পাত্র! পাত্র নয়। আসলে
এস. ডি. ও. সাহেব কালুর কথায় কর্ণপাত না করে বললেন, আমরা হলুম কুলীন কায়স্থ। আমার মেয়েকে তো দেখেছেন! একটু কালো। আর দাঁতগুলো যা একটু উঁচু। এ ছাড়া নিখুঁত সুন্দরী। মনে করে যে পাত্রের খবর এনেছেন তাতে ভারি খুশি হয়েছি। পাত্র আমার পছন্দসই। তবে গোঁফজোড়া বড্ড প্রমিনেন্ট। মিলিটারি হলে তো খুবই ভাল। দাঁড়ান। মেয়ের মাকে ফটোটা দেখিয়ে আনি।
সত্য বটে, কালুরাম অনেক জায়গায় ঘোরে বলে তাকে এস. ডি. ও. সাহেব মেয়ের জন্য পাত্রের কথা বলেছিলেন। কিন্তু এ যে পাত্র নয় সেই কথাটা কালুরাম আর বোঝাতে পারল না।
এস. ডি. ও. সাহেব ফিরে এসে হাসিমুখে বললেন, পাত্র আমাদের খুব পছন্দ। তাড়াতাড়ি সম্বন্ধটা এনে ফেলুন। পাত্রের বাবার ঠিকানাটাও দরকার।
কালুরাম বেজার মুখে বলল, যে আজ্ঞে।
জনে-জনে ছবিটা দেখিয়ে বেড়াল বটে কালুরাম, কিন্তু সুবিধে হল না। ফিচেল লোকটা যে কোত্থেকে এসে ছবিতে উদয় হয় তা বোঝা গেল না।
কালুরাম নিজে ফটোগ্রাফার হলেও তার নিজের ছবি কস্মিনকালেও তোলেনি। বলতে কি, কালুরামের কোনো ফটোও নেই। কয়েকদিন দুশ্চিন্তায় কাটিয়ে কালুরাম স্থির করল, টাইমার দিয়ে এবার সে নিজের কয়েকটা ছবি তুলবে। লোকটা যদি তার আশেপাশে এসে হাজির হয় তা হলে টপ করে চেপে ধরবে বাছাধনকে।
নিজের স্টুডিওর ভিতরে ক্যামেরা ফিট করে সামনে চেয়ার বসিয়ে কালুরাম তৈরি হল। সেলফ টাইমারের বোতাম টিপে গিয়ে চেয়ারে বসল। তারপর দু’ধারে হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলল, হুঁ হুঁ বাবা, এত সোজা নয়। এসো দেখি এবারে বাছাধন, দেখাব মজা।
ক্লিক করে ক্যামেরার অটোমেটিক শাটারের শব্দ হল। কালুরাম চারদিকে চেয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হল, কেউ নেই।
কিন্তু ছবিটা প্রিন্ট করার পর কালুর একগাল হাসি। ছবিতে তার নিজের চিহ্নও নেই। চেয়ারে সেই ফিচেল লোকটাই গোঁফ চুমরে হাসি-হাসি মুখে বসে আছে।
কালুরাম দুশ্চিন্তায় ঘেমে উঠল। অন্য সব ছবিতে লোকটা এসে হানা দেয় বটে, কিন্তু যাদের ছবি তোলা হয় তাদের কেউ অদৃশ্য হয়ে যায় না। কিন্তু এ ছবিতে তা-ই ঘটেছে। কালুরাম সম্পূর্ণ অদৃশ্য। বসে আছে ফিচেলটা।
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কালুরাম স্টুডিওতে বসে বসে রাত গভীর করে ফেলল। তার দেরি দেখে ভিতর বাড়ি থেকে তার স্ত্রী এসে বললেন, কী ব্যাপার। তুমি এখনও বসে বসে কী করছ? রাত হয়ে গেছে যে!
কালুরাম বিরসবদনে বলল, বড় চিন্তা হচ্ছে।
কিসের চিন্তা! বাঃ, এই ছবিটা কোথায় পেলে? এই বলে কালুরামের বউ ফিচেলের ফটোটা তুলে নিয়ে মন দিয়ে দেখতে লাগলেন।
কালুরাম কৌতূহলী হয়ে বলল, ছবিটা কেমন দেখছ?
চমৎকার। দেখাওনি তো আমাকে কখনও? চেনো নাকি লোকটাকে?
কালুরামের বউ অবাক হয়ে বলল, ও আবার কীরকম কথা? যার সঙ্গে পঁচিশ বছর ঘর করছি তাকে চিনব না মানে? বিয়ের সময় তো তোমার এই গোঁফই ছিল! ঝাটা গোঁফ পছন্দ করি না বলে বকে বকে ঘাঁটিয়েছিলুম। ওই তো গালের আঁচিলটা দেখা যাচ্ছে। আর এই যে বা জ্বর ওপর কাটা দাগ!
কালুরামের মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, কিন্তু…কিন্তু…
বউ হেসে বলল, তুমি তো জন্মেও ফটো তোলাও না। এমন কি বিয়ের সময় পর্যন্ত ছবি তোলাতে রাজি হওনি। আমার যেজন্য ভারি দুঃখ ছিল। যে দুনিয়াসুদ্ধ সকলের ফটো তুলে বেড়ায় তার নিজের কোনো ফটো নেই। কিন্তু এই ফটোটা যে তুলিয়েছিলে তা কখনও বলোনি তো। এটা আমি নিলুম, বাঁধিয়ে রাখব।
কালুরামের একেবারে বাক্য হরে গেল। তবে কথাটা মিথ্যেও নয়। তার হঠাৎ মনে পড়ল, ঠিক এইরকম গোঁফ সে যৌবনে রাখত বটে। গালের আঁচিল এবং জ্বর ওপর কাটা দাগ এখনও আছে। সে ফিচেল হাসিও হাসতে জানত এক সময়ে। না, সন্দেহ নেই। এটা তারই ছবি বটে। তবে যৌবনকালের ছবি।
ফটোগ্রাফার কালুরাম রাতে ঘুমোতে পারল না। এপাশ ওপাশ করতে লাগল। তারপর এক সময়ে থাকতে না পেরে ভূতের মতো গিয়ে নিজের অন্ধকার স্টুডিওতে ঢুকে বসে রইল। সে নিজেই কী করে ছবির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে? তাও এখনকার সে নয়, যৌবনের সে!
ভাবতে ভাবতে কালুরাম বিড়বিড় করে বলল, অসম্ভব! এ হতে পারে না। আমারই মাথার গণ্ডগোল।
অন্ধকারে ফিচ্ করে কে যেন হাসল।
কালুরাম চমকে উঠে বলল, কে রে?
আমি গো আমি। আমি কালুরাম। তার মানে আমি হচ্ছি তুমিই।
অ্যাঁ! বলে কালু হাঁ করে রইল।
অবিশ্বাসের কী আছে হে? আমিই তুমি। বহুকাল ধরে একসঙ্গেই আছি।
কালুরাম কথা বলতে পারছিল না। অনেক কষ্টে শুধু বলল, কী করে হয়?
ফিচ্ করে একটু হাসি শোনা গেল অন্ধকারে। ফিচেলটা বলল, কালুরাম, এক সময়ে তোমার গোঁফ ছিল, হাসি ছিল, মজা ছিল। এখন তুমি এক গোমড়ামুখো ফটোগ্রাফার। তোমার ভিতরকার হাসিখুশি কালুরামটা শুকিয়ে যাচ্ছিল। তাই একদিন হাসিখুশি কালুরাম গোমড়ামুখো কালুরামের ভিতর থেকে ফট করে বেরিয়ে এসেছে।
অ্যাঁ! বলো কী?
তাই তো বলছি। গোমড়ামুখো কালুরামের সঙ্গে পোষাল না বলে ভেন্ন হয়েছি, তাই বলে কি আর খুব তফাত হতে পারি? কাছাকাছিই আছি হে। কিন্তু ফটোর ভিতরে ঢুকছু কী করে?
খুব সোজা। আমাকে এমনিতে তুমি দেখতে পাও না বটে, কিন্তু তোমার ক্যামেরা তো আমাকে ভালই চেনে। তোমাকে জব্দ করার জন্য হুট করে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যাই।