অস্বীকার করা যায় না, এটা একরকমের অসুখই। অবাস্তবতার এই অনুভূতির দার্শনিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। পরবর্তীকালে কবি ওয়ার্ডওয়ার্থের জীবনী পড়তে গিয়ে দেখেছি, তারও অনেকটা এ ধরনের অনুভূতি হত। তিনি তখন দেয়ালে বা মাটিতে হাত চেপে ধরতেন, শরীরে ব্যথা দিতেন, এবং আস্তে আস্তে সেই শারীরিক বেদনা তার মানসিক ক্লেশকে উপশমিত করত। এ মুষ্টিযোগ আমার জানা ছিল না। তবে ওই অনুভূতি টের পেলেই আমি জলে-ডোবা মানুষের মতো প্রাণপণে মনের ওপর ভেসে থাকতে চাইতাম। বাস্তবিক ওই সময়ের অভিজ্ঞতা ছিল, যেন আমি এক অথৈ অনন্ত জলে ডুবে যাচ্ছি।
বছরে এরকম হত দুবার কি তিনবার। প্রথম প্রথম অনেকদিন বাদে বাদে হত। অনেক সময়ে ছেলেমানুষি বুদ্ধিবশত আমি ইচ্ছে করেই ওই অনুভূতিটা আনতে চেষ্টা করতাম। হাতে হয়ত কোনো কাজ নেই, খেলা নেই, একা ঘরে বসে আছি, সে সময়ে হঠাৎ ভাবতাম–আচ্ছা, আমার যদি এখন ওরকম হয় তবে কী হবে। এই ভেবে আমি চারদিকে চেয়ে গাছপালা, কি দেয়াল, কি আসবাব ইত্যাদিকে অবাস্তব, অলীক ভাবতে চেষ্টা করতাম। আশ্চর্য এই যে, চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে আমার গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যেত, আমার শরীর হাল্কা হয়ে যেন ওপরে উঠে যেতে থাকত এবং মনের ভিতরে এক অথৈ কূলকিনারাহীন কালো জল আমাকে গভীরে আকর্ষণ করত। এরকম ভাব স্থায়ী হত বড়জোর এক-আধ মিনিট। কিন্তু ওই এক-আধ মিনিট সময়েই আবার যন্ত্রণা এবং ভয় চুড়ান্ত জায়গায় উঠে যেত। চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করত। আমার ঘাম দিয়ে বোধটা প্রশমিত হত। আস্তে আস্তে স্বাভাবিকতা ফিরে পেতাম। শরীর এবং মন ক্লান্ত লাগত।
বয়স বাড়ে । খেলাধুলো, বন্ধুবান্ধব, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা সবই নিয়মানুসারে বেড়ে যায়। বাইরের ব্যস্ততা যখন নিজের মনকে আচ্ছাদন দিয়ে রাখে তখন মন দিয়ে খেলা আপনিই কমে যায়। একটু বয়স বাড়লে আমারও ওই খেলা কমে গিয়েছিল। কমলেও কিন্তু ছাড়েনি। বছরে এক-আধবার হতই। বড় ভয় পেতাম। মাকে গিয়ে বলতাম,মা, আমার মাঝে মাঝে কীরকম যেন সব মনে হয়।
মা জিজ্ঞেস করতকী রকম?
ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারতাম না। মা-ও বুঝতে পারত না, কিন্তু ভয় পেতো। বলত–ওসব ভাবিস কেন! না ভাবলেই হয়।
আমি নিজের ইচ্ছায় যে সব সময়ে ভাবতাম তা নয়। আমার আজও মনে আছে যে আমি ইচ্ছে না করলেও কে যেন জোর করে আমার ভিতরে ইচ্ছেটাকে তৈরি করে দিত। ভাবতে চাইছি না, তবু আমার ভিতরকার এক অবাধ্য দুরন্ত বালক যেন জোর করে আমাকে ভাবিয়ে তুলছে।
আমার বাবার ছিল রেলের চাকরি। ফলে একজায়গায় বেশিদিন থাকা আমাদের হত না। নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হত। সেই সব জায়গায় সর্বত্র তখন লোকালয় ছিল না। কোনো টিলার ওপরে বা নির্জন জায়গায় বাবা কোয়ার্টার বা বাংলা পেতেন। আমাদের পরিবারে লোকসংখ্যাও ছিল সামান্য। দিদি, আমি, ছোটো বোন, ভাই তখনো হয়নি। সেই সব নির্জন জায়গায় আমার বন্ধু জুটত কমই। যা-ও জুটত তারা ছিল কুলিকামিন বা বাবুর্চি বেয়ারার ছেলেরা। তারা আমার সঙ্গী হয়ে উঠত, বন্ধু হতে পারত না। ফলে মনের দিক থেকে একাকিত্ব কখনও ঘুচত না। পৃথিবীতে বন্ধুর মতো জিনিস খুব কমই আছে। যার সৎ বন্ধু থাকে তার অনেক মনের অসুখ ভাল হয়ে যায়। সেই বয়সে বন্ধুভাগ্য আমার ছিলই না। ফলে ওই মানসিক একাকিত্ব আমার ওই অসুখটাকে বাড়িয়েই তুলত। কিছু করার ছিল না। গুরুজনদের বুঝিয়ে বলতে পারতাম না বলে সেই যন্ত্রণা একা সহ্য করতে হত।
ক্রমে বড় হয়ে উঠতে উঠতে আত্মসচেতনতা বাড়তে লাগল। খেলাধুলো করি, স্কুলে যাই, দুষ্টুমি করে বেড়াই। বাইরে থেকে দেখে স্বাভাবিক অন্য ছেলেদের মতোই লাগে আমাকে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমার বিশিষ্ট এক ‘আমি’ তৈরি হতে থাকে। সব মানুষেরই যেমন হয়।
উল্লেখের বিষয় এই যে, আমার ছেলেবেলাতেই যে আমি’ তৈরি হয়েছিল তার বৈশিষ্ট্য ছিল বিষণ্ণতা, অন্যমনস্কতা, চিন্তাশীলতা, একাকিত্ববোধ, নিঃসঙ্গতা। এই ধরনের ছেলেরা সাধারণত বই পড়তে ভালবাসে। খেলাধুলো বা আমোদপ্রমোদে, লোকসঙ্গে, ভিড়ে তেমন আনন্দ পায় না। বই পড়তে পড়তে বল্গাহীন কল্পনাকে ছেড়ে দেওয়া, অবাধ চিন্তার রাজ্যে প্রিয় নির্বাসন–এর চেয়ে স্বাদু আমার কিছুই ছিল না। কাজেই অনিবার্যভাবে বাস্তবতাবোধ, কর্মপ্রিয়তা বা কোনো কাজে পটুত্ব কমে যেতে লাগল। কল্পনাবিলাসীর ভাগ্য যে রকম হয়ে থাকে। চিন্তার রাজ্যে যে রাজা উজীর, বাস্তবক্ষেত্রে সে প্রায় অপদার্থ।
খেলাধুলোয় আমার খানিকটা দখল ছিল। বলে শট মারতে ভালই পারতাম, ক্রিকেটে ব্যাট চালানো আনাড়ির মতো ছিল না, হাইজাম্প লঙজাম্প বা দৌড়ে পটুত্ব না থাক, অভ্যাস ছিল। অনুষ্ঠান বা সাংস্কৃতিক সম্মেলনে কবিতা আবৃত্তি করতাম। কিন্তু সেগুলো ছিল আমার মনের উপরিভাগের ব্যাপার। মনের গভীরতার স্তরেও বাইরের এসব দৌড় লাফ আবৃত্তি তরঙ্গ তুলত। সেখানে ছিল এক অনপনেয় স্পর্শকাতরতা, আত্মচিন্তা, অভিমান। বাইরের জীবনের যত অকৃতিত্ব রাগ-ক্ষোভ সব সেখানে গিয়ে বাসা বাঁধত এবং সমস্ত আঘাতই সেখানে বারংবার কল্পনার রাজ্যের দরজার পাল্লা উন্মোচিত করে দিত। বাইরের জগতের ব্যর্থ ‘আমি’ সেই কল্পনার জগতে আশ্রয় পেতাম। কল্পনার জগতে বহু মানুষেরই বিচরণ-তবে তার তারতম্য আছে। নিজেকে নিয়ে যার যত চিন্তা, অস্বস্তি, আত্মমগ্নতা তার বাস্তববুদ্ধি তত কম, আঘাত সহ্য করার শক্তি সামান্যই, আত্মনির্ভরশীলতা প্রায় শূন্য। আমারও সেই বিপদ দেখা দিতে লাগল। আমি আরো বেশি করে বই আর বইয়ের মধ্যে ডুবে যেতে লাগলাম। হাতে যখন বই থাকত না তখন মনে কল্পনা থাকত।