অর্গান্ডির মতো পাতলা নেটের পর্দা উড়ছে বাতাসে। কলের গান বাজছে, কী সুন্দর ঠাণ্ডা ঘর, নরম সোফা কৌচ, মহার্ঘ আসবাব, তবু এই পরিবেশে মানুষ কত নিষ্ঠুর ও হীন হতে পারে।
মা সবচেয়ে বেশি আমার ব্যথা বোঝে। চিরকাল মায়েদের এই ক্ষমতা। মা আমাকে একটু ঠেলে দিয়ে চাপা গলায় বলল, বাইরের বাগানটা তো সুন্দর, একটু ঘুরে-টুরে আয় না।
বেঁচে গেলাম।
সেই সুন্দর বাগানে প্রজাপতির খেলা দেখছি, আর মনে মনে নিজের জন্য লজ্জা হচ্ছে।
কোথায় পালাবো? কেমন করে? সংসারের বাইরে যাওয়া ছাড়া আমার যে উপায় নেই!
ভদ্রলোকের দশ বছর বয়সের মেম চেহারার মেয়েটি ছুটে আসে। ভয়ে এস্ত হয়ে তার দিকে চাই। সে কাছে চলে আসে বাতাসের মতো সাবলীল, কী সুন্দর জোরালো চেহারা তার, কী সদ্গন্ধ তার গায়ে! চোখে বিদ্যুৎ। নতুন অপমানের জন্য মনে মনে প্রস্তুত হতে থাকি। অপমান বা নিষ্ঠুরতা ছাড়া আমি বাইরের লোকজনের কাছ থেকে আর কিছুই আশা করতে পারি না যে!
সে বোধ হয় তার ইস্কুলে নিঃসঙ্কোচ ব্যবহার করতে শিক্ষা পেয়েছিল। এসে আমার হাতখানি ধরে বলল–চলো, ওই কোণে আমার পড়ার ঘর, সেখানে বসি। তোমার গলার স্বর খুব সুন্দর, নিশ্চয় তুমি খুব ভালো কবিতা পড়তে পারো।
সে তার পড়ার ঘরে নিয়ে গেল আমাকে, কত বই তাদের! সে একটা ডিভানে আমার পাশে বসে রবি ঠাকুরের কবিতার বই খুলে বলল
একদম বাংলা পড়তে পারি না স্কুলে। ইংরিজি স্কুল তো, শেখায় না, অথচ কবিতা পড়তে আমি যে কী ভালবাসি।
জড়তা কাটাতে সময় লেগেছিল, তবু ওই একটা বিষয় আমি পারতাম। ভাব ও অর্থ অনুসারী কবিতা পাঠ। পড়লাম। তার চোখে মুগ্ধতা দেখা দিল, তারপর করুণতর কবিতাগুলি পড়ার সময়ে অশ্রু। একটা বেলা কেটে গেল তার সঙ্গে।
–তুমি আমাকে শেখাবে? উঃ, কী যে পড়ো তুমি, শুনতে শুনতে যেন ভূতে পায়।
সংসারের বাইরে আর যাওয়া হয়নি। সুতো আজও ছিঁড়ি, কিন্তু কে যেন নতুন সুতোয় নতুন বঁড়শি অলক্ষ্যে গিলিয়ে দেয়।
সেই লোকটা
তার পুরনো আমলের ঢাউস ক্যামেরায় মল্লিকবাড়ির একটা গ্রুপ ফটো তুলতে হয়েছিল কালুরামকে। ফটো তোলায় তার নাম খুব। কালো কাপড়ে মাথা ঢেকে সে যখন তার তেপায়া ক্যামেরা অ্যাডজাস্ট করে তখন লোকে হাসে বটে, কিন্তু ফটো দেখলে সবাই অবাক মানে। কালুরাম এখন বুড়ো হয়েছে, কিন্তু এখনও সবাই তাকে ডাকাডাকি করে।
এই মল্লিকবাড়ির গ্রুপ ফটো তুলতে গিয়েই ঘটনাটা প্রথম ঘটল, যেমনটা কালুরামের ফটোগ্রাফির জীবনে আর কখনও ঘটেনি। নাদু মল্লিকের ছেলের পৈতে। সেই উপলক্ষে মেলা আত্মীয়-স্বজন এসেছিল। তার মধ্যে অনেক বুড়ো-বুড়ি ছিল, দূরের লোক ছিল। কে কবে মরে যায়, কার সঙ্গে আর দেখা হয় কি না হয়, তাই কালুরামকে ডাকিয়ে গ্রুপ ফটো তোলা হল। মোট একুশজন ছিল, কালুরামের মনে আছে। ছবিটা উঠলও সুন্দর, একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার ছবি।
কিন্তু ছবি ডেলিভারি নিয়ে নাদু মল্লিক হঠাৎ বলে উঠলেন, সবাইকে তো চিনতে পারছি, কিন্তু পিছনের সারিতে কোণের দিকে এই গোঁফওয়ালা লোকটা কে? একে তো সেদিন দেখা যায়নি?
কালুরাম অবাক হয়ে বলল, আপনাদেরই লোক, চিনতে না পারলে আমি কী করব?
নাদু মল্লিক মাথা নেড়ে বললেন, আমাদের লোক হতেই পারে না। তবে উটকো কেউ ঢুকে পড়েছিল নিশ্চয়ই। আমরা মোট একুশজন ছিলাম মনে আছে। কিন্তু এই লোকটাকে নিয়ে বাইশজন হচ্ছে। গুনে দেখুন।
কালুরাম গুনে তাজ্জব। সে পুরনো আমলের লোক। যা করে তা একেবারে পাকা কাজ। ক’ জনের ফটো তুলতে হবে এবং কীভাবে তার সাজিয়ে নিতে হবে এসব তার হিসেব করে নিতে হয়। যতদূর মনে পড়ছে, এ লোকটাকে সে সারিতে দেখেনি, আর লোকটা দাঁড়িয়েছে আরেক জনের কাঁধে হাত রেখে এবং একটু হেলে। ভঙ্গিটা মোটেই ভাল নয় ফটো তোলার পক্ষে। কালুরাম ফটো তোলার সময় ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি কেন সেইটেই তার মাথায় ঢুকছে না। এতকালের অভ্যাসে গণ্ডগোল হয়ে গেল! তার মানে কি সে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে?
মল্লিকবাড়ির ব্যাপারে খটকাটা রয়ে গেল বটে, কিন্তু হাটখোলার ব্যানার্জিদের বাড়িতে বুড়ো সদাশিব বাঁড়ুজ্যে সাতানব্বই বছর বয়সে মারা যাওয়ায় ফটো তোলার জন্য কালুরামের ডাক পড়ল। এবং ফের ফটো নিয়ে গণ্ডগোল। এবারকার গণ্ডগোলটা কালুরামকে রীতিমতো উদ্বেগে ফেলে দিল। এ ফটোটাও ভাল উঠেছে। সামনে ফুলে সাজানো খাঁটিয়ায় সদাশিববাবু শুয়ে; বুকের উপর ভাগবদগীতা। পিছনে ছয় ছেলে, তিন মেয়ে, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনী ও তস্য পুত্রপৌত্রাদি। সব মিলিয়ে বেশ একখানা ভিড়ের দৃশ্য! শোকবিহ্বল ভিড়। কিন্তু পিছনের সারিতে সদাশিবের বড় আর মেজো ছেলের মাথার মাঝখান দিয়ে একটা ফিচেল মুখ বেরিয়ে আছে। মুখে ইয়ার্কির হাসি। আর সেই গোঁফ! কালুরাম মুখখানা দেখে তাজ্জব হয়ে গেল। এ যে চেনা মুখ! কালুরাম মল্লিকবাড়ির গ্রুপ ফটোটা বের করে মিলিয়ে নিল। কোনো ভুল নেই। এ সেই লোক।
সদাশিবের বড় ছেলে রামশিব ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ উঠে বললেন, এ লোকটা কে? এ তো আমাদের পরিবারের কেউ নয়। এ কোত্থেকে এল?
কালুরাম মাথা চুলকে বলল, এ ব্যাটা মহাবজ্জাত। মল্লিকবাড়ির ফটোতেও ঢুকে পড়েছিল।
তার মানে? মানে কি ছাই কালুরামই জানে? সে মাথা চুলকোতে লাগল। তবে এর পর থেকে খুবই সতর্ক হয়ে গেল কালুরাম।