওকালতিতে পসার জমিতে সময় লাগে।

বুঝি তো উকিলবাবু, বুঝি। তোমার যেদিন পসার হবে ততদিন আমি থাকব তো বেঁচে! যদি মরে যাই, তবে তোমার লক্ষ্মীমন্ত ঘরে আর কোন না কোন পেত্নি এসে আমার জায়গায় ভেঁড়েমুশে সংসার করবে। বালা বাজিয়ে হাওয়া খাবে, মাছের মুড়ো চিবোবে, গাল ভরতি পান খেয়ে রুপোর বাটায় পিক ফেলবে। ততদিন কি বাঁচবো উকিলবাবু?

বিপিন কলাপাতা কেটে উঠোনে ফেলছে। ঠেলাঠেলি পড়ে গেছে দলটার মধ্যে। ঝপাঝপ পাতা টেনে বসে পড়ল সব। বাঁ হাতে সকলের পাঁচ ছটা করে কাঁচা লঙ্কা, পাতে একথাবা নুন। খিচুড়ি এখনো নামে নি। সবাই কাঁচা লঙ্কা কামড়াচ্ছে নুন মেখে। ঝালে শিস দিচ্ছে।

উকিলবাবু কি লেখে আর? লেখে–বন্ধুর বাসায় আর কতদিন থাকা যায়? ভাল দেখায় না। ধারও অনেক হইয়া গেল। লজ্জার মাথা খাইয়া লিখি, কিছু টাকা যদি পারো…

গরম খিচুড়ি মুখে দিয়ে একটা বাচ্চা ছেলে চেঁচিয়ে ওঠে জিভের যন্ত্রণায়। একজন বুড়ো বলে–আস্তে খা। যুঁইয়ে চুঁইয়ে ঠাণ্ডা করে নে।

উঃ, যা বেঁধেছো না হরিচরণ, লাট বাড়ির বাস ছেড়েছে। মিছরি আমতলায় দাঁড়িয়ে থাকে। বেলা হেলে গেছে। গাছতলায় আর ছায়া নেই। রোদের বড় তেজ।

দলের মাতব্বর জিজ্ঞেস করে মিছরির বাবাকে–ওদিকে কি কোনো আশা নেই মশায়? অ্যাঁ! এত কষ্ট করে এতদুর এলাম।

মিছরি ঘরে চলে আসে। চোখ জ্বালা করছে। বুকটায় বড় কষ্ট।

পড়ন্ত বেলায় মিছরি তার উকিলকে চিঠি লিখতে বসে–আশা হারাইও না। পৃথিবীতে অনেক জায়গা আছে।

 এ হরবাবুর অভিজ্ঞতা

নিশুত রাতে হরবাবু নির্জন অন্ধকার মেঠো পথ ধরে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন। বৃষ্টি বাদলার দিন। পথ জলকাদায় দুর্গম। তার ওপর আকাশে প্রচণ্ড মেঘ করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হরবাবুর টর্চ আর ছাতা আছে বটে, কিন্তু তাতে বিশেষ সুবিধে হচ্ছে না। টর্চের আলো নিবুনিবু হয়ে আসছে আর হাওয়ায় ছাতা উল্টে যাওয়ার ভয়। বর্ষা বাদলায় সাপখোপের ভয়ও বড় কম নয়। গর্তটর্ত বুজে যাওয়ায় তারা আশ্রয়ের সন্ধানে ডাঙ্গাজমির খোঁজে পথে ঘাটে উঠে আসে।

হরবাবুর অবশ্যই এই নিশুতরাতে পৌঁছোনোর কথা নয়। কিন্তু ট্রেনটা এমন লেট করল যে হরিণডাঙ্গা স্টেশনে নামলেনই তো রাত সাড়ে দশটায়। গরুর গাড়ির খোঁজ করে দেখলেন সব ভোঁ ভোঁ, এমনকি তার শ্বশুরবাড়ির গাঁ গোবিন্দপুরে যাওয়ার সঙ্গী সাথীও কেউ জুটলো না। গোবিন্দপুর না হোক দু-তিন মাইল রাস্তা। হরবাবুর ভয় ভয় করছিল। কিন্তু উপায়ও নেই। তার শালার বিয়ে। হরবাবুর স্ত্রী চার-পাঁচদিন আগেই ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে এসেছেন। হরবাবুর জন্যে তারা সব পথ চেয়ে থাকবে।

সামনেই তুলসীপোতার জঙ্গল। একটু ভয়ের জায়গা, আধমাইলটাক খুবই নির্জন রাস্তা। আশেপাশে বসতি নেই। হরবাবু কালী-দুর্গা স্মরণ করতে করতে যাচ্ছেন। বুকটা একটু কাঁপছেও। এই বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগেও পৃথিবীটা যে কেন এত পেছিয়ে আছে, তা তিনি বুঝতে পারেন না।

ফিরিঙ্গির হাট ছাড়িয়ে ডাইনে মোড় নিতে হবে। কিন্তু এত জম্পেশ অন্ধকারে কিছুই ঠাহর হচ্ছে না, টর্চবাতির আলো চার-পাঁচ হাতের বেশি যাচ্ছেও না। বড়ই বিপদ।

হরবাবুর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল,”ওঃ, আজ বেঘোরে প্রাণটা না যায়। ডান দিকে তুলসীপোতার রাস্তার মুখটা খুঁজে পেয়েও দমে গেলেন হরবাবু। এতক্ষণ যাইহোক শক্ত জমির ওপর হাঁটছিলেন। এবার একেবারে থকথকে কাদা।

–হরি হে, এই রাস্তায় মানুষ যেতে পারে! পৃথিবীটা আর বাসযোগ্য নেই।

হরবাবু আপনমনে কথাটা বলে ফেলতেই পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল,–তা যা বলেছেন।

হরবাবু এমন আঁতকে উঠলেন যে আর একটু হলেই তার হার্ট ফেল হত। পিছনে তাকিয়ে দেখেন একটা রোগা আর লম্বাপানা লোক। হরবাবুর সঙ্গে শালার বউয়ের জন্য গড়ানো একছড়া হার আছে। কিছু পয়সাও। লোকটা ডাকাত নাকি? হরবাবু কাঁপা গলায় বললেন, আপনি কে?

–চিনবেন না। এদিক পানেই যাচ্ছিলাম।

–অ। তা ভাল।

–আপনি কোথায় যাচ্ছেন? গোবিন্দপুর নাকি? হরবাবু কাঁপা গলায় বললেন, হ্যাঁ, সেখানেই যাওয়ার কথা।

লোকটা একটু হাসল,–যেতে পারবেন কি? এখন তো এই কাদা দেখছেন, গোড়ালি অবধি। এরপর হাঁটু অবধি গেঁথে যাবে।

–তাহলে উপায়? আমার যে না গেলেই নয়।

লোকটা একটু হেসে বলে,–উপায় কাল সকাল অবধি বসে থাকা। তারপর ভোরবেলা ফিরিঙ্গির হাট থেকে গরুর গাড়ি ধরে শিয়াখালি আর চটের হাট হয়ে গোবিন্দপুর যাওয়া। তাতে অবশ্য রাস্তাটা বেশি পড়বে। প্রায় সাত-আট মাইল। কিন্তু বর্ষাকালে তুলসীপোতা দিয়ে যাতায়াত নেই।

–রাত এখানে কাটাবো? থাকব কোথায়?

–তার আর ভাবনা কি? একটু এগোলে ওই জঙ্গলের মধ্যে আমার দিব্যি ঘর আছে। আরামে থাকবেন।

হরবাবু খুব দোটানায় পড়লেন বটে, কিন্তু কী আর করেন। লোকটা যদি তার সব কেড়েকুড়েও নেয় তাহলে কিছু করার নেই বটে। কিন্তু গোবিন্দপুর যে পৌঁছোনো যাবে না তা বুঝতে পারছেন।

আমার পিছু পিছু আসুন।–বলে লোকটা একটু এগিয়ে গেল।

হরবাবু খুব ভয়ে ভয়ে আর সংকোচের সঙ্গে তার পিছু পিছু যেতে বললেন, আপনার বাড়ি বুঝি ফিরিঙ্গির হাটেই?

–তা বলতে পারেন। যখন যেখানে ডিউটি পড়ে সেখানেই যেতে হয়। আমার কাছে সব জায়গাই সমান। তবে আপনার এই পৃথিবীটা যে বাসযোগ্য নয় তা খুব ঠিক কথা। এখানে হরকিত, গুবজোর, সেরোষ্ট্র কিছুই পাওয়া যায় না। বড় অসুবিধে।

লোকটা পাগল নাকি! হরবাবু অবাক হয়ে বললেন, কী পাওয়া যায় না বললেন?

বলে লাভ কি? আপনি পারবেন জোগাড় করে দিতে? ওসব হচ্ছে খুব ভাল ভাল সব সবজি।

জন্মে যে নামও শুনিনি! এসব কি বিলেতে হয়?

না মশাই না। বিলেতের বাজারও চষে ফেলেছি।

খুবই আশ্চর্য হয়ে হরবাবু বললেন,–বিলেতেও গেছেন বুঝি?

–কোথায় যাইনি মশায়! ছোটো গ্রহ, এমুড়ো ওমুড়ো টহল দিতে কতক্ষণই বা লাগে!

হরবাবু হতভম্ব হয়ে গেলেন। এই দুর্যোগের রাতে শেষে কি পাগলের পাল্লায় পড়লেন?

লোকটা হাঁটতে হাঁটতে বলল,–নিতান্তই পেটের দায়ে পড়ে থাকা মশাই। নইলে এই অখাদ্য জায়গায় কেউ থাকে? এখানে ফোরঙ্গলিথুয়াম হয় না, কাঙ্গারাঙ্গা নেই, ফেজুয়া নেই–এ জায়গায় থাকা যায়?

হরবাবু গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন,–এগুলো কি সবজি?

–আরে না। আপনাকে এসব বুঝিয়েই বা লাভ কি? আপনি এসব কখনও দেখেননি জানেনও না। ফোরঙ্গলিথুয়াম একটা ভারী আমোদ প্রমোদের ব্যাপার। কাঙ্গারাঙ্গা হল খেলা। ফেজুয়া হল–নাঃ, এটা বুঝবেন না।

হরবাবু মাথা নেড়ে বললেন,”আজ্ঞে না। আমার মাথায় ঠিক সেঁধোচ্ছে না। তা মশাইয়ের দেশ কি আফ্রিকা?

–হাসালেন মশাই। আফ্রিকা হলে চিন্তা কী ছিল! এ হল জরিভেলি লোকের ব্যাপার।

–জরিভেলি?

–শুধু জরিভেলি নয়, জরিভেলি লোক। এই আপনাদের মোটে নটি গ্রহ নয়, আমাদের ফুকনীকে ঘিরে পাঁচ হাজার গ্রহ ঘুরপাক খাচ্ছে। সবকটা নিয়ে জরিভেলি লোক। এলাহি কাণ্ড।

হরবাবু মূর্ছা গেলেন না। কারণ লোকটা পাগল। আবোলতাবোল বকছে।

কিন্তু কয়েক কদম যেতে না যেতেই হরবাবু যে জিনিসটা দেখতে পেলেন তাতে তাঁর চোখ ছানাবড়া। জঙ্গলের মধ্যে ছোটখাটো একটা বাড়ির মতো একখানা মহাকাশযান। আলোটালো জ্বলছে। ভারি ঝলমল করছে জিনিসটা।

–আসুন, ভিতরে আসুন। আমি একা মানুষ, আপনার আপ্যায়নের ত্রুটি ঘটবে।

ভিতরে ঢুকে হরবাবু যা দেখলেন, তাতে তার মূৰ্ছা যাওয়ারই জোগাড়। হাজার কলকজা, হাজার কিম্ভুত সব জিনিস। কোথাও আলো জ্বলছে নিবছে, কোথাও হুস্ করে শব্দ হল, কোথাও পি পি করে যেন বেজে গেল, কোথাও একটা যন্ত্র থেকে একটা গলার স্বর অচেনা ভাষায় নাগাড়ে কী যেন বলে চলেছে–লং পজং ঢাকাকাল লং পজং পাকালাব..

হরবাবুর মাথা ঘুরছিল। তিনি উবু হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।

লোকটা তাড়াতাড়ি কোথা থেকে এক গেলাস কালোমতো কি একটা জিনিস এনে তার হাতে দিয়ে বলল,-খেয়ে ফেলুন।

হরবাবু বুক ঠুকে খেয়ে ফেললেন। একবারই তো মরবেন। তবে স্বাদটা ভারী অদ্ভুত। ভিতরটা যেন আরামে ভরে গেল।

–এসব কী হচ্ছে মশাই বলুন তো?

লম্বা লোকটা ব্যাজার মুখে বলল,–কী আর হবে? আমার এখানে পোস্টিং হয়েছে। পাক্কা তিনটি মাস–আপনাদের হিসেবে–এইখানেই পড়ে থাকতে হবে।

–কিসের পোস্টিং?

–আর বলবেন না মশাই। এতদিন জরিভেলির বাইরে আমরা কোথাও যেতাম না। এখন হুকুম হয়েছে, কাছেপিঠে যে কটা লোক আছে সেগুলো সম্পর্কে সব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সোজা কাজ নাকি মশাই? যেখানে পোস্টিং হবে, সেখানকার ভাষা শেখো রে, সেখানকার আদব কায়দা রপ্ত করো রে, সেখানকার অখাদ্য খেয়ে পেট ভরাও রে। নাঃ, চাকরিটা আর পোযাচ্ছে না।

হরবাবু একটু একটু বুঝতে পারছেন, লোকটা গুল মারছে না। তিনি উঠে একটা চেয়ারগগাছের জিনিসে বসে পড়ে বললেন,–আপনাদের জরিভেলি কতদূর?

–বেশি নয়। আপনাদের হিসেবে মাত্র একশো তেত্রিশ আলোকবর্ষ দূরে।

–আঁ?

–হ্যাঁ, তা আর বেশি কি? আমার এই গাড়িতে ঘণ্টা খানেক লাগে।

–অ্যাঁ।

–হ্যাঁ।

হরবাবু খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে বললেন,–তাহলে আর আমার শ্বশুরবাড়ি গোবিন্দপুর এমন কী দূর?

–কিছু না, কিছু না।

হরবাবু মহাকাশযান থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ি-কি-মরি করে ছুটতে লাগলেন।

» কালাচাঁদের দোকান

Exit mobile version