এর পরের ফটো খুবই সাদামাটা। মহেশ দত্তর একমাত্র ছেলের বিয়ে। ছেলে আর ছেলের বউ নিয়ে মহেশ দত্ত আর তার গিন্নি ছবি তুলবেন। মোট চারজন। কালুরাম খুবই সর্তক হয়ে চারদিক দেখে নিয়ে তবে সাবধানে ছবিটা তুলল। না, এবার আর কোনো উটকো লোক ঢুকে পড়তে পারেনি। বড় গ্রুপ তো নয়।
কিন্তু নিজেদের ডার্ক রুমে নেগেটিভটা দেখতে গিয়ে কালুরামের বুক আর হাত দুটোই কেঁপে গেল। সামনে পাশাপাশি দুটো চেয়ারে দত্ত আর দত্তগিনি, পিছনে দাঁড়ানো ছেলে আর ছেলের বউ। কিন্তু তাদের মাঝখানে আরেক জন। নির্ভুল আরেক জন। কালুরাম দুই চোখ কচলে নিয়ে ফের দেখল। ভুল নেই। তারপর নেগেটিভ প্রিন্ট করে দেখল, সেই ফিচেল গোঁফওয়ালা লোকটাই।
দত্তবাবু ছবি দেখে অবাক হয়ে বললেন, এ কী? আমার ছেলে আর বউমার মাঝখানে এটা কে?
কালুরাম সতর্ক হয়ে গেল। তার দোষ বলে দত্তবাবু যদি ছবির দাম দেন। সে মাথা চুলকে বলল, দেখুন, ছবি তোলার কথা, তুলে দিয়েছি। লোকজন কে কোত্থেকে এল তা বলি কী করে? আপনাদেরই কেউ হবে।
দত্তবাবু রাশভারী লোক। গম্ভীর মুখ করে বললেন, আমার বাড়িতে এরকম কোনো লোক নেই। তবু খোঁজ নিয়ে দেখছি বউমার বাপের বাড়ির কেউ সেদিন হঠাৎ হাজির হয়েছিল কি না।
বউমাকে ডাকানো হল। তিনি ছবি দেখে চোখ গোল করে বললেন, তো! সেদিন তো কেউ আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়নি! আর একে তো কস্মিনকালেও দেখিনি।
কালুরাম ঘন ঘন মাথা চুলকোতে লাগল। দত্তবাবু গম্ভীরতর হয়ে বললেন, বুড়ো বয়সে তোমার গণ্ডগোল হচ্ছে। অন্য কোনো ছবির নেগেটিভের সঙ্গে মিশিয়ে প্রিন্ট করেছ নিশ্চয়ই। নাঃ, দেখছি অন্য কোনো ফটোগ্রাফার ডাকিয়ে নতুন করে ছবি তোলাতে হবে।
এইভাবে কালুরামের ব্যবসা লাটে ওঠার জোগাড় হল। অন্য সব চ্যাংড়া ফটোগ্রাফার দিব্যি ছবি তুলে বেড়াচ্ছে, কারও কোনো গোলমাল হয় না। কিন্তু কালুরাম ক্যামেরা ক্লিক করলেই কোত্থেকে গোঁফওয়ালা ফিচেল লোকটা এসে হাজির হয় তা কালুরাম আকাশ-পাতাল ভেবেও বুঝতে পারছে না। ক্যামেরা বা ফিল্মের কোনো দোষ নেই, কালুরাম ভালই জানে। প্রিন্টেও কোনো গণ্ডগোল সে করছে না। তবে এটা হচ্ছেটা কী?
কালুরাম ফিচেল লোকটার ছবি নেগেটিভ থেকে কেটে এনলার্জ করে ভাবভাবে মুখটা স্টাডি করল। লোকটার বয়স ত্রিশের মধ্যেই। গোঁফজোড়া বেশ মিলিটারি ধাঁচের এবং জম্পেশ। মাথায় অনেক চুল। চেহারাটা ভালই। হাসিটাও খারাপ বলা যায় না। যাকে ফটোজেনিক ফেস বলে তাই। ক্যামেরায় যখন ধরা পড়েছে, তখন লোকটাও কোথাও না কোথাও আছে। কিন্তু কোথায় আছে?
কালুরামের রীতিমতো দুশ্চিন্তা হতে লাগল। ভয়ও হতে লাগল। খাওয়া কমে গেল। ঘুম কমে গেল। শরীরটা বেশ রোগাও হয়ে গেল। পুরনো ক্যামেরাগুলো কালুরাম ভাল করে পরিষ্কার করে নিল। ফিল্ম পাল্টে ফেলল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। নিতান্তই একটা সূর্যাস্তের ছবি তুলেছিল কালুরাম। তাতেও দেখল, সেই লোকটা ঠিক ছবির বা কোণে দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে।
অগত্যা লোকটার এনলার্জ করা ছবিটা নিয়ে কালুরাম দাবোগাবাবু হরিহরের সঙ্গে দেখা করে বলল, একটু মুশকিলে পড়ে এসেছি।
দারোগাবাবু কালুরামকে ভালই চেনেন। তিনি বললেন, আরে এসো, এসো। অনেক কাল তোমাকে দেখি না। তা আমি তো ভাই শিগগিরই রিটায়ার করব। আমার এই ইউনিফর্ম-পরা চেহারাটা একদিন বেশ জুত করে তুলে দাও তো।
কালুরাম আমতা-আমতা করে বলল, সে আর বেশি কথা কী? দেব’খন তুলে। আচ্ছা দারোগাবাবু, এই লোকটাকে কি চেনা-চেনা ঠেকছে? একটু ভাল করে দেখুন তো।
ছবিটা দেখেই দারোগাবাবু চমকে উঠলেন, কোথায়! কোথায় সে। এক্ষুনি একে ধরা দরকার।
দারোগাবাবু এমন চেঁচামেচি শুরু করলেন যে কালুরাম ঘাবড়ে গেল। আমতা-আমতা করে বলল, এ কি কোনো ফেরার আসামী? দারোগাবাবুর চেঁচামেচিতে সেপাই-সান্ত্রী ছুটে এসেছে।
দারোগাবাবু কালুরামের দিকে চেয়ে বললেন, কোথায় লোকটা? কালুরাম দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বলল, তা তো জানি না।
কিন্তু এ কে দারোগাবাবু?
কে! কে তা কি তুমি জানো না?
আজ্ঞে না।
কিন্তু এই যে বললে লোকটা খুনী!
কালুরাম অবাক হয়ে বলে, কখন বললুম?
বলোনি?
না তো!
তা হলে কি ডাকাত?
তাও তো জানি না।
দারোগাবাবু রুমালে মুখের ঘাম মুছে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপর হাতের ইঙ্গিতে সেপাই-সান্ত্রীদের বিদেয় দিয়ে বললেন, তা হলে লোকটার ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন? যেভাবে ছবিটা বের করে দেখালে তাতে তো আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে, লোকটা নির্ঘাত কোনো খুনী, ডাকাত, ফেরার আসামী।
কালুরাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, আপনার ব্লাডপ্রেশারটা বোধহয় খুব বেশি।
দারোগাবাবু বললেন, হ্যাঁ বড্ড বেশি। একটুতেই এমন অ্যাজিটেটেড হয়ে যাই। তা লোকটা তা হলে কে?
সেইটে জানতেই তো আপনার কাছে আসা। লোকটাকে চোখে দেখতে পাইনি। অথচ যতবার যেখানেই ছবি তুলি, লোকটা ছবিতে এসে যায়।
অ্যাঁ, সে কী কথা!
আজ্ঞে। এমন-কি ডার্করুমে পর্দার ওপর আলো ফেলে ছবি তুলেও দেখেছি। ছবিতে কিছুই না থাকার কথা। কিন্তু এই লোকটা ঠিক ছবিতে চলে আসে।
রাম রাম রাম রাম। শিগগির ছবিটা নিয়ে বিদেয় হয়ে যাও।
কেন দারোগাবাবু?
এ ভূতের ছবি। আমার ওতে ভীষণ ভয়। ভূতটুত আমি আদপেই ভালবাসি না। কালুরাম উঠে পড়ল। তারপর সে এস. ডি. ও. সাহেবের সঙ্গে দেখা করল। এস. ডি. ও. সাহেব ভারি মিষ্টি শান্ত ভালমানুষ। মশামাছি অবধি মারেন না। ছবিটি দেখে মোলায়েম গলায় বললেন, পাত্রটি কে?