কিন্তু অফিস তো আর কামাই করা যায় না, নিবারণবাবু ছাতাখানা ফট করে খুলে তার নীচে আত্মগোপন করে প্রাণপণে দৌড় লাগালেন। কিন্তু স্পষ্ট টের পেলেন, জাম গাছটা পেরোনোর সময় হনুমানটা তার ছাতায় একটা খাবলা মারল।
গত তিনদিন ধরে নিবারণবাবুর জীবনে আর শান্তি নেই। আসতে হনুমান, যেতে হনুমান। হনুমানটা কেন যে শুধু তার পিছনে লাগছে। তা চিন্তা করে করে তিনি হয়রান। খেতে পারছেন না, ঘুমোতে পারছেন, তিনদিনেই বেশ রোগা হয়ে গেছেন। তাঁর দুই ছেলে কানু আর বিশু হনুমানটাকে তাড়ানোর জন্য বিস্তর ঢিল আর গুলতি ছুঁড়েছে, তাদের সঙ্গে পাড়ার ছেলেরাও। কিন্তু বিশেষ লাভ হয়নি। হনুমানটা গাছের মগডালে উঠে ঘন ডালপালার মধ্যে চুপচাপ বসে আছে। ইট-পাটকেল তার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারেনি।
গিন্নি বললেন, পূর্বজন্মে ও তোমার ভাই ছিল, তাই এত টান।
নিবারণবাবু খিঁচিয়ে উঠে বললেন, হনুমানের ভাই হতে আমি যাবো কেন?
দুশ্চিন্তা নিয়েই নিবারণবাবু রাতে শুয়েছেন। তবে ঘুআসছেনা। মাথাটা বেশ গরম। কাল সকালেই আবার বাজার আছে, অফিস আছে। জাম গাছতলা ছাড়া যাওয়ার পথ নেই। শুয়ে এপাশ ওপাশ করছেন। কিছুদিনের ছুটি নিয়ে
পুরী বা ওয়াল্টেয়ার ঘুরে আসবেন কিনা তাও ভাবছেন।
হঠাৎ একটা বিকট হুপ শব্দে নিস্তব্ধ রাতটা যেন কেঁপে উঠল। নিবারণবাবু চমকে উঠে বসলেন আতঙ্কে। অন্ধকার ঘর, তবু জানলার দিকে চেয়ে তার বুক হিম হয়ে গেল। জানলাটা অর্ধেক ভেজানো ছিল। এখন জানলাটা পুরো খোলা। আর গ্রিল ধরে সেই অতিকায় হনুমানটা দাঁড়িয়ে। দু’খানা চোখ ভাটার মতো জ্বলছে।
ভয়ে এমন সিঁটিয়ে গেলেন নিবারণবাবু যে, কাউকে ডাকতে পারলেন না, গলা দিয়ে স্বরই বেরোলো না তার। কিছুক্ষণের জন্য যেন পাথর হয়ে গেলেন।
হঠাৎ একটা বেশ ভরাট গমগমে গলা বলে উঠল, ভয় পাবেন না…ভয়ের কিছু নেই…।
বিস্ময়ে হতবাক নিবারণবাবু কে কথা বলল, তা চারদিকে চেয়ে খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু ঘরের মধ্যে কারও থাকার কথা নয়।
কণ্ঠস্বরটি ফের বলে উঠল, রামচন্দ্র আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি তার দূত মাত্র।
নিবারণবাবু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। স্বপ্ন দেখছেন কিনা তা বুঝবার জন্য হাতে একখানা রাম চিমটি কেটে নিজেই উঃ করে উঠলেন।
গলাটা বলল, স্বপ্ন নয়। যা দেখছেন, যা শুনছেন সব সত্যি। নিবারণবাবু হনুমানের দিকে চেয়ে কঁপা কাঁপা গলায় বললেন, কথাগুলো কি আপনিই বলছেন? মানুষের ভাষায়?
আজ্ঞে হ্যাঁ, কিন্তু আমাদের হাতে সময় বিশেষ নেই। রামচন্দ্র অপেক্ষা করতে ভালবাসেন না।
রামচন্দ্র কে?
আমার প্রভু।
কোথায় তার সঙ্গে দেখা করতে হবে?
আপনি আমার সঙ্গে যাবেন।
ও বাবা! আমি পারব না, আমার বড় ভয় করছে।
ভয় কিসের?
আমার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে ঠেকছে।
গোলমালের কিছু নেই। চলে আসুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে। নিবারণবাবু বুঝলেন, এসব ভূতুড়ে কাণ্ড। এবং বেশ জবরদস্ত ভূতের পাল্লায় তিনি পড়েছেন। তবে এখনও উদ্ধারের উপায় আছে। তিনি ঘুমন্ত গিন্নিকে প্রবল ধাক্কা দিয়ে জাগাতে জাগাতে কানু আর বিশুকে প্রাণপণে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন। সে এমন রামধাক্কা আর বিকট চেঁচানি যে মরা মানুষেরও উঠে বসবার কথা। কিন্তু কোনও সাড়াশব্দই পেলেন না। হনুমান বলল, ওদের ঘুম এখন ভাঙবে না। বৃথা চেঁচামেচি করছেন। ভয়ে নিবারণবাবুর শরীর প্রথমে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এখন তার ভয়ে আবার কলকল করে ঘাম হতে লাগল। বুকের ভিতরটা এমন ধড়ফড় করছে যে, হার্টফেল হওয়ার জোগাড়।
ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, আমাকে ছেড়ে দাও বাবা, এসব আমার ভাল লাগছে না।
নিবারণ শুয়ে পড়ে জোর করে চোখ বন্ধ করে রইলেন।
হনুমান বলল, নিবারণবাবু, প্রভুর হুকুম তামিল না করে আমার উপায় নেই। আপনি সহজে না গেলে জোর করে নিয়ে যেতে হবে।
এই বলে হনুমান চুপ মারল। নিবারণবাবু চোখ মিটমিট করে দেখতে পেলেন, হনুমান দু’হাতে গ্রিল ধরে টানাটানি করছে। শক্ত লোহার গ্রিল, ভাঙতে পারবে বলে মনে হলো না নিবারণবাবুর।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হনুমান মাত্র একটা হ্যাঁচকা টানেই পুরো গ্রিলটা জানলার ফ্রেম থেকে উপড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল।
নিবারণবাবু এত ভয় পেয়েছেন যে, আরও বেশি ভয় পাওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। মজা হলো ভয় যখন সাংঘাতিক বেশি হয় তখন মানুষের একটা মরিয়া সাহসও আসে। চোর তাড়ানোর জন্য খাটের মাথার কাছে একখানা মোটা বেতের লাঠি রাখা থাকে। আজ অবধি সেটা কোনও কাজে লাগেনি। আজ লাগল। নিবারণবাবু ভাবলেন, এমনিতেও গেছি, অমনিতেও গেছি, সুতরাং আর ভয়ের কী? যা থাকে কপালে–
ভেবে লাফিয়ে উঠে তিনি লাঠিটা নিয়ে প্রবল বিক্রমে হনুমানের মাথায় বসিয়ে দিলেন। কিন্তু বসালেও লাঠিটা ঠিকমতো বসল না।
হনুমান খুব আলগা হাতে লাঠিটা কেড়ে নিল হাত থেকে, তারপর সেটাকে পাকাটির মতো ভেঙে ফেলে বলল, কেন ঝামেলা করছেন? প্রভু রামচন্দ্র ডাকছেন, এ আপনার মহা সৌভাগ্য।
নিবারণবাবু যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। হনুমানটা লম্বায় প্রায় তার সমান। আর চওড়ায় কুস্তিগীরদের মতো। এত বড় হনুমান তিনি এর আগে আর দেখেননি। বিপদে পড়ে মাথাটা একটু গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল বলে তিনি হনুমানের কথাগুলো শুনেও বুঝবার চেষ্টা করেননি। এবার তার হঠাৎ মনে হলো, এ কি সেই রামচন্দ্রের হনুমান নাকি? হনুমান তো অমর, তার এখনও পৃথিবীতে বেঁচেবর্তে থাকবার কথা। আর প্রভু রামচন্দ্র তিনি তো স্বয়ং ভগবান। তাহলে এসব হচ্ছেটা কী? রামচন্দ্র তার ভক্ত হনুমানকে পাঠিয়েছেন তাকে ডাকবার জন্য? কিন্তু কেন? তিনি তো তেমন উঁচুদরের ভক্ত বা ধার্মিক নন!