উকিলবাবু আর কি লেখে? লেখে–সোনামণি, আমার তিনকুলে কেহ নাই, নইলে তোমাকে বাপের বাড়ি পড়িয়া থাকিতে হইত না। যাহা হউক, লিখি যে আর কয়দিন ধৈর্য ধর। কোথাও না কোথাও কিছু না কিছু হইবেই। ওকালতিতে পসার জমিতে সময় লাগে।
বুঝি তো উকিলবাবু, বুঝি। তোমার যেদিন পসার হবে ততদিন আমি থাকব তো বেঁচে! যদি মরে যাই, তবে তোমার লক্ষ্মীমন্ত ঘরে আর কোন না কোন পেত্নি এসে আমার জায়গায় ভেঁড়েমুশে সংসার করবে। বালা বাজিয়ে হাওয়া খাবে, মাছের মুড়ো চিবোবে, গাল ভরতি পান খেয়ে রুপোর বাটায় পিক ফেলবে। ততদিন কি বাঁচবো উকিলবাবু?
বিপিন কলাপাতা কেটে উঠোনে ফেলছে। ঠেলাঠেলি পড়ে গেছে দলটার মধ্যে। ঝপাঝপ পাতা টেনে বসে পড়ল সব। বাঁ হাতে সকলের পাঁচ ছটা করে কাঁচা লঙ্কা, পাতে একথাবা নুন। খিচুড়ি এখনো নামে নি। সবাই কাঁচা লঙ্কা কামড়াচ্ছে নুন মেখে। ঝালে শিস দিচ্ছে।
উকিলবাবু কি লেখে আর? লেখে–বন্ধুর বাসায় আর কতদিন থাকা যায়? ভাল দেখায় না। ধারও অনেক হইয়া গেল। লজ্জার মাথা খাইয়া লিখি, কিছু টাকা যদি পারো…
গরম খিচুড়ি মুখে দিয়ে একটা বাচ্চা ছেলে চেঁচিয়ে ওঠে জিভের যন্ত্রণায়। একজন বুড়ো বলে–আস্তে খা। যুঁইয়ে চুঁইয়ে ঠাণ্ডা করে নে।
উঃ, যা বেঁধেছো না হরিচরণ, লাট বাড়ির বাস ছেড়েছে। মিছরি আমতলায় দাঁড়িয়ে থাকে। বেলা হেলে গেছে। গাছতলায় আর ছায়া নেই। রোদের বড় তেজ।
দলের মাতব্বর জিজ্ঞেস করে মিছরির বাবাকে–ওদিকে কি কোনো আশা নেই মশায়? অ্যাঁ! এত কষ্ট করে এতদুর এলাম।
মিছরি ঘরে চলে আসে। চোখ জ্বালা করছে। বুকটায় বড় কষ্ট।
পড়ন্ত বেলায় মিছরি তার উকিলকে চিঠি লিখতে বসে–আশা হারাইও না। পৃথিবীতে অনেক জায়গা আছে।
এ হরবাবুর অভিজ্ঞতা
নিশুত রাতে হরবাবু নির্জন অন্ধকার মেঠো পথ ধরে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন। বৃষ্টি বাদলার দিন। পথ জলকাদায় দুর্গম। তার ওপর আকাশে প্রচণ্ড মেঘ করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হরবাবুর টর্চ আর ছাতা আছে বটে, কিন্তু তাতে বিশেষ সুবিধে হচ্ছে না। টর্চের আলো নিবুনিবু হয়ে আসছে আর হাওয়ায় ছাতা উল্টে যাওয়ার ভয়। বর্ষা বাদলায় সাপখোপের ভয়ও বড় কম নয়। গর্তটর্ত বুজে যাওয়ায় তারা আশ্রয়ের সন্ধানে ডাঙ্গাজমির খোঁজে পথে ঘাটে উঠে আসে।
হরবাবুর অবশ্যই এই নিশুতরাতে পৌঁছোনোর কথা নয়। কিন্তু ট্রেনটা এমন লেট করল যে হরিণডাঙ্গা স্টেশনে নামলেনই তো রাত সাড়ে দশটায়। গরুর গাড়ির খোঁজ করে দেখলেন সব ভোঁ ভোঁ, এমনকি তার শ্বশুরবাড়ির গাঁ গোবিন্দপুরে যাওয়ার সঙ্গী সাথীও কেউ জুটলো না। গোবিন্দপুর না হোক দু-তিন মাইল রাস্তা। হরবাবুর ভয় ভয় করছিল। কিন্তু উপায়ও নেই। তার শালার বিয়ে। হরবাবুর স্ত্রী চার-পাঁচদিন আগেই ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে এসেছেন। হরবাবুর জন্যে তারা সব পথ চেয়ে থাকবে।
সামনেই তুলসীপোতার জঙ্গল। একটু ভয়ের জায়গা, আধমাইলটাক খুবই নির্জন রাস্তা। আশেপাশে বসতি নেই। হরবাবু কালী-দুর্গা স্মরণ করতে করতে যাচ্ছেন। বুকটা একটু কাঁপছেও। এই বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগেও পৃথিবীটা যে কেন এত পেছিয়ে আছে, তা তিনি বুঝতে পারেন না।
ফিরিঙ্গির হাট ছাড়িয়ে ডাইনে মোড় নিতে হবে। কিন্তু এত জম্পেশ অন্ধকারে কিছুই ঠাহর হচ্ছে না, টর্চবাতির আলো চার-পাঁচ হাতের বেশি যাচ্ছেও না। বড়ই বিপদ।
হরবাবুর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল,”ওঃ, আজ বেঘোরে প্রাণটা না যায়। ডান দিকে তুলসীপোতার রাস্তার মুখটা খুঁজে পেয়েও দমে গেলেন হরবাবু। এতক্ষণ যাইহোক শক্ত জমির ওপর হাঁটছিলেন। এবার একেবারে থকথকে কাদা।
–হরি হে, এই রাস্তায় মানুষ যেতে পারে! পৃথিবীটা আর বাসযোগ্য নেই।
হরবাবু আপনমনে কথাটা বলে ফেলতেই পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল,–তা যা বলেছেন।
হরবাবু এমন আঁতকে উঠলেন যে আর একটু হলেই তার হার্ট ফেল হত। পিছনে তাকিয়ে দেখেন একটা রোগা আর লম্বাপানা লোক। হরবাবুর সঙ্গে শালার বউয়ের জন্য গড়ানো একছড়া হার আছে। কিছু পয়সাও। লোকটা ডাকাত নাকি? হরবাবু কাঁপা গলায় বললেন, আপনি কে?
–চিনবেন না। এদিক পানেই যাচ্ছিলাম।
–অ। তা ভাল।
–আপনি কোথায় যাচ্ছেন? গোবিন্দপুর নাকি? হরবাবু কাঁপা গলায় বললেন, হ্যাঁ, সেখানেই যাওয়ার কথা।
লোকটা একটু হাসল,–যেতে পারবেন কি? এখন তো এই কাদা দেখছেন, গোড়ালি অবধি। এরপর হাঁটু অবধি গেঁথে যাবে।
–তাহলে উপায়? আমার যে না গেলেই নয়।
লোকটা একটু হেসে বলে,–উপায় কাল সকাল অবধি বসে থাকা। তারপর ভোরবেলা ফিরিঙ্গির হাট থেকে গরুর গাড়ি ধরে শিয়াখালি আর চটের হাট হয়ে গোবিন্দপুর যাওয়া। তাতে অবশ্য রাস্তাটা বেশি পড়বে। প্রায় সাত-আট মাইল। কিন্তু বর্ষাকালে তুলসীপোতা দিয়ে যাতায়াত নেই।
–রাত এখানে কাটাবো? থাকব কোথায়?
–তার আর ভাবনা কি? একটু এগোলে ওই জঙ্গলের মধ্যে আমার দিব্যি ঘর আছে। আরামে থাকবেন।
হরবাবু খুব দোটানায় পড়লেন বটে, কিন্তু কী আর করেন। লোকটা যদি তার সব কেড়েকুড়েও নেয় তাহলে কিছু করার নেই বটে। কিন্তু গোবিন্দপুর যে পৌঁছোনো যাবে না তা বুঝতে পারছেন।
আমার পিছু পিছু আসুন।–বলে লোকটা একটু এগিয়ে গেল।
হরবাবু খুব ভয়ে ভয়ে আর সংকোচের সঙ্গে তার পিছু পিছু যেতে বললেন, আপনার বাড়ি বুঝি ফিরিঙ্গির হাটেই?