রাজবাড়ি আর বেশি দূরে নয়। দুখানা গ্রাম পেরোলেই শহর। শহরের মাঝখানে মস্ত রাজবাড়ি। চারদিকে বিশাল অঙ্গন। আজ হাজার হাজার মানুষ পালোয়ানদের দেখতে আসবে।
সামনেই একটা গরুর গাড়ি যাচ্ছে। গরুর গাড়িতে একটা বড়সড় চেহারার লোক বসে বসে ঢুলছে। রামরিখ দেখতে পেল গরুর গাড়িটা রাস্তায় একটা খাদে পড়ে একটা ঝাঁকুনি খেয়ে আটকে গেছে। বলদ দুটো টেনে তুলতে পারছে না। যে লোকটা টুলছিল সে একটু বিরক্ত হয়ে নেমে পড়ল। মালকোচা মারছে। রামরিখ কাঁধ দিয়ে একটা চড় মেরে গরুর গাড়িটা খাদ থেকে তুলে নিয়ে বলল, সামান্য কাজ।
মোটাসোটা লোকটা তার দিকে চেয়ে একটু আড়মোড়া ভেঙে বলল, পালোয়ান নাকি তুমি?
ওই সামান্য কিছু চর্চা করি আর কি।
বেশ, বেশ। বলে লোকটা একটু হাসল, তা তোমার জিনিসপত্র কই?
ওই যে গরুর গাড়িতে। পাঁচ মন ওজনের গদা।
লোকটি অবাক হয়ে বলে, পাঁচ মন? যাঃ–
কথা কইতে কইতে পিছনের গরুর গাড়িটার কাছে চলে এল। রামরিখ গদাটা দেখিয়ে বলল, ওই যে।
লোকটা গদাটা দেখে বলল, এটা ফাপা জিনিস নয় তো?
রামরিখ হেসে বলল, আরে না, নিরেট লোহার গদা।
হতেই পারে না। বলে লোকটা গদাটা তুলে নিয়ে হাতে নাচিয়ে একটু দেখে নিয়ে হঠাৎ নিজের হাঁটুটা তুলে গদাটা তার ওপর রেখে দু’হাতের চাড় দিয়ে মচাৎ করে গদাটা দু-আধখানা করে ভেঙে ফেলল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, নাঃ, নিরেট জিনিসই বটে হে।
রামরিখ হাঁ করে চেয়ে রইল। লোহার গদা কেউ ভাঙতে পারে এ তার জানা ছিল না।
লোকটা মুখে একটু দুঃখপ্রকাশ করে বলল, সামনের গায়েই কামারশালা আছে, জুড়ে নিও ভাই। অসাবধানে তোমার খেলনাটা ভেঙে ফেলেছি। বলে লোকটা চলে গেল।
রামরিখ গদাটা কামারশালায় জুড়ে নিতে গাঁয়ে ঢুকল। একটু চিন্তিত। মনে আর তত স্ফূর্তি নেই।
কামার ভীষণ ব্যস্ত। বলল, আমার যে গদা জোড়া দেওয়ার সময় নেই। রামরিখ করুণ গলায় বলল, ভাই, আমি যে রাজবাড়ির শক্তি পরীক্ষায় যাচ্ছি। সময় নেই, একটু করে দাও ভাই।
কামার খুবই বিরক্ত হয়ে বলল, কোথায় তোমার গদা?
এই যে! বলে গদার টুকরো দুটো দু’হাতে তুলে বলল, এইটুকু গদা! বলে কামারশালার আর এক কোণে অন্তত একশ হাত দূরে যেখানে তার ছোট ছেলেটা কাজ করছিল সেদিকে ছুঁড়ে দিতে দিতে বলল, ওরে বিশে এ-দু’টো টুকরো জুড়ে দে তো।
বিশে একটা টুকরো বাঁ হাতে, অন্যটা ডান হাতে লুফে নিয়ে বলল, দিই বাবা।
রামরিখ অপোবদন হয়ে বসে রইল। গদা জুড়ে নিয়ে রামরিখ ফের যখন রওনা হল তখন তার পা চলছে না। মনটা বড়ই খারাপ।
আর একটা গাঁ পেরোলেই শহর। রাস্তার পাশে কতগুলো ছেলে ডাংগুলি খেলছিল। কী কারণে তাদের মধ্যে একটু বিবাদ হয়েছে। হঠাৎ একটা ছেলে ছুটে এসে বলল, মশাই, আপনার ডাণ্ডাটা একটু ধার দেবেন? আমরা এই পাটিটা খেলেই দিয়ে দেব। আমাদের ডাণ্ডাটা ভেঙে গেল কি না এই মাত্র।
বলেই ছেলেটা গদাটা গরুর গাড়ির ওপর থেকে তুলে নিয়েই ছুট। রামরিখ দাঁড়িয়ে দেখল, ছেলেটা তার গদা দিয়ে গুটি তুলল, তারপর সেই গুটি সত্তর হাত দূরে পাঠাল। গদা দিয়ে একহাতে দূরত্বটা মাপল। তারপর দৌড়ে এসে ফের গরুর গাড়িতে গদাটা রেখে ছুটে গেল।
রামরিখ আর এগোল না। গরুর গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই ফেরত যেতে লাগল।
শিবেনবাবু ভাল আছেন তো
হরসুন্দরবাবু একটু নাদুসনুদুস, ধীর স্থির শান্ত প্রকৃতির মানুষ। তিনি কোঁচা দুলিয়ে ধুতি পরেন, ফুলহাতা জামার গলা অবধি বোতাম আঁটেন, কখনও হাতা গোটান না। শীত-গ্রীষ্ম সব সময়ে তিনি হাঁটু অবধি মোজা আর পাম্পশু পরেন। তাঁর বেশ মোটা এক জোড়া গোঁফ আছে। চুলে পরিপাটি সিঁথি। হরসুন্দরবাবু খুব নিরীহ মানুষও বটে।
সেদিন মাসের পয়লা তারিখ। হরসুন্দরবাবু সেদিন বেতন পেয়েছেন। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরছেন। যে গলিটায় তিনি থাকেন সেটা বেশ অন্ধকার, পাড়াটাও ভাল নয়। হরসুন্দরবাবু গলিতে ঢুকে কয়েক পা এগোতেই তিনটে ছোকরা তাকে ঘিরে ফেলল। একজন বুকে রিভলভার ঠেকাল, একজন পেটে আর অন্যজন পিঠে দুটো ছোরা ধরল। রিভলভারওলা বলল, চেঁচাবেন না। যা আছে দিয়ে দিন।
হরসুন্দরবাবু খুবই ভয় পেলেন। ভয়ে তার গলা কাঁপতে লাগল। বললেন, প্রাণে মেরো না ভাই। দিচ্ছি।
মাইনের পুরো টাকাটা নিয়ে তিনজন হাপিস হয়ে গেল। হরসুন্দরবাবু ভয়ে চেঁচামেচি করলেন না। যদি তারা ফিরে আসে! বাড়িতে ফিরেও কারও কাছে ঘটনাটা প্রকাশ করলেন না। ভাবলেন, এ মাসটা ধারকর্জ করে চালিয়ে নিলেই হবে।
তা নিলেনও হরসুন্দরবাবু। একটা মাস দেখতে দেখতে চলে গেল। আবার পয়লা তারিখ এল। হরসুন্দরবাবু আবার বেতন পেলেন।
ফেরার সময় যখন গলির মধ্যে ঢুকলেন তখন আচমকা ফের তিনটে লোক ঘিরে ধরল। বুকে রিভলভার, পেটে-পিঠে ছোরা।
রিভলভারওলা বলল, যা আছে দিয়ে দিন। চেঁচাবেন না।
হরসুন্দরবাবু ফের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, প্রাণে মেরো না ভাই। দিচ্ছি।
মাইনের টাকা নিয়ে লোক তিনটে হাপিস হয়ে গেল।
হরসুন্দরবাবু এবারও বাড়ি ফিরে কাউকে কিছু বললেন না। ভাবলেন, এ মাসটাও কোনওরকমে চালিয়ে নেবেন।
কষ্ট হলো যদিও, কিন্তু হরসুন্দরবাবু চালিয়েও নিলেন। ফের পয়লা তারিখ এল। হরসুন্দরবাবু বেতন পেলেন।
বাড়ি ফেরার সময় অন্ধকার গলিতে ঠিক আগের মতোই তিনটে লোক ঘিরে ধরল তাঁকে। বুকে, পিঠে, পেটে ঠিক একই জায়গায় রিভলভার আর ছোরা ধরল। একই কথা বলল এবং বেতনের টাকাটা নিয়ে হাওয়া হলো।