“মাঠে! ও তো ঠিক মাঠ নয়, জলা জায়গা, ওখানে গাড়ি রাখা অসম্ভব।”
“আমার গাড়ি সর্বত্র যেতে পারে। আসুন না দেখবেন।” কৌতূহলী সোমনাথবাবু লোকটার সঙ্গে এসে জলার ধারে পৌঁছে অবাক। কোথাও কিছু নেই।
“কোথায় আপনার গাড়ি মশাই?” বলে পাশে তাকিয়ে দেখেন লোকটাও নেই। সোমনাথবাবু বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলেন।
অবশ্য বিস্ময়ের তখনও অনেক কিছু বাকি ছিল। ফাঁকা মাঠ, লোকটাও হাওয়া দেখে সোমনাথবাবু ফিরবার জন্য সবে পা বাড়িয়েছেন, এমন সময় অদৃশ্য থেকে লোকটা বলে উঠল, “আহা, যাবেন না, একটা মিনিট অপেক্ষা করুন।”
বলতে বলতেই সামনে নৈবেদ্যর আকারের একটা জিনিস ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে লাগল। বেশ বড় জিনিস, একখানা ছোটোখাটো দোতলা বাড়ির সমান। নীচের দিকটা গোল, ওপরের দিকটা সরু।
“এটা আবার কী জিনিস?”
নৈবেদ্যর গায়ে পটাং করে একটা চৌকো দরজা খুলে গেল আর নেমে এল একখানা সিঁড়ি। লোকটা দরজায় দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বলল, “আসুন আসুন, আস্তাজ্ঞে হোক।”
সোমনাথবাবু এমন বিস্মিত হয়েছেন যে, কথাই বলতে পারলেন না কিছুক্ষণ। তারপর অস্ফুট গলায় তোতলাতে লাগলেন, “ভূ-ভূত! ভূ ভূতুড়ে!..”
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “না মশাই না। ভূতুড়ে নয়। গাড়িটা অদৃশ্য করে না রাখলে যে লোকের নজরে পড়বে। আসুন, চলে আসুন। কোনও ভয় নেই।”
সোমনাথবাবু এক পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, “ও বাবা, আপনি তো সাঙ্ঘাতিক লোক! আমি ও ফাঁদে পা দিচ্ছি না। আপনি যান, আমি যাবো না।”
লোকটা করুণ মুখে বলে, “কিন্তু আমি তো খারাপ লোক নই সোমনাথবাবু।”
সোমনাথবাবু সভয়ে লোকটার দিকে চেয়ে বললেন, “খারাপ নন, তবে ভয়ঙ্কর। আপনি গ্রহান্তরের লোক।”
“আজ্ঞে, আপনাদের হিসেবে মাত্র দু হাজার লাইট ইয়ার দূরে আমার গ্রহ। বেশ বড় গ্রহ। আমাদের সূর্যের নাম সোনা। সোনার চারদিকে দেড় হাজার ছোটো বড় গ্রহ আছে। সব কটা গ্রহই বাসযোগ্য। আপনাদের মতো মোটে একটা গ্রহে প্রাণী নয় সেখানে। সব ক’টা গ্রহেই নানা প্রাণী আর উদ্ভিদ। কোনও কোনও গ্রহে এখন প্রস্তরযুগ চলছে কোনওটায় চলছে ডায়নোসরদের যুগ কোথাও বা সভ্যতা অনেকদূর এগিয়ে গেছে, কোনও গ্রহে ঘোর কলি, কোনওটাতে সত্য, কোনওটাতে ত্রেতা, কোথাও বা দ্বাপর–সে এক ভারী মজার ব্যাপার। বেশি সময় লাগবে না, এ গাড়ি আপনাকে সব দেখিয়ে দেবে।”
“ওরে বাবা রে!” বলে সোমনাথবাবু প্রাণপণে পাঁই পাঁই করে ছুটতে লাগলেন বাড়ির দিকে। কিন্তু পারলেন না। একটা সাঁড়াশির মতো যন্ত্র পট করে এগিয়ে এসে তাকে খপ করে ধরে সাঁ করে তুলে নিল সেই নৈবেদ্যর মধ্যে।
তারপর একটা ঝাঁকুনি আর তারপর একটা দুলুনি। সোমনাথবাবুর একটু মূৰ্ছার মতো হলো। যখন চোখ চাইলেন তখন দেখেন নৈবেদ্যটা এক জায়গায় থেমেছে। দরজা খোলা। লোকটা একগাল হেসে বলল, “আসুন, ডায়নোসর দেখবেন না! ওই যে।”
দরজার কাছে গিয়ে সোমনাথবাবুর আবার মূৰ্ছা যাওয়ার যোগাড়। ছবিতে যেমন দেখেছেন হুবহু তেমনি দেখতে গোটা দশেক ডাইনোসর বিশাল পাহাড়ের মতো চেহারা নিয়ে চলাফেরা করছে। আকাশে উড়ছে বিশাল টেরোড্যাকটিল এবং অন্যান্য বিকট পাখি।
ভয়ে চোখ বুজলেন সোমনাথ। আবার দুলুনি। এবার যেখানে যান থামল সেখানে সব চামড়া আর গাছের ছালের নেংটি পরা মানুষ ঘষে ঘষে অস্ত্র তৈরি করছে। মহাকাশযান দেখে তারা অস্ত্র নিয়ে তেড়ে এল। দু-চারটে তীক্ষ্ণ পাথরের টুকরো এসে লাগলও মহাকাশযানের গায়ে। লোকটা তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে তার গাড়ি ছেড়ে দিল।
এবারের গ্রহটা রীতিমতো ভাল। দেখা গেল রামচন্দ্র আর লক্ষ্মণভাই শিকার করতে বেরিয়েছেন। দুজনেই খুব হাসছেন। রামচন্দ্রকে জোড়হাতে প্রণাম করলেন সোমনাথবাবু। রামচন্দ্র বরাভয় দেখিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন।
সোমনাথবাবু ঘামতে ঘামতে বললেন, “এসব কি সত্যি? না স্বপ্ন দেখছি?”
“সব সত্যি। আরও আছে।”
“আমি আর দেখবো না। যথেষ্ট হয়েছে। মশাই, পায়ে পড়ি, বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসুন।”
লোকটা বিনীতভাবে বলল, “যে আজ্ঞে। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসবেন। আরও কত কী দেখার আছে।”
মহাকাশযানটা ফের শূন্যে উঠল। সেই দুলুনি। কিছুক্ষণ পর জলার মাঠে নেমে পড়তেই সোমনাথবাবু প্রায় লাফ দিয়ে বৈরিয়ে এলেন।
লোকটা পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলল, “দাদা, একটু মনে রাখবেন আমাকে, মাঝে মাঝে বিপদে পড়ে এসে পড়লে পরোটা-টরোটা যেন পাই।”
“হবে, হবে।” বলতে বলতে সোমনাথবাবু বাড়ির দিকে ছুটতে লাগলেন।
শক্তিপরীক্ষা
রামরিখ পালোয়ান রাজবাড়ি চলেছে। সেখানে আজ বিরাট শক্তি পরীক্ষা। নানা দেশ থেকে বহু পালোয়ান জড়ো হবে। তারপর কার কত শক্তি তার পরীক্ষা দিতে হবে। কুস্তি-টুস্তি নয়, শুধু যতটা পারে নিজের শক্তি দেখাবে, তা যে যেভাবে পারে।
রামরিখ ভেবেচিন্তে একটা পাঁচ মন ওজনের লোহার গদা নিয়েছে। এইটা সে বাই বাই করে ঘুরিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে। গদাটা একটা গরুর গাড়িতে করে পিছনে আসছে।
রামরিখ আজ ধুতি পরেছে। গায়ে রঙিন জামা, মাথায় পাগড়ি। মাঝে মাঝে গোঁফে তা দিতে দিতে নাগরা জুতোর শব্দ তুলে হাঁটছে। মনে একটা স্ফূর্তি। তার ধারণা, আজকের পরীক্ষায় সেই আসর মাত করে আসবে। ওস্তাদকে একশ মোহর পুরস্কার দেওয়া হবে।