তা রামুর আর সেদিন নেই। বয়স হয়েছে। দাঁত কিছু পড়েছে, কিছু নড়েছে। কয়েকটা দাঁত শহর থেকে বাঁধিয়ে এনেছে। তো সেই পড়া, নড়া, আর বাঁধানো দাঁতে তার মুখের ভিতর এখন বিস্তর ঠোকাঠুকি, গণ্ডগোল। কোন দাঁতের সঙ্গে কোন দাঁতের বনে না। খাওয়ার সময়ে মাংসের হাড় মনে করে, নিজের বাঁধানো দাঁতও চিবিয়ে ফেলেছিল রামু। সে অন্য ঘটনা। থাকগে।
কিন্তু এইরকম গণ্ডগোলে মুখ নিয়ে পেরেক খেতে গিয়ে ভারী মুশকিলে পড়ে গেল সেবার। পেরেক মুখে অভ্যেসমতো এক গ্লাস জল খেয়ে সে বক্তৃতা করছে। “পেরেক তো পেরেক, ইচ্ছে করলে হাওড়ার ব্রিজও খেয়ে নিতে পারি। সেবার গিয়েছিলাম খাব বলে। সরকার টের পেয়ে আমাকে ধরে জেলে পোরার উপক্রম। তাই পালিয়ে বাঁচি।”
বক্তৃতা করার পর সে আবার যথা নিয়মে ওয়াক তুলে ওগরাতে গিয়ে দেখে, পেরেক মুখে নেই একটাও। বেবাক জিভের তলা আর গালের ফাঁক থেকে সাফ হয়ে জলের সঙ্গে পেটে সেঁদিয়েছে।
টের পেয়েই রামু ভয় খেয়ে চোখ কপালে তুলে যায় আর কি। পেটের মধ্যে আট-দশটা পেরেক! সোজা কথা তো নয়। আট ঘণ্টার মধ্যে পেটের ব্যথা, মুখে গাঁজলা, ডাক্তার কবিরাজ এসে দেখে বলল, “অন্ত্রে ফুটো, পাকস্থলীতে ছাদা, খাদ্যনালী লিক, ফুসফুস ফুটো হয়ে বেলুনের মতো হাওয়া বেরিয়ে যাচ্ছে। আশা নেই।”
সেই সময়ে একজন লোক বুদ্ধি করে বলল, “পুরনো ইঁদারার জল খাওয়াও।”
ঘটিভর সেই জল খেয়ে রামু আধ ঘণ্টা খানেকের মধ্যে গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সত্যিই লোহা হজম হয়ে গেছে।
ইঁদারার জলের খ্যাতি এমনিতেই ছিল, এই ঘটনার পর আরো বাড়ল। বলতে কী, গোবিন্দপুরের লোকের এই ইঁদারার জল খেয়ে কোনো ব্যামোই হয় না।
কিন্তু ইদানীং একটা মুশকিল দেখা দিয়েছে। ইঁদারায় বালতি বা ঘটি নামালে দড়ি ছিঁড়ে যায়। দড়ি সব সময়ে যে হেঁড়ে তাও নয়। অনেক সময় দেখা যায়, বালতির হাতল থেকে দড়ির গিট কে যেন সযত্নে খুলে নিয়েছে। কিছুতেই জল তোলা যায় না। যতবার দড়ি বাঁধা বালতি নামানো হয় ততবারই এক ব্যাপার।
গাঁয়ের লোকেরা বুড়ো পুরুতমশাইয়ের কাছে গিয়ে পড়ল। “ও ঠাকুরমশাই, বিহিত করুন।”
ঠাকুরমশাই মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন। দুঃখের সঙ্গে বললেন, “ভায়ারা দড়ি তো দড়ি, আমি লোহার শেকলে বেঁধে বালতি নামালাম, তো সেটাও ছিঁড়ে গেল। তার ওপর দেখি, জলের মধ্যে সব হুলুস্থুল কাণ্ড হচ্ছে। দেখেছ কখনও ইঁদারার জলে সমুদ্রের মতো ঢেউ ওঠে? কাল সন্ধ্যেবেলায় দেখলাম নিজের চক্ষে। বলি, ও ইঁদারার জল আর কারো খেয়ে কাজ নেই।”
পাঁচটা গ্রাম নিয়ে হরিহর রায়ের জমিদারি। রায়মশাই বড় ভাল মানুষ ধর্মভীরু, নিরীহ, লোকের দুঃখ বোঝেন। গোবিন্দপুর গাঁয়ের লোকেরা তাঁর দরবারে গিয়ে হাজির।
রায়মশাই কাছারিঘরে বসে আছেন। ফর্সা; নাদুস-নুদুস চেহারা।
নায়েবমশাই সামনে গিয়ে মাথা চুলকে বললেন, “আজ্ঞে, গোবিন্দপুরের লোকেরা সব এসেছে দরবার করতে।”
রায়মশাই মানুষটা নিরীহ হলেও হাঁকডাক বাঘের মতো। রেগে গেলে তার ধারে কাছে কেউ আসতে পারে না। গোবিন্দপুর গাঁয়ের লোকদের ওপর তিনি মোটেই খুশি ছিলেন না। তাঁর সেজো ছেলের বিয়ের সময় অন্যান্য গাঁয়ের প্রজারা যখন চাঁদা তুলে মোহর বা গয়না উপহার দিয়েছিল, তখন এই গোবিন্দপুরের নচ্ছার লোকেরা একটা দুধেল গাই দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে এসে এক গাল হেসে নতুন বৌয়ের হাতে সেই গরু-বাঁধা দড়ির একটা প্রান্ত তুলে দিয়েছিল।
সেই থেকে রায়মশাইয়ের রাগ। গরুটা যে খারাপ তা নয়। রায়মশাইয়ের গোয়ালে এখন সেইটেই সব চেয়ে ভাল গরু। দু বেলায় সাত সের দুধ দেয় রোজ। বটের আঠার মতো ঘন আর মিষ্টি সেই দুধেরও তুলনা হয় না। কিন্তু বিয়ের আসরে গরু এনে হাজির করায় চারদিকে সে কী ছিছিক্কার! আজও সেই কথা ভাবলে রায়মশাই লজ্জায় অধোবদন হন। আবার রাগে রক্তবর্ণও হয়ে যান।
সেই গোবিন্দপুরের লোকেরা দরবার করতে এসেছে শুনে রায়মশাই রাগে হুংকার ছেড়ে বলে ওঠেন, “কী চায় ওরা?”
সেই হুংকারে নায়েবমশাই তিন হাত পিছিয়ে গেলেন, প্রজারা আঁতকে উঠে ঘামতে লাগল, স্বয়ং রায়মশাইয়ের নিজের কোমরের কষি পর্যন্ত আলগা হয়ে গেল।
গোবিন্দপুরের মাতব্বর লোক হলেন পুরুত চক্কোত্তিমশাই। তাঁর গালে সব সময়ে আস্ত একটা হকি থাকে। আজও ছিল। কিন্তু জমিদারমশাইয়ের হুংকার শুনে একটু ভিরমি খেয়ে টোক গিলে সামলে ওঠার পর হঠাৎ টের পেলেন, মুখে হস্তুকিটা নেই। বুঝতে পারলেন, চমকানোর সময়ে সেটা গলায় চলে গিয়েছিল, টোক গেলার সময়ে গিলে ফেলেছেন।
আস্ত হস্তুকিটা পেটে গিয়ে হজম হবে কি না কে জানে। একটা সময় ছিল, পেটে জাহাজ ঢুকে গেলেও চিন্তা ছিল না! গাঁয়ে ফিরে পুরনো ইঁদারার এক ঘটি জল ঢকঢক করে গিলে ফেললেই জাহাজ ঝঁঝরা। বামুন-ভোজনের নেমতন্নে গিয়ে সেবার সোনারগাঁয়ে দু বালতি মাছের মুড়ো-দিয়ে বাঁধা ভাজা সোনারমুগের ডাল খেয়েছিলেন, আরেকবার সদিপিসির শ্রাদ্ধপ্রাশনে দেড়খানা পাঁঠার মাংস, জমিদার মশাইয়ের সেজো ছেলের বিয়েতে আশি টুকরো পোনা মাছ, দু হাঁড়ি দই আর দু সের রসগোল্লা। গোবিন্দপুরের লোকেরা এমনিতেই খাইয়ে। তারা যেখানে যায়, সেখানকার সব কিছু খেয়ে প্রায় দুর্ভিক্ষ বাধিয়ে দিয়ে আসে। সেই গোবিন্দপুরের ভোজনপ্রিয় লোকদের চক্কোত্তিমশাই হলেন চ্যাম্পিয়ন। তবে এসব খাওয়াদাওয়ার পিছনে আছে পুরনো ইঁদারার স্বাস্থ্যকর জল। খেয়ে এসে জল খাও। পেট খিদেয় ডাকাডাকি করতে থাকবে।