হরসুন্দরবাবুর আজ চোখে জল এল।
বাড়ি ফিরে তিনি গুম হয়ে রইলেন। রাতে ভাল করে খেলেন না। গভীর রাতে তিনি ছাদে উঠে চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে অসহায়ভাবে ভাবলেন, কী যে করব বুঝতে পারছি না।
কাছেপিঠে কে যেন একটা হাই তুলল, তারপর আঙুল মটকানোর শব্দ হলো, তারপর বলল “হরি, হরি”। হরসুন্দরবাবু চারদিকটা চেয়ে দেখলেন। ছাদ জনশূন্য, শীতকালের গভীর রাতে ছাদে আসবেই বা কে?
তিনি কঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে?
ভেবে দেখতে হবে হে, ভেবে দেখতে হবে।
তার মানে?
কতবার জন্মেছি তার কি হিসেব আছে? কোন জন্মে কে ছিলুম তা যে গুবলেট হয়ে যায় বাপ। এ জন্মে বিশু তো ও জন্মে নিতাই, পরের জন্মে হয়তো চীনেম্যান চাঁই চুঁই।
আ-আপনি কোথায়? দে-দেখতে পাচ্ছি না তো?
গলার স্বরটা খিঁচিয়ে উঠে বলল, দেখার চোখ আছে কি তোমার যে দেখবে? সারাদিনই তো তোমার ধারে-কাছে ঘুরঘুর করি, দেখতে চেয়েছো কি কখনও?
আজ্ঞে, আমি যে কিছু বুঝতে পারছি না। ভয় পাচ্ছি, মাথা ঝিমঝিম করছে।
আ মোলো! এ যে ভাল করতে এসে বিপদ হলো। আ-আপনি কি চান?
তোমার মতো গবেটদের কান দুটো মলে দিতেই চাই হে। কিন্তু বিধি বাম, সে উপায় নেই।
আমি কী করেছি? আপনি আমার ওপর রাগ করছেন কেন? রাগ করব না? তিনটে কাঁচা মাথার ছোঁড়া তিন তিনবার যে তোমাকে বোকা বানাল তা থেকে শিক্ষা পেয়েছো কি? কিছু করতে পারলে?
আজ্ঞে কী করব? তাদের হাতে যে ছোরা আর বন্দুক।
আর তোমার বুঝি কিছু নেই?
আজ্ঞে না।
কে বলল নেই?
ইয়ে, আমার বন্দুক, পিস্তল বা ছোরাছুরি নেই। তবে আমার গিন্নির একখানা বঁটি আছে, আর আমার ছেলে ভুতোর একটা পেনসিল কাটা ছুরি আছে, আর আমার মায়ের বেড়াল তাড়ানোর জন্য একখানা ছোটো লাঠি আছে।
আহা, ওসব জানতে চাইছে কে? বঁটি-লাঠির কথা জিজ্ঞেস করেছি কি তোমায়? বলি এসব ছাড়া তোমার আর কিছু নেই?
আজ্ঞে, মনে পড়ছে না। শুনেছি আমার ঠাকুরদার একটা গাদা বন্দুক ছিল।
গবেট আর কাকে বলে? বলি বন্দুক-টক ছাড়া আর কিছু নেই তোমার?
আজ্ঞে না।
বলি, বুদ্ধি বলে একটা বস্তু আছে জানো তো!
জানি।
তোমার সেটাও নেই?
আজ্ঞে, ঠিক বুঝতে পারছি না।
একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ হলো। তারপর গলার স্বরটা বলল, শোনো, এবার যখন ওই মর্কটগুলো তোমাকে পাকড়াও করবে তখন একটুও ঘাবড়াবে না। হাসি-হাসি মুখ করে শুধু জিজ্ঞেস করবে, আচ্ছা, শিবেনবাবু ভাল আছেন তো?
শুধু এই কথা বললেই হবে?
বলেই দেখ না!
তৃতীয় মাসটাও কষ্টেসৃষ্টে কেটে গেল। আবার পয়লা তারিখ এল এবং হরসুন্দরবাবু আবার বেতন পেলেন।
বাড়ি ফেরার সময় বুকটা দুরুদুরু করছিল। যে-কথাটা বলতে হবে তা বারবার বিড়বিড় করে আওড়াচ্ছেন। হাত-পা কাঁপছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। গলির মুখে এসে একটু থমকে দাঁড়ালেন। তারপর দুর্গা বলে অন্ধকারে পা বাড়ালেন।
কয়েক পা যেতে না যেতেই তিন মূর্তি ঘিরে ফেলল তাকে। বুকে পিস্তল, পেটে আর পিঠে ছোরা। পিস্তলওলা বলল, চেঁচাবেন না। যা আছে দিয়ে দিন।
জীবনে কোনও সাহসের কাজ করেননি হরসুন্দরবাবু। আজই প্রথম করলেন। জোর করে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, শিবেনবাবু ভাল আছেন তো?
ছেলে তিনটে হঠাৎ যেন থমকে গেল। আর তার পরেই দুড়দাড় দৌড়ে এমনভাবে পালাল যেন ভূত দেখেছে।
হরসুন্দরবাবু খুবই অবাক হয়ে গেলেন। এই সামান্য কথায় এত ভয় পাওয়ার কী আছে? যাক গে, এবার মাইনের টাকাটা তো বেঁচে গেল!
না, এর পর থেকে হরসুন্দরবাবুকে আর ওদের পাল্লায় পড়তে হয়নি বটে, কিন্তু তার ধাঁধাটা গেল না। এই তো সেদিন তার অফিসের বড়বাবু তাকে কাজের একটা ভুলের জন্য খুব বকাঝকা করে চার্জশীট দেন আর কি। হরসুন্দরবাবু শুধু হাসি-হাসি মুখ করে তাকে বলেছিলেন, আচ্ছা, শিবেনবাবু ভাল আছেন তো! তাইতে বড়বাবু এমন ঘাবড়ে গেলেন যে আর বলার নয়। তারপর থেকে খুব ভাল ব্যবহার করে যাচ্ছেন।
সেদিন বাজার থেকে পচা মাছ এনেছিলেন বলে হরসুন্দরের গিন্নি তাকে খুবই তুলোধোনা করছিলেন। হরসুন্দরবাবু তাকেও বললেন, আচ্ছা, শিবেনবাবু ভাল আছেন তো? গিন্নি একেবারে জল।
হ্যাঁ, এখন হরসুন্দরবাবু খুবই ভাল আছেন। কোনও উদ্বেগ, অশান্তি নেই। বিপদ দেখা দিলেই তিনি শুধু বলেন, আচ্ছা, শিবেনবাবু ভাল আছেন তো! মন্ত্রের মতো কাজ হয়।
সূত্রসন্ধান
ছেলেবেলা থেকেই–অর্থাৎ যখন আমার বয়স ছয় কি সাত–তখন থেকেই আমার ভিতরে একরকমের অদ্ভুত অনুভূতি মাঝে মাঝে দেখা দিত। এই অনুভূতি কিরকম তা স্পষ্ট করে বোঝানো খুব শক্ত। তবে একথা বলা যায় যে, অনুভূতিটা একধরনের অবাস্তবতার। একা একা থাকলে হঠাৎ কখনো চারদিকে চেয়ে মনে হত–আমার চারদিকে যা রয়েছে–গাছপালা, কিংবা ঘরের দেয়াল, আসবাব, কিংবা মানুষ–এরা সবাই অবাস্তব, মিথ্যে। এসব জিনিসপত্র, গাছপালা এরা কোনোটাই সত্য নয়। এরকম ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মাথা গুলিয়ে উঠত। ওই চিন্তা মুহূর্তের মধ্যে প্রবল আকার ধারণ করত, মনে হত–এই পৃথিবীতে যা আমি চোখের সামনে দেখছি তা সবই এক অদ্ভুত উদ্ভট অবাস্তব ব্যাপার, এসবের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আমি এই পৃথিবীর কেউ না। এই প্রত্যক্ষ বস্তুগুলি, এই আলো-অন্ধকার, এই প্রিয়জন–এসবই যেন আমার চারদিকের এক মিথ্যে, অলীক আবরণ মাত্র। ভাবতে ভাবতেই আমার শরীর যেন ঊধ্বদিকে উঠতে থাকত, গা শিউরোতো। আমার মনে হত এক ভীষণ যন্ত্রণায় আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। আমার মন কিছুতেই এই চিন্তা তখন আর করতে চাইত না, কিন্তু চিন্তা তখন আমাকে ছাড়তও না । বেশ কয়েকটা ঝাঁকুনি দিত আমাকে। কিছুক্ষণ আমি আমার মধ্যে থাকতাম না। এই অনুভূতি আমার শরীরে এবং মনে এত প্রকট এবং প্রবলভাবে দেখা দিত যে, আমার বিশ্বাস ছিল এটা আমার অসুখ। সাঙ্ঘাতিক ধরনের কোনো অসুখ।