সেই ইঁদারা নিয়েই বখেরা। চক্কোত্তিমশাই হস্তুকি গিলে ফেলে ভারী দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। হস্তুকি এমনিতে বড় ভাল জিনিস। কিন্তু আস্ত হকি পেটে গেলে হজম হবে কি না সেইটেই প্রশ্ন। পুরনো ইঁদারার জল পাওয়া গেলে হস্তুকি নিয়ে চিন্তা করার প্রশ্নই ছিল না।
চক্কোত্তিমশাই করজোড়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “রাজামশাই, আমাদের গোবিন্দপুর গাঁয়ের পুরনো ইঁদারার জল বড় বিখ্যাত। এতকাল সেই জল খেয়ে কোনো রোগ-বালাই আমরা গাঁয়ে ঢুকতে দিইনি। কিন্তু বড়ই দুঃখের কথা, ইঁদারার জল আর আমরা তুলতে পারছি না।”
রায়মশাই একটু শ্লেষের হাসি হেসে বললেন, “হবে না? পাপের প্রায়শ্চিত্ত। আমার ছেলের বিয়েতে যে বড় গরু দিয়ে আমাকে অপমান করেছিলে?”
চক্কোত্তিমশাই জিভ কেটে বললেন, “ছি ছি, আপনাকে অপমান রাজামশাই? সেরকম চিন্তা আমাদের মরণকালেও হবে না। তাছাড়া ব্রাহ্মণকে গো-দান করলে পাপ হয় বলে কোনো শাস্ত্রে নেই। গো-দান মহাপুণ্য কর্ম।”
রায়মশায়ের নতুন সভাপণ্ডিত কেশব ভট্টাচার্য মাথা নেড়ে বললেন, “কূট প্রশ্ন। কিন্তু কথাটা আপাতগ্রাহ্য।”
রায়মশাই একটু নরম হয়ে বললেন, “ইঁদারার কথা আমিও শুনেছি। সেবার গোবিন্দপুর থেকে পুরনো ইঁদারার জল আনিয়ে আমাকে খাওয়ানো হয়। খুব উপকার পেয়েছিলাম। তা সে ইঁদারা কি শুকিয়ে গেছে নাকি?”
চক্কোত্তিমশাই ট্যাক থেকে আর একটা হকি বের করে লুকিয়ে মুখে ফেলে বললেন, “আজ্ঞে না। তাতে এখনো কাকচক্ষু জল টলমল করছে। কিন্তু সে জল হাতের কাছে থেকেও আমাদের নাগালের বাইরে। দড়ি বেঁধে ঘটি বালতি যা-ই নামানো যায়, তা আর ওঠানো যায় না। দড়ি কে যেন কেটে নেয়, ছিঁড়ে দেয়। লোহার শিকলও কেটে দিয়েছে।”
রক্তচক্ষে রায়মশাই হুংকার দিলেন, “কার এত সাহস?”
এবার হুংকার শুনে গোবিন্দপুরের লোকেরা খুশি হল। নড়ে চড়ে বসল। মাথার উপর জমিদারবাহাদুর থাকতে ইঁদারার জল বেহাত হবে, এ কেমন কথা।
ঠাকুরমশাই বললেন, “আজ্ঞে মানুষের কাজ নয়। এত বুকের পাটা কারো নাই। গোবিন্দপুরের লেঠেলদের কে না চেনে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো মাথার ওপর আপনিও রয়েছেন। লেঠেলদের এলেমে না কুলোলে আপনি শাসন করবেন; কিন্তু এ কাজ যারা করছেন তাঁরা মানুষ নন। অশরীরী।”
গোদের উপর বিষফোঁড়ার উপমা শুনে একটু রেগে উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অশরীরীর কথা শুনেই মুহূর্তের মধ্যে কানে হাত চাপা দিয়ে ডুকরে উঠলেন রায়মশাই, “ওরে বলিস না, বলিস না।”
সবাই তাজ্জব।
নায়েবমশাই রোষকষায়িত লোচনে গোবিন্দপুরের প্রজাদের দিকে চেয়ে বললেন, “মুখ সামলে কথা বলো।”
চক্কোত্তিমশাই ভয়ের চোটে দ্বিতীয় হস্তুকিটাও গিলে ফেলতে ফেলতে অতি কষ্টে সামাল দিলেন।
রায়মশাইয়ের বড় ভূতের ভয়। পারতপক্ষে তিনি ও নাম মুখেও আনেন না। শোনেনও না। কিন্তু কৌতূহলেরও তো শেষ নেই। খানিকক্ষণ কান হাতে চেপে রেখে খুব আস্তে একটুখানি চাপা খুলে বললেন, “কী যেন বলছিলি?”
চক্কোত্তিমশাই উৎসাহ পেয়ে বলেন, “আজ্ঞে সে এক অশরীরী কাণ্ড। ভূ—”
“বলিস না! খবর্দার বলছি, বলবি না!” রায়বাবু আবার কানে হাতচাপা দেন।
চক্কোত্তিমশাই বোকার মতো চারদিকে চান। সবাই এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। নায়েবমশাই ‘চোপ’ বলে একটা প্রচণ্ড ধমক মারেন।
একটু বাদে রায়বাবু আমার কান থেকে হাতটা একটু সরিয়ে বলেন, “ইঁদারার জলে কী যেন?”
চক্কোত্তিমশাই এবার একটু ভয়ে ভয়েই বলেন, “আজ্ঞে সে এক সাঙ্ঘাতিক ভুতুড়ে ব্যাপার!”
“চুপ কর, চুপ কর! রাম রাম রাম রাম!”
বলে আবার রায়বাবু কানে হাত। খানিক পরে আবার তিনি বড় বড় চোখ করে চেয়ে বলেন, “রেখে ঢেকে বল।”
“আজ্ঞে বালতি-ঘটির সব দড়ি তেনারা কেটে নেন। শেকল পর্যন্ত ঘেঁড়েন, তাছাড়া ইঁদারার মধ্যে হাওয়া বয় না, বাতাস দেয় না, তবু তালগাছের মতো ঢেউ দেয়, জল হিলিবিলি করে ফঁপে।”
“বাবা রে!” বলে রায়বাবু চোখ বুজে ফেলেন। ক্রমে-ক্রমে অবশ্য সবটাই রায়বাবু শুনলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “দিনটাই মাটি করলি তোরা। নায়েবমশাই, আজ রাতে আমার শোবার ঘরে চারজন দারোয়ান মোতায়েন রাখবেন।”
“যে আজ্ঞে ।”
গোবিন্দপুরের প্রজারা হাতজোড় করে বলল, “হুজুর আপনার ব্যবস্থা তো দারোয়ান দিয়ে করালেন, এবার আমাদের ইঁদারার একটা বিলিব্যবস্থা করুন।”
“ইঁদারা বুজিয়ে ফ্যাল গে। ও ইঁদারা আর রাখা ঠিক নয়। দরকার হলে আমি দারা বোজানোর জন্য গো-গাড়ি করে ভাল মাটি পাঠিয়ে দেব’খন।”
তখন শুধু গোবিন্দপুরের প্রজারাই নয়, কাছারিঘরের সব প্রজাই হাঁ-হাঁ করে উঠে বলে, “তা হয় না হুজুর, সেই ইঁদারার জল আমাদের কাছে ধন্বন্তরী। তা ছাড়া জল তো নষ্টও হয়নি, পোকাও লাগেনি, কয়েকটা
রায়বাবু হুংকার দিলেন, “চুপ! ও নাম মুখে আনবি তো মাটিতে পুঁতে ফেলব।”
সবাই চুপ মেরে যায়। রায়বাবু ব্যাজার মুখে কিছুক্ষণ ভেবে ভট্টাচার্য মশাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন, “এ তো লেঠেলদের কর্ম নয়। একবার যাবেন নাকি সেখানে?”
রায়মশাইয়ের আগের সভাপণ্ডিত মুকুন্দ শর্মা একশ বছর পার করে এখনো বেঁচে আছেন। তবে একটু অথর্ব হয়ে পড়েছেন। ভারী ভুলো মন আর দিনরাত খাই-খাই। তাকে দিয়ে কাজ হয় না। তাই নতুন সভাপণ্ডিত রাখা হয়েছে কেশব ভট্টাচার্যকে।