যে অনুভূতির কথা বলছিলাম তার বীজ সম্ভবত নিহিত ছিল এখানেই। চারিদিকের পৃথিবী এবং ঘটনাপ্রবাহে অবগাহন না করলে মনটা কেবলই শিকড়হীন গাছের মতো নিজের চারধারে পাক খেয়ে শুকিয়ে কুঁকড়ে যায়। বাস্তবতার জ্ঞানবর্জিত মন হচ্ছে আত্মভু। নিজের মজ্জা-মাংস-রক্ত ছাড়া সে আর খাদ্য-পানীয় পাবে কোথায়? ফলে তার দেহের পুষ্টি এবং লাবণ্য সঞ্চার হচ্ছিল না। অল্পবয়সেই আমার মুখচোখে বিষণ্ণতা ভর করতে লাগল।
মাঝে মাঝে কাজে অকাজে বাল্যকালের সেই অনুভূতি দেখা দেয়। সেই অনুভূতির বিস্ময়বোধ আমাকে ভীত, চঞ্চল করে তোলে। সমাধান পাই না। বাল্যকাল চলে গিয়ে কৈশোর আসছে–টের পাচ্ছি। দেহটি যষ্টির মতো সরল সোজা ওপরে উঠে যাচ্ছে, রোগা হাড়সার দেহ, অন্যমনস্ক, চিন্তাশীল, রুণ এক কিশোর। বই পড়তে ভালবাসে, কিন্তু পড়ার বইতে তার অনীহা। অর্থাৎ যা-কিছু কাজের কাজ তার কোনোটাতেই আগ্রহ নেই।
মনে আছে আলিপুরদুয়ারে এক স্পোর্টসে নাম দিয়েছি। অঙ্ক রেস। দর্শকদের মধ্যে আমার মা-বাবা, ছোটো দুটি ভাইবোন আর দিদিও রয়েছে। তাদের জন্যই বড় লজ্জা করছিল আমার। দৌড় শুরু হল। কুণ্ঠাজড়ানো পায়ে দৌড়ে গিয়ে কাগজের ওপর লেখা অঙ্কে উপুড় হয়ে পড়লাম। যোগ শেষ করে সবার আগে উঠেছি, দৌড়ে যাচ্ছি। নিশ্চিত ফাস্ট, কেউ ঠেকাতে পারবে না। হঠাৎ মনে হল, কাগজে নাম লেখা হয়নি। নাম লেখা না হলে বিচারকর্তা বুঝবে কি করে যে অঙ্কটা আমিই করেছি। ভেবে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ফিরে যাবো? নামটা লিখে নিয়ে আসবো? ভাবতে ভাবতেই আর একটা ছেলে উঠে দৌড়ে এল। দেখতে পেলাম আমার প্রথম স্থান হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। অথচ কাগজে নামও লেখা হয়নি। এই কয়েক মুহূর্তের দ্বিধা-সঙ্কোচের সুযোগে ছেলেটা আমাকে পিছনে ফেলে দৌড়ে গিয়ে তার কাগজ জমা দিল। তখন বোকার মতো অগত্যা আমিও গিয়ে নামহীন কাগজ জমা দিলাম। অঙ্ক-রেসের নিয়ম অনুযায়ী অঙ্ক ভুল হলে ফার্স্ট হলেও ফাস্ট হবে না। অঙ্ক ঠিক হওয়া চাই। অত প্রতিযোগীর মধ্যে আমরা যে প্রথম দুজন তাদেরই অঙ্ক ঠিক হয়েছিল। ফার্স্ট হল সেই ছেলেটা, আমি সেকেন্ড। পরে জানতে পারলাম সেই ছেলেটাও কাগজে নাম লেখেনি। কিন্তু তার বাস্তববুদ্ধি প্রখর বলে সে নাম লেখার কথা ভাবেওনি। আমি ভাবতে গিয়ে তার অনেক আগে অঙ্ক শেষ করেও পিছিয়ে পড়েছি। সেদিনই বুঝতে পারি, আমার সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে দ্বিধা। সেই অঙ্ক-রেসের শেষে মা হতাশ হয়ে বলেছিলেন –সবার আগে তুই উঠেছিস দেখে ভাবলাম যাক রুনু এবার ফাস্ট হবে। ওমা মাঝরাস্তায় দেখি ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছিস হাঁ করে। কী অত ভাবছিলি? বলে রাখা ভাল যে সেই রেসে সেকেন্ড প্রাইজ ছিল না।
পরবর্তীকালে বহুবার দেখেছি সবার আগে উঠেও দৌড় শেষ করতে পারছি না। পৃথিবীতে সঠিক জায়গায় নিজেকে নিয়োগ করতে হলে খানিকটা আবেগহীন দ্বিধাশূন্য নিষ্ঠুরতা দরকার। জানা দরকার বাস্তব কলাকৌশল। নিজের ভুল ত্রুটি নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে সর্বদা নিজেকে এগিয়ে রাখার চেষ্টাই ভাল। কিন্তু তা তো হল না।
বাঙালি ছেলেদের যে ভাবপ্রবণতার কথা শোনা যায় তা মিথ্যে নয়। আমার ভিতরে এই ভাবপ্রবণতার বাড়াবাড়ি বরাবর ছিল। সহজ আবেগে উদ্বেলিত হই, সহজ দুঃখে কাতর হয়ে পড়ি। চোখের সামনে পুজোবাড়ির বলি দেখে ভয়ঙ্কর মন খারাপ হয়। মনের এই ন্যাতানো স্বভাব থাকলে বড় হওয়ার পথে নানারকম বাধাবিপত্তির সৃষ্টি হয়। ভাবাবেগ জিনিসটা খারাপ নয়, অনেক আঘাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে। কিন্তু ভাবাবেগের নিজস্ব কিছু আঘাত আছে তা থেকে আত্মরক্ষা করা খুব দুরূহ।
ছেলেবেলা থেকেই আমি লোগা। হিলহিলে শরীর, বারোমাস পেটের অসুখ, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড-একটানা-একটা কিছু লেগেই থাকত। বাড়িতে রেলের ডাক্তারদের আনাগোনার বিরাম ছিল না। যখন বড় হয়েছি তখনো সেইসব ছেলেবেলায় আমার চিকিৎসা যাঁরা করেছিলেন সেইসব ডাক্তারদের সঙ্গে দেখা হলে তারা বলতেন–কেমন আছিস রে?
–ভাল।
-খুব ভুগিয়েছিলি ছেলেবেলায়। মা বাবার আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল খুব। আমার দশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি ছিলাম মা বাবার একমাত্র ছেলে। আমার দু বছরের বড় দিদি, আট বছরের ছোটো বোন, কাজেই দশ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়ির সবটুকু আদর আমি নিঙড়ে নিতাম। বড় মাছ, দুধের সরটুকু, ভাল জামা কাপড়–সবই পেতাম। সেই একমাত্র ছেলে কিরকম হবে না হবে– বাঁচবে কি বাঁচবে না–এই নিয়ে মা বাবার ছিল নিরন্তর ধুকপুকুনি। বাবা অনেক সাধু-সন্ন্যাসীকে বাসায় আনতেন, মাও জ্যোতিষ বা পশ্চিমা সাধু দেখলে ডেকে আনতেন। দাতাবাবা, আমেরিকা-প্রবাসী রামকৃষ্ণ মঠের সন্ন্যাসী, ভিখিরি সাধু কত এসেছে গেছে। তাদের অনেকে আমার হাত বা কোষ্ঠী বিচার করে বলেছে–এর সন্ন্যাসের দিকে টান। একে কোনো সুন্দর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবেন। নেপালের রাজজ্যোতিষী পরিচয় দিয়ে এক কালা জ্যোতিষ আসতেন আমাদের বাড়িতে। আমাকে দেখে বলেছিলেন–এই ছেলে মাঘ মাসে মারা যাবে।
বাবা ভীষণ ঘাবড়ে বললেন–কিন্তু আমি তো কোনো পাপ করিনি। জ্যোতিষ মাথা নেড়ে বললেন–তবু মরবেই।—-উপায়?
–উপায় আর কি? মাদুলি। বাবা আর আমি দুজনেই দুটো মাদুলি ধারণ করলাম। আমি মরলাম না।