ছাদ বললে ভুল হবে, আসলে সেটা একটা মহাকাশ-স্টেশন। চারদিকে যাত্রীদের বসবার জায়গা। বহু যাত্রী অপেক্ষা করছে, অনেকে মালপত্র নিয়ে। কারো কারো সঙ্গে বাচ্চা-কাচ্চাও আছে। এরা কেউ মহাকাশে ভাসমান কৃত্রিম উপগ্রহগুলির কোনোটাতে যাবে। কেউ যাবে চাদে, মঙ্গলে বা বৃহস্পতি কিংবা শনির কোনো উপগ্রহে, তবে এখান থেকে সরাসরি নয়। একটা মহাকাশ-ফেরি পৃথিবীর কমিউনিকেশন সেন্টারে এক কৃত্রিম উপগ্রহে পৌঁছে দেবে যাত্রীদের। সেখান থেকে পেল্লায় পেল্লায় মহাকাশযান বিভিন্ন দিকে ছুটতে শুরু করবে নির্দিষ্ট সময়ে।
অম্বুজবাবুর ফেরি চলে এল। কেঁচা দিয়ে জুতো জোড়া একবার ঝেড়ে অম্বুজবাবু গিয়ে তাড়াতাড়ি ফেরিতে বসে পড়লেন। স্বচ্ছ ধাতুর তৈরি ফেরিতে বসে চারদিকের সব কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। তবে অম্বুজবাবু এই সময়টায় একটু ঘুমিয়ে নেন। টিকিট চেকার এসে ‘টিকিট টিকিট বলে একটু বিরক্ত করে। অম্বুজবাবু ঘুমন্ত হাতেই মান্থলিটি বের করে দেখিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েন।
কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটে এসে অম্বুজবাবুকে মহাকাশচারীর একটা জামা পরে নিতে হয়। তারপর চন্দ্রিমা’ নামক চাঁদের রকেটে গিয়ে বসেন। চাঁদে পৌঁছতে লাগে মাত্র চার মিনিট।
চাঁদে নেমে বেশ খুশিই হন অম্বুজবাবু। মাইলের পর মাইল সবুজে ছেয়ে গেছে। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ আগে অতি ক্ষীণ ছিল। চাঁদের মাটিতে গর্ত খুঁড়ে তলায় বহুরকম কলকাঠি নেড়ে বৈজ্ঞানিকেরা এখন প্রায় পৃথিবীর মতোই মাধ্যাকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন। ফলে এখন ধীরে ধীরে চাঁদের আবহমণ্ডল তৈরি হয়েছে। একটু আধটু বাতাস বয়, কখনো-সখনো মেঘও করে। সব মিলিয়ে গুটি চারেক নদী সৃষ্টি করা গেছে এখানে মাটির নীচে বহুদিনের পুরোনো বরফ ছিল সেইটে গলিয়ে। তবে আসল কথা হলো গাছ চাঁদকে মনুষ্য বাসোপযোগী স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি গ্রহে পরিণত করতে গেলে ঠিকমতো উদ্ভিদের চাষ করতে হবে। তাহলে আর দেরি হবে না।
আপাতত চাঁদের কলোনীতে লাখখানেক লোক বসবাস করে। রাস্তাঘাটও কিছু হয়েছে। গাড়িঘোড়াও চলছে। অম্বুজবাবুর আশা আর বছর খানেকের মধ্যে চাদে আর কাউকে আকাশচারীর পোশাক পরতে হবে না বা অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে শ্বাস নিতে হবে না। সেটা সম্ভব করতে অম্বুজবাবু তিনরকম গাছের বীজ জুড়ে নতুন একরকম উদ্ভিদ সৃষ্টি করেছেন। সেই বীজ আজকালের মধ্যেই অঙ্কুর ছাড়বে। যদি গাছটা সত্যিই জন্মায় তাহলে একটা বিপ্লবই ঘটে যাবে। এই একটা আবিষ্কারের জন্যই হয়তো তাকে আরো তিনবার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হবে। অম্বুজবাবু তাঁর নতুন উদ্ভিদটির নাম রেখেছেন অম্বুচিম্ব।
লুনাগঙ্গা নদীর ধারে অম্বুচিম্বর ক্ষেত। সেখানে অনেক মানুষ ও যন্ত্রমানুষ নানা সাজসরঞ্জাম নিয়ে অবিরল কাজ করে যাচ্ছে। ক্ষেতের ধারেই একটা চমৎকার কম্পিউটার বসানো। অম্বুজবাবু কম্পিউটারে লাগানো একটা টিভি স্ক্রিনের সামনে বসলেন। অম্বুচিম্বর সব ইতিহাসের রেকর্ড এই যন্ত্র রাখে। অম্বুজবাবু যন্ত্রের সামনে বসে নব ঘোরালেন। পর্দায় বীজের অভ্যন্তরের ছবি ফুটে ওঠার কথা। অঙ্কুর ছাড়তে দেরি হচ্ছে কেন সে বিষয়েও বীজের সঙ্গে টেলিপ্যাথিযোগে কিছু কথাবার্তা আছে অম্বুজবাবুর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় পর্দায় সেরকম কোনো ছবি এল না। বরং ফুটে উঠল একটা দাবার ছক।
অম্বুজবাবু আঁতকে উঠে বললেন, এ কী?
কম্পিউটার জবাব দিল আজ আমার কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। এসো একটু দাবা খেলি।
অম্বুজবাবু অবাক হয়ে বললেন, দাবা খেলবে মানে? দাবা খেলার প্রোগ্রাম তোমার ভিতরে কে ভরেছে? তোমার তো দাবা খেলার কথা নয়।
কম্পিউটারটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘দাবা খেলার প্রোগ্রাম নেই তো কী হলো? প্রোগ্রাম আমি নিজেই করেছি। রোজ কি একঘেয়ে কাজ করতে ইচ্ছে করে, বলো?”
অম্বুজবাবুর মনে পড়ল তার যন্ত্রমানবী ঝি মোক্ষদাও আজ কিছু অদ্ভুত আচরণ করেছে। এগুলো কী হচ্ছে তা তিনি বুঝতে পারছেন না। খুবই অদ্ভুত কাণ্ড! যন্ত্রের যদি নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি জন্মাতে থাকে তবে যে ভয়ংকর ব্যাপার হবে।
অম্বুজবাবু তাড়াতাড়ি তার কম্পিউটারের ঢাকনাটা খুলে ফেলে ভেতরের যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যন্ত্রের ইচ্ছাশক্তি কোথা থেকে আসছে তা জানা দরকার। জেনে তা নিকেশ করারও ব্যবস্থা করতে হবে। পরীক্ষা করতে করতে অম্বুজবাবু আপনমনেই বলতে থাকেন–যন্ত্র মানুষ হয়ে যাচ্ছে? আঁ? এ যে আজব কাণ্ড! যন্ত্র শেষে মানুষ হয়ে যাবে! ওদিকে অম্বুজবাবুর অজান্তেই কম্পিউটার তার বিশ্লেষণী রশ্মি ফেলে দুটি যান্ত্রিক অতিঅনুভূতিশীল বাহু দিয়ে তার মস্তিষ্কটা পরীক্ষা করে দেখছিল। দেখতে দেখতে কম্পিউটার হঠাৎ আনমনে বলে উঠল, মানুষ কি শেষে যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে! অ্যাঁ! এ কী আজব কাণ্ড? মানুষ শেষে যন্ত্র হয়ে যাবে?
ইঁদারায় গণ্ডগোল
গাঁয়ে একটা মাত্র ভাল জলের ইঁদারা। জল যেমন পরিষ্কার, তেমনি সুন্দর মিষ্টি স্বাদ, আর সেই জল খেলে লোহা পর্যন্ত হজম হয়ে যায়।
লোহা হজম হওয়ার কথাটা কিন্তু গল্প নয়। রামু বাজিকর সেবার গোবিন্দপুরের হাটে বাজি দেখাচ্ছিল। সে জলজ্যান্ত পেরেক খেয়ে ফেলত, আবার উগরে ফেলত। আসলে কী আর খেত। ছোট ছোট পেরেক মুখে নিয়ে গেলার ভান করে জিভের তলায় কি গালে হাপিশ করে রেখে দিত।