আমাদের টিলাটা বেড় দিয়ে নৌকো চলল প্রথমে উজানে। অনেকটা দূর গিয়ে স্রোতে গা ছেড়ে পেছিয়ে আসবে। আসতে আসতে স্রোতকে ফাঁকি দিয়ে ওপারের ঘাটে বাঁধবে। বিপজ্জনক কৌশল। সাঁতার জানি, কিন্তু আত্মবিশ্বাস নেই, নদীর স্রোত ক্ষুরধার, একধারে বসে জল দেখছি। স্রোতের বেগ নৌকোয় কঁকি দেয়, গুড়গুড় করে কাঁপায়। নৌকো ওঠে। নৌকো পড়ে। মানুষজন ছবির মতো স্থির বসে, মন চঞ্চল। মাঝিরা ঘেমে যাচ্ছে উজান নৌকো নিতে। তাদের দাঁতে দাঁত, টান-টান দড়ির মতো হাত-পায়ে ছিঁড়ে আসা ভাব।
অনেকদূর উজানে গেলাম, টিলার ছায়ায় ছায়ায়, তখনো আমাদের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে না। নৌকো যখন স্রোতের মুখে ছাড়ল তখন একটানে ঘুরপাক খেয়ে মাঝদরিয়ায় চলে গেছি। মাঝি হাঁকছে–সামাল! জল নৌকোর কানার সমান। অন্য ধার উঁচু হয়ে আছে। পৃথিবীটা সে-সময়ে বাঁকা হয়ে ঝুলে আছে। আকাশ বুকের ওপর। সেই সময়ে দিকের জ্ঞান ছিল না। বেভুল নৌকোটা যে কোনদিকে যাচ্ছে বোঝবার চেষ্টাও করিনি। নৌকোর কানা আঁকড়ে প্রাণপণে জীবনের সঙ্গে, আয়ুর সঙ্গে লেগে আছি। সাঁতার জানি, কিন্তু আমার কোনো জ্ঞানই যে সম্পূর্ণ নয়। অভিমান ভেসে যায়, ভয়ে চেঁচিয়ে ডাকি ‘মা’।
ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ অলৌকিকভাবে মাকে দেখতে পাই। নীল আকাশের গায়ে একটা টিলার কালচে সবুজ মাথা জেগে ওঠে বাতিঘরের মতো, আমাদের বাসাটার লাল টিনের চাল দেখা যায়। বারান্দায় বাঁশের জারি। তার সামনে সিঁড়ির উঁচু ধাপটায় মা দাঁড়িয়ে আছে। সকালের রোদ পড়েছে চোখে। মা হাতের পাতায় চোখ আড়াল করে নিবিষ্ট মনে চেয়ে আছে নদীর দিকে। বিশাল এক অথৈ পৃথিবী তার সামনে। সেই সীমাহীন পৃথিবীর কোন্ দিকে গেল তার অভিমানী ছেলে! মা নিবিষ্টভাবে, আকুলভাবে দেখছিল, বুক থেকে আটকে থাকা খাসের একটা পাখি বেরিয়ে গেল। নৌকো সোজা হয়ে চলতে থাকে। অভিমান ভুলে গভীর তৃষ্ণায় মার মূর্তিটার দিকে চেয়ে থাকি। দূর থেকে দূরে ক্রমে ছোটো হয়ে আসে মূর্তিটা। কিন্তু স্থির থাকে, বাতিঘরের মতো।
সেবার নিরুদ্দেশে যাওয়া হল না। ব্ৰহ্মপুত্ৰ পেরিয়ে কামাখ্যা পাহাড়ে উঠে দুপুরের আগেই ফিরে এলাম।
বাসার বাইরে যে পার্থিব সংসার সেইটাই ছিল ভয়ের। সংসারের ভিতরে আমি মা-বাবার আদুরে ছেলে, ভাই-বোনের প্রিয় সহোদর কিন্তু বাইরের পৃথিবীতে আমি কেউ না। একবার এক বুড়ো চিনে-বাদামওয়ালার কাছে একটা অচল সিকি গছানোর চেষ্টা করেছিলাম ছেলেমানুষি বুদ্ধিবশত। মনে হয়েছিল, লোকটা বোধহয় চোখে ভাল দেখে না। বাদাম নিয়ে সিকিটা দিতেই সে সেটা হাতড়ে দেখল, তারপর আমার হাত চেপে ধরে সে কী চিৎকার–এ ব্যাটা কোট্টা আমাকে সাট্টা পয়সা দিতে এসেছে। পুলিস..পুলিস! বাজারের এক ভিড় লোক ছুটে এল। অচেনা পৃথিবীর বিরুদ্ধতা দেখে এমন ভয় পেয়ে দিশেহারা হয়েছিলাম সেদিন! আর একবার বন্ধুদের সঙ্গে হাটে গেছি। হাট থেকে চুরি করা ছিল বন্ধুদের একটা খেলা। আমি করতাম না, ভয় করত। সেবারই প্রথম সাহস করে একটা টিনের ছোট্ট বাঁশি চুরি করেছিলাম। দোকানদার লক্ষ্য করেনি করেছিল অন্য একটা উটকো লোক। বাঁশি নিয়ে দোকান থেকে বেশ কিছু দূর চলে গেছি, হঠাৎ সেই লোকটা এসে আমার হাত ধরল, একটিও কথা না বলে পকেট থেকে বাঁশিটা বের করে নিয়ে চলে গেল। কেউ কিছু বুঝল না, কিন্তু আমি সেই লোকটার ওই আচরণের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলতে পারিনি। লজ্জায় ভিড় ভেঙে পালিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর একা একা সেই ঘটনার কথা ভেবে কতবার এবং আজও গা শিউরে ওঠে লজ্জায়, আধোঘুমে চমকে উঠি। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময়ে কাটিহারের খালাসিটোলার রাস্তায় একজন মুসলমান ছেলে আমাকে অকারণে গাল দিয়ে একটা চড় মেরেছিল। সে জানত না তার ওই চড়টা আমার আত্মার গায়ে এত দীর্ঘকাল তার হাতের ছাপ রেখে দেবে। ভুলতে পারি না, কিছুতেই সেই চূড়ান্ত গাল আর চড়টি ভুলতে পারি না। সংসারে স্নেহচ্ছায়ার বাইরে নিষ্ঠুর ও উদাসীন এই পৃথিবীটি রয়েছে। অচেনা মানুষের হৃদয়হীনতা রয়েছে, তাদের আক্রমণ আক্রোশ, নিষ্ঠুরতা আমি কী করে ঠেকাবো!
এই মানসিকতা থেকেই একটা অসুস্থ বৈরাগ্য জন্ম নিয়েছিল আমার শক্তিহীনতা অনুজ্জ্বল মন, লড়াইয়ের আগেই পরাজয়ের মনোভাব আমাকে ক্রমশ সমাজ-সংসারের বাইরের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, অচেনা মানুষ নেই, অপমান নেই, যেখানে আমি তৃপ্ত-একাকী, সেই নির্জনতার দিকে টান পড়তে থাকে। এই বৈরাগ্য শক্তিমানের সন্ন্যাস নয়, দুর্বলের পলায়ন।
একবার এক সুখী বাড়িতে গেছি মা-বাবা ভাই-বোনদের সঙ্গে। বড়লোকের বাড়ি, বিলিতি আসবাব, বৈঠকখানায় মদের বার, ছেলেমেয়েদের মুখে ইংরিজি। তারা আমাদের খুবই সমাদর করেছিল। সে বয়সে আমি ছিলাম ভীষণ রোগা। সেই রুগণতা বোধহয় সেই বাড়ির কর্তার খারাপ লেগেছিল। একটা ছেলে এত রোগা হবে কেন? তিনি তাঁর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের সামনে বার বার জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কি খাও না? ছোটো না? খেল না? তুমি অত রোগা কেন? সে ভারী অস্বস্তিকর একটা অবস্থা। আমার রুগ্ণতা এমনিতেই আমার মা-বাবার দুশ্চিন্তার কারণ ছিল, তার ওপর ওই সব প্রশ্ন মা-বাবারও ভাল লাগছিল না। প্রশ্ন করার ভঙ্গীটা ছিল অন্য ধরনের। তাতে সমবেদনা নেই, অনুকম্পাও না। বরং চাপা একটু ঘেন্না আর শ্লেষ ছিল। সে কেবল আমিই টের পাচ্ছিলাম। সূচিমুখ যন্ত্রণা। নানা কথার মাঝখানে ঘুরে-ফিরে তিনি আমাকে অপমান করতে লাগলেন। জিজ্ঞেস করলেন স্ট্রেট লাইনের ডেফিনেশন কী। পড়া ছিল, কিন্তু ঘাবড়ে যাওয়ায় সে মুহূর্তে মনে পড়েনি। বলতে পারলাম না দেখে তিনি সপরিবারে হাসলেন। আমি ঘামছি। আমার ভাইবোনেরা তখন সে বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কলের গান বাজাচ্ছে, ছবির বই দেখতে দেখতে অবাক হয়ে যাচ্ছে, কুকুরকে বল ছুঁড়ে দিয়ে খেলছে, আর আমি মায়ের কাছ ঘেঁষে কাঠ হয়ে বসে নিজের অপদার্থতার কথা ভাবছি। মনে হচ্ছিল, সমাজ-সংসার আমার জন্য নয়। পালাও পালাও! এরা সবাই তোমার শত্রু, প্রতিদ্বন্দ্বী, তোমার প্রতি এরা সবাই দয়াহীন। সংসারের বাইরের কোন নির্জনতায় চলে যাও, সন্ন্যাসী-বৈরাগী হয়ে যাও। বেঁচে থাকা মানেই প্রতি মুহূর্তে বৃশ্চিক দংশন, সূচিমুখ যন্ত্রণা, বেঁচে থাকা মানে আত্মায় মলিন হাতের ছাপ। সুতো হেঁড়ো, পালাও।