হনুমান জলদগম্ভীর গলায় বলল, আমার লেজটা ধরুন।
ভয়ে ভয়ে নিবারণবাবু বিনা বাক্যব্যয়ে লেজটা ধরলেন আর ধরতেই যেন চৌম্বক আকর্ষণে হাতদুটো লেজের সঙ্গে আটকে গেল। আর দাঁড়ানোর উপায় রইল না।
তারপর যে কী হলো তা নিবারণবাবু ঠিকঠাক বুঝতে পারলেন না। হনুমান তাকে জানালা গলিয়ে বাইরে এনে ফেলল এবং তারপর ইনজিনের মতো ছুটতে শুরু করল। এত ছুট জীবনে কখনও ছোটেননি নিবারণবাবু। তবে কেন যেন তার হাঁফ ধরছিল না। চোখের পলকে নিজেদের তল্লাট এবং শহর ছাড়িয়ে খোলা মাঠঘাটে এসে গেলেন তারা। হনুমান মস্ত মস্ত লাফ মেরে ঢেউয়ের মতো চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে নিবারণবাবুও ঢেউ হয়ে বয়ে যাচ্ছেন। প্রায় দশ বারো হাত দূরে দূরে এক একবার পা মাটিতে ঠেকছে।
অনেকটা চলে আসার পর একটা জঙ্গলে ঢুকে গেলেন তারা। তারপর একটা ফাঁকা চত্বর। জঙ্গলঘেরা জায়গাটায় একটা লোক পিছনে হাত রেখে মৃদুমন্দ পায়চারি করছে। লোকটা বেঁটে এবং দেখতে একটু কিস্তৃত। পরনে একটা পাশবালিশের ওয়াড়ের মতো পোশাক, মাথায় একটা সরু টুপি। লোকটার গোল মুখখানায় চোখ নাক কান কোনওটাই ঠিক জায়গায় নেই বলে মনে হলো দূর থেকে।
কাছে গিয়ে হনুমান লোকটাকে প্রণাম করে বলল, প্রভু এনেছি।
লোকটা নিবারণের দিকে ফিরে তাকাল, মুখটা ভাল করে দেখে আঁতকে উঠলেন নিবারণবাবু। এর চোখদুটো দুই গালে। ঠোঁটদুটো নাকের ওপরে। আর গলা বলে কিছু নেই। কানদুটো গরুর কানের মতো।
এই কি রামচন্দ্র? এত বিচ্ছিরি দেখতে?
রামচন্দ্র লোকটা ডান গালের চোখটা দিয়ে নিবারণবাবুকে দেখে নিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, পেন্নাম করলে না?
যে আজ্ঞে। বলে নিবারণবাবু তাড়াতাড়ি মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে ভয়ে ভয়ে প্রণাম করলেন।
রামচন্দ্ৰ খকখক শব্দ করে হেসে বললেন, শোনো হে বাপু, আমি সত্যিই কিন্তু তোমাদের সেই রামায়ণের রামচন্দ্র নই। তার গল্পটা বেশ লাগে, তাই ভাবলুম রামচন্দ্র নামটা নিলে মন্দ হয় না।
আপনি আসলে কে তাহলে?
লোকটা মাথাটা একটু নেড়ে বলে, সে বাপু অনেক কথা। তবে সোজা কথায় আমি এ তল্লাটের লোক নই, এই দেশের নই, এমনকি এই হতচ্ছাড়া নোংরা গ্রহেরও নই। অনেক দূরের পাল্লা রে বাপু। আর আমার এই হনুমানটিও আসল হনুমান নয়। কলের হনুমান। তবে কল হলেও বড় খুঁতখুঁতে, সবাইকে পছন্দ করে না। দুনিয়া ঘুরে ঘুরে মাত্র একটা লোককেই ও বেছে বের করেছে। সে হলো তুমি।
নিবারণবাবু ঘন ঘন চোখ কচলাচ্ছিলেন। প্রত্যয় হচ্ছে না। যা শুনছেন সব সত্যি নাকি? এসব তো কল্পবিজ্ঞানে থাকে।
রামচন্দ্র বলল, তোমাদের গ্রহটা নোংরা হলেও মহাকাশে আমার কাজের পক্ষে সুবিধেজনক।
আমার হনুমানকে তাই তোমাদের গ্রহে পাকাপাকি ভাবে রেখে যেতে চাই। সমস্যা হলো, ওকে ঠিকমতো দেখাশুনা করার লোক চাই! ও তোমাকে খুঁজে বের করেছে, কাজেই ওর ভার তোমাকেই নিতে হবে।
নিবারণবাবু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, যে আজ্ঞে, তবে কেমন যত্নআত্তি করতে হবে?
খুব সোজা, ওর মাথায় একটা ছোট্ট ফুটো আছে, চাদির একেবারে মাঝখানে। এই তেলের কৌটোটা নাও, মাসে একবার ওই ফুটোর মধ্যে দু’ফোঁটা তেল ঢেলে দিলেই হবে। আর তোমার বাড়ির জাম গাছটাতেই ও থাকবে। ওকে যেন কেউ বিরক্ত না করে দেখো। বেশি বিরক্ত করলে কিন্তু ও গা থেকে এমন রশ্মি বের করতে পারে যা তোমাদের পক্ষে বিপজ্জনক।
নিবারণবাবু শিউরে উঠে বললেন, যে আজ্ঞে।
আর তুমি ইচ্ছে করলে ওকে ফাঁইফরমাস করতে পারো, ওর সঙ্গে হিল্লি-দিল্লি বেড়িয়ে আসতে পারো।
নিবারণবাবু স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন, যে আজ্ঞে।
তাহলে এসো গিয়ে। কোনওরকম গোলমাল কোরো না কিন্তু।
আজ্ঞে না।
লোকটা অর্থাৎ রামচন্দ্র গটগট করে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা শিস দিল। অমনি মাটির তলা থেকে একটা কিস্তৃত পটলাকৃতি মহাকাশযান বেরিয়ে এল। লোকটা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই জিনিসটা সাঁ করে আকাশে উঠে মিলিয়ে গেল।
নিবারণবাবু এখন বেশ আছেন। হনুমানটা জাম গাছেই থাকে। তবে তাকে আর ভয় পাওয়ার কারণ নেই। বরং মাঝরাতে হনুমানটা এসে তার সঙ্গে দিব্যি আড্ডা দিয়ে যায়। ঘরের কাজকর্মও অনেক করে দেয়। গিন্নি তো পছন্দ করেনই, বিশু আর কানুরও সে বেশ বন্ধু হয়ে গেছে।
হনুমানকে তেল দিতে নিবারণবাবুর একবারও ভুল হয় না।