কিন্তু আমার যে ব্যবসা লাটে উঠতে বসেছে তোমার জন্য।
তার আমি কী করব? গোমড়ামুখো লোক আমি দু’চোখে দেখতে পারি ।
কালুরামের এবার ভয় কেটে গিয়ে খুব রাগ হল। এই ফিচেলটা যদি সে নিজেই হয়ে থাকে তাও ক্ষমা করা যায় না। সে রাগে গরগর করে বলে উঠল, ভাল চাও তো শিগগির ফের আমার ভিতরে ঢুকে পড়ো। নইলে–
নইলে কী করবে? তোমাকে ভয় খাই নাকি?
তবে রে–বলে কালুরাম গলার স্বরটা লক্ষ্য করে অন্ধকারে আঁপিয়ে পড়ল দ্বিতীয় কালুরামের ওপর।
তারপর যা ঘটল তা আর কহতব্য নয়। ধুন্ধুমার লড়াই চলতে লাগল। ক্যামেরা-ট্যামেরা সব উলটে পড়ে গেল, কাঁচ ভাঙল, চেয়ার ওলটাল, কালুরামের গা থেকে গলগল করে ঘাম ঝরতে লাগল। কিন্তু কে হারল, কে জিতল তা ঠিক বোঝা গেল না। তবে এক সময়ে লড়াই থামল। কালুরাম তখন মেঝের ওপর পড়ে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাঁফাচ্ছে। পাশাপাশি আর-একটা লোকও পড়ে আছে, টের পেল কালুরাম।
একটু মায়া হল কালুরামের। শত হলেও লোকটা তো সে নিজেই। লোকটার দিকে হাত বাড়িয়ে কালুরাম বলল, খুব লেগেছে নাকি?
তুমি মহা পাজি লোক।
আহা রাগ করো কেন? মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল। ওঠো, হাতে মুখে জল দিয়ে এসো।
তুমি দাও, তা হলেই আমারও হবে।
একটা কথা ছিল।
কী কথা? বলছিলাম কি, এবার আর আমি অত গোমড়ামুখো থাকব না। বেশ হাসিখুশি লোক হয়ে যাব। চাও তো বেশ জম্পেশ গোঁফও রাখতে পারি।
মাঝে মাঝে নিজের ফটো তোলাবে?
তাও তোলাব। সব হবে। এবার টুক করে আমার মধ্যে ঢুকে পড়ো তো কালুরাম।
কালুরাম কালুরামের মধ্যে ঢুকে পড়ল। পরদিন থেকে আর কালুরামের ফটোতে কোনো গণ্ডগোল রইল না।
হনুমান ও নিবারণ
নিবারণবাবু শান্তিপ্রিয় মানুষ। কারও সাতেও নেই পাঁচেও নেই। উটকো উৎপাত তিনি পছন্দ করেন না। তবু তার কপালেই হালে এক ঝামেলা এসে জুটেছে। বাড়ির সামনেই একখানা পেল্লায় জাম গাছ। সেই গাছে দু তিন দিন আগে হঠাৎ কোথা থেকে এক বিশাল জাম্বুবান কেঁদো হনুমান এসে থানা গেড়েছে। এ তল্লাটে হনুমান বাঁদর ইত্যাদি কোনও কালেই ছিল না। হনুমানটা যে কোথা থেকে উটকো এসে জুটল তা কে জানে!
তা হনুমান আছে থাক, নিবারণবাবুর তাতে বিশেষ আপত্তি নেই। হনুমান হনুমানের মতো থাক, তিনি থাকবেন তার মতো। কিন্তু এই ব্যাটাচ্ছেলে হনুমান কি করে যেন টের পেয়েছে যে, এ পাড়ায় সবচেয়ে নিরীহ ভাল মানুষ হলো এই নিবারণ ঘোষাল। হতচ্ছাড়া আর কাউকে কিছু বলে না, কারও দিকে দৃকপাত অবধি নেই। কিন্তু নিবারণবাবু বাড়ি থেকে বেরোলেই জামগাছে তুমুল আলোড়ন তুলে হুপহাপ দুপদাপ করে দাপাদাপি করতে থাকে।
প্রথম দিনের ঘটনা। শান্ত শরৎ কালের মনোরম সকাল। সোনার থালার মতো সূর্য উঠেছে। চারদিকে একেবারে আহ্লাদী বোদ। একটানা কোকিলও কুহুস্বরে ডাকছিল। নিবারণবাবু থলি হাতে প্রশান্ত মনে বাজার করতে বেরিয়েছেন। দুর্গানাম স্মরণ করে চৌকাঠের বাইরে সবে পা রেখেছেন, এমন সময়ে হঠাৎ জাম গাছটায় ওই তুমুল কাণ্ড। নিবারণবাবু সভয়ে আবার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। তিনি ভারী ভীতু লোক।
গিন্নি বললেন, কী হলো, ফিরে এলে কেন?
নিবারণবাবু আমতা আমতা করে বললেন, জাম গাছে কী যেন একটা কাণ্ড হচ্ছে।
গিন্নি হেসে বললেন, ও তো একটা হনুমান! কাল আমিও দেখেছি। পাড়ার ছোঁড়ারা ঢিল মারছিল।
নিবারণবাবু একটা নিশ্চিন্দির শ্বাস ফেলে বললেন, তাই বলো। হনুমান। জাম গাছতলা দিয়েই রাস্তা আর রাস্তা দিয়ে মেলা লোক যাতায়াত করছে। দুধওয়ালা, কাগজওয়ালা, বাজারমুখো এবং বাজারফেরত মানুষ, ঝাড়ুদার। হনুমান কাউকে দেখেই উত্তেজিত নয়, কিন্তু যেই নিবারণবাবু ফের দরজার বাইরে পা দিয়েছেন অমনি লম্ফঝম্প শুরু হয়ে গেল।
নিবারণবাবু তখন সাহসে ভর করে একটু দৌড় পায়েই জাম গাছটা পেরিয়ে গেলেন বটে, কিন্তু কেমন যেন একটা অস্বস্তি রয়ে গেল মনের মধ্যে।
তবে সেদিন বাজারে গিয়ে মনটা ভারী ভাল হয়ে গেল। সস্তায় বেশ বড় বড় পাবদা মাছ পেয়ে গেলেন। মরশুমের প্রথম ফুলকপি একটু দর করতেই দাম নেমে গেল, আর এক আঁটি ধনেপাতা কিনে ফেললেন মাত্র চার আনায়। বাজার সেরে যখন ফিরছেন তখন আর হনুমানটার কথা তার খেয়াল নেই। যেই আনমনে জাম গাছটার কাছাকাছি এসেছেন অমনি ডালপালায় তুমুল শব্দ করে হনুমানটা নেমে এল একেবারে নীচে। একখানা ডাল ধরে এমন ঝুল খেতে লাগল যে তার লেজখানা নিবারণবাবুর নাকের ডগা ছোঁয়-ছোঁয়। নিবারণবাবু জীবনে দৌড়ঝাঁপ বিশেষ করেননি, তবু হনুমানের হামলা থেকে বাঁচার জন্য সেদিন এমন দৌড় দিলেন যে তার ছোট ছেলে বিশু অবধি পরে প্রশংসা করে বলেছিল, বাবা, তুমি যদি সিরিয়াসলি দৌড়োতে তাহলে অলিম্পিক থেকে প্রাইজ আনতে পারতে। চটি পরা পা আর বাজারের ব্যাগ নিয়ে যে কেউ অমন দৌড়াতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না।
দৌড়টা যে ভালই হয়েছিল তা নিবারণবাবুও জানেন, তবে শেষ অবধি চটিজোড়া পায়ে ছিল না, ছিটকে পড়েছিল। আর বাজারের ব্যাগ হাতছাড়া হয়ে সাধের পাবদা মাছ চারটেকে নিয়ে গেল, ছ’খানা ডিম ভাঙল আর রাস্তার একটা গরু দুখানা ফুলকপি চিবিয়ে খেয়ে নিল।
দ্বিতীয়বার ঘটনাটা ঘটল অফিসে বেরোনোর সময়। নিস্তব্ধ জাম গাছতলা দিয়ে বিস্তর লোক বিষয়কর্মে যাচ্ছে আসছে। কিন্তু টিফিনকৌটো নিয়ে ছাতা বাগিয়ে গালে পানটি পুরে দুর্গানাম স্মরণ করে যেই নিবারণবাবু বেরোলেন অমনি জামগাছে যেন ঝড় উঠল। হনুমানটা এ ডালে ও ডালে ভীষণ লাফালাফি করতে করতে হুপহাপ করে বকাঝকাই করতে লাগল বোধহয়!